ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের শিক্ষা

97

আজ ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস, এদিন ভারতে সাংবিধানিক শাসনের সূচনা হয়। ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের রাষ্ট্রপতি পদে প্রথম মেয়াদও ধরা হয় ২৬ জানুয়ারি থেকে। এর পূর্বে ১৫ আগস্ট ৪৭ ভারতের স্বাধীনতা লাভের দিন থেকে সংবিধান বলবৎ হওয়ার পূর্বদিন ২৫ জানুয়ারি ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ভারত সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের শাসনাধীনে ছিলো। যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের ৪৭ সালের ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট অনুযায়ী নিখিল ভারতকে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের দুটি স্বাধীন ডোমিনিয়নে বিভক্ত করা হয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করে অর্থাৎ ব্রিটিশ রাজের পরাধীনতা থেকে ভারত মুক্তি লাভ করেছিলো। কিন্তু স্ব-শাসনের জন্য কোন সংবিধান তখনো ভারতের ছিলো না। ইংল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ জর্জকে সাংবিধানিক রাজা এবং লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে গভর্নর জেনারেল মেনে স্বাধীন ভারতের যাত্রা শুরু হয়। মাউন্টব্যাটেন ছিলেন ভারতের শেষ ভাইসরয়। ভারতের সংবিধান প্রণয়নের জন্য ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা লাভের ১৩ দিন পর ২৮ আগস্ট ড. বি.আর আম্বেদকরের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ঐ কমিটি দু’ মাসের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন করে ৪৭ সালের ৪ নভেম্বর কনষ্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলিতে পেশ করে। ১৬৬ দিন আলোচনা পর্যালোচনা এবং প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরিমার্জনের পর এসেম্বলির ৩০৮ জন সদস্য ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি হাতে লেখা সংবিধানের দুটি কপিতে (একটি হিন্দি ও একটি ইংরেজি) স্বাক্ষর প্রদান করেন। দু’দিন পর ২৬ জানুয়ারি ১৯৫০ সালে সারাদেশে উক্ত সংবিধান বলবৎ হয়। সেই থেকে প্রতি বছর ভারত ২৬ জানুয়ারিকে প্রজাতন্ত্র দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।
ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের মধ্যে যে নিগূঢ়-ব্যঞ্জনা ও সুগভীর তাৎপর্য নিহিত আছে, তা এবার আলোচনা করা যেতে পারে। পাকিস্তান ও ভারত একই সময়ে দুটি দেশই স্বাধীন হয়। ভারতের রাষ্ট্র্রনেতারা আড়াই বছরের মধ্যে দেশকে একটি সংবিধান উপহার দিতে পারলেও পাকিস্তানে সেই সংবিধান প্রণয়ন করতে লেগে যায় প্রায় দশ বছর। পাকিস্তান ১৪ আগস্ট ৪৭ স্বাধীনতা লাভ করে। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। কিন্তু পাকিস্তানের কনষ্টিটিউয়েন্ট এসেম্বলি সংবিধান প্রণয়নে এক ধাপও অগ্রসর হতে পারেনি। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে সংখ্যালঘু আওয়ামী লীগ সরকারই ৫৭ সালে পাকিস্তানকে একটি সংবিধান উপহার দেয়। কিন্তু সেই সংবিধান কার্যকর হবার পূর্বেই পাকিস্তানি জেনারেলরা সামরিক আইন জারি করে সাংবিধানিক পথে পাকিস্তানের চলার গতি থামিয়ে দেয়। ৫৮ সালে গণতন্ত্রকে হত্যা করে পাকিস্তানে সামরিক শাসন প্রবর্তিত হয়। ৬২ সালে সেনা শাসক আইয়ুব খান দেশকে একটি উদ্ভট সংবিধান দেন। যার মাধ্যমে বেসিক ডেমোক্রেসি নামক এক আজব গণতন্ত্র তিনি চালু করেন, যার নির্বাচকমন্ডলী ছিলেন ৮০ হাজার ‘ফেরেশতা’ বা বিডি। ৭০ সালে পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মত এক ব্যক্তি এক ভোটের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরংকুশ বিজয় অর্জন করলে পাকিস্তানে আবার একটি সংবিধান রচনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিলো। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পার্লামেন্টের অধিবেশন ডেকে তা আবার স্থগিত করে গণতন্ত্র প্রবর্তন ও পাকিস্তানকে রক্ষার শেষ সুযোগ নিজেই নষ্ট করে দেন। ইয়াহিয়া গণহত্যার পথ বেছে নিলে বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ও তাঁর আহবানে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং পাকিস্তানের ধ্বংসস্তুপের ওপর বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
আমরা দেখলাম পাকিস্তান ও ভারত একই সময়ে দুটি দেশ স্বাধীন হলেও ভারত গণতান্ত্রিক পথে যাত্রা শুরু করে অদ্যাবধি অখÐ শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে টিকে আছে। একটি দিনের জন্যও ভারতে গণতন্ত্র বিপন্ন হয়নি, সামরিক বাহিনী কখনো রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেনি। এটাই গণতন্ত্রের মহিমা ভারতীয় প্রজাতন্ত্র দিবসের মূল তাৎপর্য এখানেই। ভারত যে আজ বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ, তার উৎস ঐ প্রজাতন্ত্র দিবস। গণতন্ত্রই ভারতের অন্তর্নিহিত শক্তি, যা ভারতকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে চলার প্রেরণা যোগাচ্ছে।
অন্যদিকে পাকিস্তান সংবিধান প্রণয়ন না করায় গণতন্ত্রের চর্চা করতে পারেনি। ফলে অগণতান্ত্রিক শক্তি বারবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে এবং গণতন্ত্রের টুটি টিপে ধরেছে। পাকিস্তান ভেস্তে খান খান হয়ে গেছে।
বাংলাদেশেও বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফিরে ৭০-এর নির্বাচনে নির্বাচিত জাতীয় ও প্রদেশিক পরিষদের সদস্যদেরকে নিয়ে গণপরিষদ গঠন করে অত্যল্পকালের মধ্যে পৃথিবীর অন্যতম একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক সংবিধান বাঙালি জাতিকে উপহার দেন। যে সংবিধানকে বিভিন্ন সেনা ও স্বৈরশাসকে কাটাছেঁড়া করলে যার মৌল সত্তা অটুট রয়েগেছে এবং যা অন্তর্নিহিত গণতান্ত্রিক শক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বারবার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।
শেষ কথা : ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি এবার প্রজাতন্ত্র দিবসে ভারতের সর্বোচ্চ সম্মান ‘ভারত রতœ’ পাচ্ছেন শুনে বাঙালি হিসেবে গর্ববোধ করছি। তিনি ছাড়া মরণোত্তর ‘ভারত রতœ’ সম্মান পাচ্ছেন ভূপেন হাজারিকা (সঙ্গীত) এবং নানাজি দেশমুখ(গ্রামোন্নয়ন)।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক