ভারতের বিধান সভায় নির্বাচনে আম-আদমির বিজয়: একটি পর্যালোচনা

42

কাজি রশিদ উদ্দিন

দিল্লি রাজ্য নির্বাচনে মোদি-অমিতের বিজেপির ব্যাপক পরাজয় ঘটেছে। আম আদমি পার্টি দলের আগের ২০১৫ সালের নির্বাচনের মতোই এবারো অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বে ৭০ আসনের দিল্লির ৬০র বেশি আসন পেয়ে নির্বাচিত হয়েছে। জার্মান ভেলে গ্লোবাল মিডিয়া হিসেবে এত জনপ্রিয় না হলেও ফেলনার বিষয় নয়। সেই ইংরেজি ডয়েচে ভেলের শিরোনাম ‘দিল্লির নির্বাচনী হার’। এ টি কি প্রধানমন্ত্রী মোদির শেষ দিনের শুরু ?
দিল্লিই প্রথম কথিত ম্যাজিসিয়ান অমিত শাহ ও তার দলের অপরাজেয় ভার তৈরী হয়ে গিয়েছিল সেই দপ চুর্ন হয়ে গিয়েছে। নিঃসন্দেহে এই ভাঙা আত্মবিশ্বাস কতটা অমিতরা ফেরত আনতে পারেন তা এখন দেখার বিষয়।
বিনয় মানবজীবনের একটি মহৎগুণ। শব্দটির অর্থ মিনতি, নম্রতা, শিক্ষা। আর যিনি বিনয় প্রকাশ করেন তাকে বলা হয় বিনয়ী। বিপরীত শব্দ দম্ভ ও দাম্ভিক যার সহজ অর্থ গর্ব বা অহংকার, যে গর্ব বা অহংকার করে সে গর্বিত কিংবা অহংকারী। বিনয় মানুষকে অপরাপর সৃষ্টি থেকে আলাদা করে। দুনিয়ার তাবত সফল মানুষের মধ্যেই গুণটির উপস্থিতি লক্ষনীয় মাত্রায় বিদ্যমান দেখা যায়। ব্যক্তি জীবনে যিনি যত বেশি বিনয়ী ও নম্র তিনি তত বেশি সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হন। আল কোরআনে বলা হয়েছে, তারাই দয়াময়ের প্রিয় বান্দা, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে (সুরা ফুরআন-৬৩) বিনয়ীকে স্রষ্টা যেমন ভালবাসেন তেমনি সব মানুষও ভালবাসে। বিনয়গুণের জাদুর স্পর্শে মানুষ হয়ে উঠে সবার থেকে আলাদা। যখন জীবনে বিনয়ের আলো না আসে তখন অহংকারের অন্ধকারে নিয়ে যায় মানবতা। অন্তরে নিজের বড়ত্ব সৃষ্টি হয়।
বিনয় অবলম্বন করলে বাহ্যিকভাবে যদিও নিজেকে ছোট মনে হয়, কিন্তু তার মর্যদা অপনা আপনি উপরে উঠতে থাকে। বিনয়ী এবং কোমল আচরণের অধিকারীকে সবাই পছন্দ করে, সব ধর্মে এবং সামাজিক বিবেচনায়ও বিনয়ী মানুষের গ্রহণ যোগ্যতা রয়েছে। বিনয় মানুষকে সামাজিকভাবে সম্মানিত করে। আল কোরআনে বলা হয়েছে, অহংকারবশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করোনা এবং পৃথিবীতে গর্বভরে পচারণা করোনা। নিশ্চয় আল্লাহ কোনো দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না (সূরা লুকমান : ১৮)
আজকাল অনেকে বিনয়কে দুর্বলতাভাবে। কিন্তু হাল আমলেও সাধারণ মানুষের কাছে বিনয় ও বিনয়ীর কদর আছে। দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনীতি সচেতনদের কাছে বিষয়টি দারুণভাবে ধরা দিয়েছে ভারতের দিল্লি রাজ্যের বিধান সভার নির্বাচনে। এই নির্বাচনি ফল উপমহাদেশের অসাম্প্রদায়িক মানুষ দারুণভাবে উপভোগ করেছে। অবাক বিস্ময়ে সবাই দেখলো দিল্লির বাসিন্দারা দাম্ভিকভাবে পরিহার করে বিনয়ী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের প্রতি আস্থা রেখে (আম আদমি) তাকে দলকে বিপুলভাবে বিজয়ী করেছে। বর্জন করেছে মোদি-অমিত শাহ জুটিকে, মানে হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপিকে কেজরিওয়ালের এই বিজয়ের পেছনে বহুবিদ কারণ রয়েছে, তবে এ কথা নিদ্ধিধায় বলা যায়, এই বিজয়ের পেছনে কেজরিওয়ালের বিনয় নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, দিল্লির ভোটারদের যে বিষয়টা প্রবলভাবে আকর্ষণ করেছে, তা হলো ব্যক্তি কেজরিওয়াল এবং দলগতভাবে আগের বিনয়, এটি কেজরিওয়ালকে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে সহায়তা করেছে, মূলত কেজরিওয়ালের বিনয়ের কাছে মোদি-অমিত শাহ জুটির দাম্ভিকতার পরাজয় ঘটেছে। তাদের বিভাজনের রাজনীতি ধরাশায়ী হয়েছে। বিজেপি যতই আক্রকমনাত্মক হয়েছে আম আদমি ততই বিনয়ী হয়েছে, ফলে ভোটারদের সহানুভুতির পাল্লা তাদের দিকেই গিয়েছে, বিজেপি জোর দিয়েছিলেন মেরুকরণের রাজনীতিতে, সে রাজনীতির সামনা সামনি জবাব না দিয়ে আম আদমি পার্টি মেরুকরনের পরিবর্তে উন্নয়ন ও জনকল্যাণের দিকটি প্রধান বিষয় হিসেবে সামনে আনে। সাথে কেজরিওয়াল আর তার দলবল যে পারিবারিক মানুষ সেটিও ভোটারদের নজর এড়ায়নি, ভোটের পরিসংখ্যান তাই বলে, ৮ ফেব্রæয়ারি অনুষ্ঠিত দিল্লি বিধান সভা নির্বাচনে ৭০টির মধ্যে ৬২ আসন জিতে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসেছে আম আদমি পার্টি যদিও ২০১৫ সালের নির্বাচনে দলটি ৬৭টি আসন পেয়েছিল। দিল্লিতে এই মুহূর্তের জনপ্রিয় শ্লোগান অরবিন্দ কেজরিওয়াল জিন্দবাদ, ঘৃনা ও বিদ্বেষের রাজনীতি মুর্দাবাদ, এ সেøাগানের জন্ম দিল্লি নির্বাচনের ভোটের ফল প্রকাশের পর।
তৃতীয়বারের মতো মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত করায় দিল্লির জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে গিয়েও বিনয়বনত ছিলেন কেজরিওয়াল। তার প্রমাণ মেলে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে তার দেয়া বক্তৃতা। তিনি বলেন, নির্বাচনী প্রচারের সময় রাজনীতি হয়েই থাকে এবারো হয়েছে। যারা আমার বিরুদ্ধে অসত্য কথা বলেছেন, আমি তাদের ক্ষমা করে দিয়েছি। আপনাদের অনুরোধ করছি, আপনারাও সব নেতিবাচক জিনিস ভুলে যান দিল্লিকে এগিয়ে নিতে আমাদের সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে।
নিজের দুই মেয়াদে দিল্লির ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন, অথচ তার জন্য কোনো প্রশংসা নিতে রাজি নন তিনি। সবাই বলছেন কেজরিওয়াল সব কিছু যিনি পয়সায় দিচ্ছেন। জগতের সব ভালো জিনিসই তে ফ্রি, আমি দিল্লির মানুষকে ভালবাসি, এই ভালবাসাও অমূল্য, আমি কি এখন শিক্ষার্থীদের থেকে টাকা নেয়া শুরু করব ? রোগীদের থেকে হাসপাতাল খরচ বাবদ টাকা নেয়া শুরু করব? এটা হবে লজ্জাজনক কাজ তিনি বলেছেন, নির্বাচন এখন শেষ, আপনারা কাকে ভোট দিয়েছেন, সেটি আমার কাছে কোনো বিষয় নয়। আপনারা এখন সবাই আমার পরিবারের সদস্য। আমি বিজেপি-কংগ্রেসের ভোটারদেরও মুখ্যমন্ত্রী।
