ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইন নিয়ে কিছু কথা

118

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্ত দিয়ে সম্প্রতি ভারতের পুশইন করা মোট ২৩৬ পাসপোর্টবিহীন বাংলা ভাষাভাষীকে আটক করেছে। আটককৃতদের মধ্যে নারী শিশুও রয়েছে। তারা বলেছেন, পুশইন করার জন্য আরো বহু মানুষকে জড়ো করা হয়েছে। এদের বেশির ভাগই ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের ব্যাঙ্গালুরু শহরের বাসিন্দা। তারা জানান, তারা ব্যাঙ্গালুরু শহরে বিভিন্ন কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাদের ভাষ্য মতে, ভারত সরকার বাংলাদেশী বিতাড়নের ঘোষণা দেয়ার পর থেকে সরকারের লোকজন এসে আমাদের বলেছেন, ‘আমরা বাংলাদেশী মুসলমান। এদেশে তোমাদের কাজ করতে দেয়া হবে না। তোমরা দেশে চলে যাও’। এ ছাড়া এনআরসি আতঙ্কে অনেকেই ভারত থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষআয় আছেন। কারণ কর্ণাটকে এনআরসি চালুর সিদ্ধান্তের পর এসব গরিব তাদের কোনো ধরনের দলিলপুত্র না থাকায় প্রশাসনিক নির্যাতনের ভয়ে পালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বেশ কয়েকদিন আগে ভারত সরকার ব্যাঙ্গালুরু শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে ৫৯ জনকে রেলে কলকাতায় নিয়ে আসে। তাদের পরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে তুলে দেয়ার কথা থাকলেও স্থানীয় মানবাধিকার কর্মীদের বিক্ষোভের কারণে আপাতত তা স্থগিত রেখেছে।
এ ব্যাপারে মানবাধিকার সংস্থা এসোসিয়েশন ফর প্রটকশন অব ডেমোক্রেটিক রাইটসের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নিশা বিশ্বাস বলেন, ‘এরা বাংলাদেশ বা ভারতের নাগরিক তা নির্ধারিত হয়নি। তা হলে কেন তাদের ভোরে বাংলাদেশে পাঠানো হবে? যদি এরা বাংলাদেশের নাগরিকও হন, তবে কেন আইনি প্রক্রিয়ায় আদালতের মাধ্যমে তাদের বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে না? অতপর পাঠানো বেআইনি। (দৈনিক প্রথম আলো, ২৫ নভেম্বর ২০১৯)।
এই পুশইন বা সীমান্ত পেরিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের ঢল আসলে কি এনআরসি’র প্রভাব। অন্য কোনো কারণ তো আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। তবে ভারত সরকার বারবার বলছেন, এটি ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয় এবং এ ব্যাপারে বাংলাদেশের উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। এগুলো বলে ভারত কি শুধু বাংলাদেশকে আশ্বাসই দিয়ে যাচ্ছে না আসল ব্যাপার অন্যকিছু। কিন্তু এসব আশ্বাসবাণী বাংলাদেশের মানুষ শুনতে শুনতে এখন কেমন জানি আর আশ্বস্ত হতে পারছে না। কারণ ২০১১ সালে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশে এসে শেষ মুহূর্তে তিস্তা চুক্তি না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন যে শিগগিরই এই চুক্তি সম্পাািদত হবে। অথচ ওই সফরের সময় তিস্তা চুক্তির খসড়াও চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ‘শিগগিরর’ই আজ দীর্ঘ আট বছর পরও আসেনি। এর আগে পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা বাঁধ চালুর কথা বলে তা বন্ধ হয়নি বরং বাংলাদেশকে চুক্তিবদ্ধ হতে হয়েছে। অন্যদিকে সীমান্তে বারবার নিরীহ বাংলাদেশী হত্যা না করার আশ্বাস দিয়েও প্রায়ই চালানো হচ্ছে এই হত্যাকাÐ। ফেলানী হত্যার বিচারের আশ্বাস দিয়েও সেই বিচারের নামে প্রহসন করা হয়েছে।
সর্বশেষ ‘এনআরসি’ নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন না হওয়ার আশ্বাস দিলেও এখন আমরা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে চলেছি। বেশ গত কয়েকদিনে প্রায় আড়াইশ মানুষ সীমান্ত পেড়িয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের ঘটনা দৃশ্যমান করে তুলেছে। এনআরসি’র মন্দ প্রভাব। এমনকি ভারত কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী পি চিদম্বরম বলেছেন, If Bangladesh has been assured that NRC process will hot affect Bangladesh, how will The Indian state decal will the 19 (nineteen) lakh fersons (NDTV.com PTI. 5 Oct. 2019)। এনআরসি বা জাতীয় নাগরিকপঞ্জি হলো একটি তালিকা যাতে অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে ভারতে প্রবেশ করেছেন বলে প্রমাণ রয়েছে। ভারতে প্রথম এনআরসি প্রস্তুত করা হয়েছিল ১৯৫১ সালে। ভারতীয় সংবিধানের ৬ নম্বর ধারা মোতাবেক যারা ১৯৪৮ সালের ১৯ জুলাইয়ের পর ভারত এসেছেন তাদের অবশ্যই নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হবে। কিন্তু আসাম রাজ্যে বেলায় এই ধারায় একটু ব্যতিক্রম রয়েছে। সেখানে ১৯৪৭ সাল থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার আগের দিন অর্থাৎ ২৫ মার্চ ১৯৭১ তারিখ পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়ে এর পরে ভারতে প্রবেশকারীদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এভাবে আসাম রাজ্যে বাংলাদেশ থেকে প্রায় চার থেকে ১০ লাখ মুসলমানের অনুপ্রবেশের অভিযোগ তোলা হয়। এসব অনুপ্রবেশকারীরা আসামের স্থানীয় ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম ও রাজনীতির প্রতি বিরাট হুমকি সৃষ্টি করছে বলে একটি নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়েছে। এতে আসামে অনুপ্রবেশকারী হঠাও আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। ফলে শুধু আসাম রাজ্যের জন্য নাগরিকত্ব আইন সংশোধন ১৯৫১ সালে এনআরসিভুক্ত এবং ১৯৭১ সালের ভোটার লিস্টভুক্ত নাগরিকদের সরাসরি উত্তর পুরুষদের নাগরিকত্ব দেয়ার সুযোগ রাখা হয়। কারণ অভিবাসনবিরোধী আন্দোলনের ফলে ১৯৮৫ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার ও দীর্ঘ ছয় বছর ব্যাপী আন্দোলনকারীদের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় অসমচুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে আসাম থেকে অবৈধ বাংলাদেশীদর বিতাড়নের সিদ্ধান্ত হয়। পরে ২০১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট এনআরসি তৈরির জন্য আদেশ জারি করেন। ফলে ৩১ আগস্ট ২০১৯ তারিখে সর্বশেষ এনআরসি ২০১৯ প্রকাশিত হয়। যাতে প্রায় ১৯ লাখ নাগরিক রাষ্ট্রবিহীন হয়ে পড়ে।
রাজ্য সরকার জানিয়েছেন এই এনআরসি প্রক্রিয়াটি করা হয়েছে অবৈধ বাংরাদেশী অভিবাসীদেরকে চিহ্নিত করতে। তবে খোদ ভারতেই এই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ উচ্চারিত হচ্ছে। বিরোধী মত পোষণকারীদের অনেকেই বলেছেন, এই এনআরসির আড়ালে ভারতের গরিব মুসলমানদের ভারতীয় নাগরিকত্ব বাতিলের বন্দোবস্ত করা হচ্ছে। ৩ অক্টোবর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলেছেন, এই এনআরসি’র অভিজ্ঞতা পুরো ভারতে প্রয়োগ করা হবে এবং সব অবৈধ অভিবাসীকে ভারত থেকে বিতাড়িত করা হবে। একই সাথে তিনি এও বলেছেন, কোনো হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান অভিবাসীকে ভারত থেকে বের করে দেয়া হবে না। তদুপরি চলতি সংসদ অধিবেশনে নাগরিকত্ব সংশোধন বিল ২০১৯ (ঈঅই-১৯) আনা হবে যেন বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে চলে আসা হিন্দু, জৈন, খ্রিস্টান, শিখ ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের নাগরিকত্ব দেয়া যায়। ইতিমধ্যে এই বিল ভারতের লোকসভা এবং রাজ্যসভায় পাসের পর সে দেশের রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরের পর তা আইনে রূপান্তরিত হয়েছে। যা নিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে তীব্র বিক্ষোভ চ্ছে। অনেক জায়গায় পরিস্থিতি সামাল দিতে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। ভারত সরকার, বিজেপি নেতৃবৃন্দ এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে সব বক্তব্য জনসমক্ষে দিচ্ছেন তাতে স্পষ্ট বোঝা যেন এনআরসি বা এ সংক্রান্ত কার্যক্রম চালানোর মূল এবং একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়। ভারতের এ ধরনের ধর্মবিত্তিক নাগরিকত্ব অনুমোদনের বিষয়টি ভারতের সংবিধানের মৌলিক চেতনার পরিপন্থি।
ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ নীতির পিঠে ছুরিকাঘাতের শামিল। ভারতের সাম্প্রতিক বিষয়গুলোর ওপর আলোকপাত করলে মনে হচ্ছে ভারতে সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদ রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্টপোষকতা পাচ্ছে যা নাকি ভারতের ৭০ বছরের ধর্মনিরপেক্ষতা ভিত্তিক রাষ্ট্রাচারের ঐতিহ্য এবং সাংবিধানিক বস্তুনিষ্টতার ধারাবাহিকতা বিনষ্ট করছে। এ অবস্থা কোনোভাবেই ভারতের গণতন্ত্র, ভারতের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা তথা উপমহাদেশের আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য ইতিবাচক হতে পারে না।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্টকাজি রশিদ উদ্দিন