তবে আড়াই বছর আগে কেজরিওয়াল কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সেই যে বিবাদ থামালেন, দ্বিতীয়বার আর সে পথ মাড়াননি। সচেষ্ট হলেন সাধারণ ও নিম্নবিত্তদের ন্যূনতম নাগরিক পরিষেবাগুলো পৌঁছে দিতে বিনা পয়সায় মাসে ২০০ ইউনিট বিদ্যুত ও ২০ হাজার লিটার পানি দেয়া শুরু করলেন। স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে গেলেন প্রতি মহল্লায়। সরকারি পরিষেবাকে দালালমুক্ত করে প্রশাসনকে জনমুখি করতে কর্মসূচি হাতে নিলেন। বিনা টিকিটে নারীদের সরকারি বাসে ভ্রমণের ব্যবস্থা করলেন, সুরক্ষার জন্য বাসে বাসে নিযুক্ত করলেন রক্ষী, ফলে গণমানুষ আম-আদমিকে নিজেদের দল বলে মনে করতে লাগল। রাজনৈতিক নেতার সাথে জনতার দূরত্ব ঘুচিয়ে আনতে প্রানপণ চেষ্টার কসুর করলেন না। দিল্লিবাসী মনে করতে লাগল, এটি তাদেরই দল।
নির্বাচনী প্রচারণায় মাঝপথে বিজেপি উন্নয়নের রাজনীতি ছেড়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে আকড়ে ধরে। আর কেজরিওয়ালের নির্বাচনী কৌশল ছিল নাগরিক পরিষেবার সম্প্রসারণ , প্রচারের আগাগোড়া লক্ষ কররে দেখা যাবে, কেজরিওয়ালরা একবারের জন্যও জাতীয় ইস্যু সিএন, এনআরসি অথবা ৩৭০ অনুচ্ছেদ মুখে আননি। জেএনইউ, জামিয়া মিলিয়া বা শাহিন বাগের আন্দোলনের কথাও উচ্চারণ করেননি। দেশপ্রেম বা দেশদ্রোহ নিয়ে মাথা ঘামাননি সারাক্ষণ শুধু বলে গেছেন বিদ্যুৎ-পানি-সড়ক-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো নাগরিক পরিষেবার কথা এর পাল্টা মোদি-অমিত শাহ এবং তাদের অনুগামীদের কন্ঠে বেজেছে উগ্র জাতীয়তাবাদের সুর, ভোটের ফল প্রকাশের পর দেখা গেল, বিজেপির হিন্দু জাতীয়তাবাদ জাতপাত ও ধর্মীয় বিভাজন দিল্লি নির্বাচনে কোনো কাজে আসেনি, মাঠে মার খেয়েছে।
ক্ষমতা দখলের জন্য প্রচারের বিজেপির নেতারা যেভাবে কথার বিষবাষ্প ছড়িয়েছেন, যেভাবে হিংসা ছড়াতে প্ররোচণা জুগিয়েছেন, ঘৃনার আগুণে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত করেছেন, শিক্ষিতজন ও সাধারণ ভোটার তাতে বিরক্ত হয়েছেন। এই মানুষেরই কিন্তু আট মাস আগে লোকসভা ভোটে নরেন্দ্র মোদিকে সমর্থন করেছিলেন। তারা দেখেছেন বিজেপির হাইপার ন্যাশনালিজাম এর বিপরীতে দাড়িয়ে কেজরিওয়াল ঘরের ছেলের মতো হাসিমুখে পরিষেবার জনগণের জীবন ঘনিষ্ট সমস্যার কথা বলেছেন। প্রতিপক্ষের কটূকথা গায়ে না মেখে উপেক্ষা করছেন ভারতীয় রাজনীতিতে যা বহু দিন ধরে অনুপস্থিত। সেই বিনয় ও শালীনতার প্রত্যাবর্তন দিল্লির আম আদমি সাদরে গ্রহণ করেছে। কেজরিওয়ারের প্রচার ঘৃনা ও বিদ্বেষ বিবর্জিত ছিল। এছাড়া মুখ্যমন্ত্রী হয়েও কেজরিওয়াল সেই আগের সাদাসিধে জীবনেরই অভ্যস্ত একটুও বদলাননি। ক্ষমতায় থাকার পরও তার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ ওঠেনি। ভারতের রাজনীতিতে এই ভাবমর্যাদা, সাম্প্রতিক সময়ে বিরল। এটাও কেজরিওয়ালের জন্য ছিল প্লাস পয়েন্ট। শীতকালে সোয়েটআর মাফলার, গরমকালে বুশ শার্ট ও চটি জুতায় তিনি যেন পাশের বাড়ির ছেলে। যার বাড়িতে অনায়াসে কড়া নেড়ে ঢুকে পড়া যায়। যাকে ভালবাসা যায়, অতি আপন ভাবা যায় এবং ভরসা করা যায়।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট