ভারতীয় ঐক্যের স্থায়িত্বের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার বিকল্প নেই

45

ভারতের স্বাধীনতার আগে স্বাধীনতার অন্যতম স্থপতি এবং ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট হিসাবে একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন, তাঁর সে বক্তৃতাটি বিশ্বের সেরা বক্তৃতাগুলির অন্যতম হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। সে বক্তৃতায় তিনি ভারতীয় সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে ‘অসাম্যতা’ (ওহবয়ঁধষরঃু) সম্পর্কে আলোকপাত করেছিলেন। তিনি সে বক্তৃতায় বলেছিলেন, India failed in evolving a stable society and because she failed in this, she fell and remains fallen. No solution was found for the problem of equality. India deliberately ignored this and built up her social structure on in-equality and we have tragic consequences of this policy in the millions of our people who till yesterday were suppressed and had little opportunity for growth…. when Europe fought her wars of religion and Christians massacred each other, India was tolerant, although ala, there is little of this toleration to-day..” অর্থাৎ ‘ভারত একটি স্থিতিশীল সমাজ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে এবং যেহেতু ভারত ইহাতে ব্যর্থ হয়েছে, সে জন্যে তার পতন হয়েছে এবং পতন অব্যাহত রয়েছে। সমতার যে সমস্যা তার কোন সমাধান পাওয়া যায় নাই। ভারত ইচ্ছাকৃতভাবে সমতার সমস্যাকে অবজ্ঞা করেছে এবং অসাম্যের ভিত্তিতেই ভারতীয় সমাজ গড়ে তুলছে এবং আজকে এই নীতির ভয়াবহ পরিণতি স্বরূপ আমাদের লক্ষ লক্ষ লোক নীপিড়িত হচ্ছে এবং তারা সমৃদ্ধির কোন সুযোগ পাচ্ছে না…. ইউরোপে যখন ধর্মযুদ্ধ চলছিল খৃষ্টানেরা একে অপরকে নির্দয়ভাবে হত্যা করেছিল। এব্যাপারে ভারত যদিও কিছুটা ধৈর্যশীল ছিল কিন্তু পরিতাপের বিষয় আজকাল সেই সহ্যশক্তি আর অবশিষ্ট নেই।’
যদিও ব্রিটিশ সরকার ধর্মের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারতকে বিভক্ত করে পাকিস্তানের সৃষ্টি করেছিল কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতীয় সব স্থপতিদের নিয়ে কংগ্রেস হাই কমান্ড স্বাধীন ভারতকে ধর্মীয় গোঁড়ামীর ঊর্ধ্বে রাখার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। ভারতের শাসনতন্ত্রের মুখবন্ধে ভারতীয় স্বাধীনতার সব স্থপতিরা একমত হয়ে ভারতকে ধর্ম নিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক রিপাবলিক হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। কারণ তাঁরা সবাই একমত ছিলেন যে আদিকাল থেকে ভারতবর্ষে বিভিন্ন জাতির লোক এসে স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছে এবং সবাই সমভাবে ভারতকে ভালবেসেছে। বিশ্বের আর কোন দেশে এই চিত্র দেখা যায় না। সে জন্য তদানীন্তন ভারতের মনীষীরা প্রায় একমত ছিলেন যে ধর্মের ভিত্তিতে কোন রাষ্ট্রই ভারতবর্ষে স্থায়ী হবেনা। পাকিস্তান ধর্মের ভিত্তিতে ভারতবর্ষে বিভক্ত করে সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু সেদেশের স্থায়িত্ব তিন দশকও পার হয় নাই। পাকিস্তান দ্বিধা বিভক্ত হয়েছে।
যাই হউক ১৯৫৫ সালে সমাজতন্ত্রকেই মূল লক্ষ্য হিসাবে কংগ্রেস ঘোষণা করল। সে থেকে সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্য যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করতে হয় তা নিতে শুরু করা হলো। ভারতের সমস্ত ব্যাংক ব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করা হলো। মৌলিক শিল্প পাবলিক সেক্টরেই নিয়ে নেওয়া হল। এদিকে ১৯৮৯-৯০ সালে পূর্ব ইউরোপের সমস্ত সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির এবং সোভিয়েট ইউনিয়নের অর্থনীতিতে ধস নামল। শেষ পর্যন্ত সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙেই গেল। তখনই ভারতীয় অর্থনীতিতে এক মৌলিক পরিবর্তন আসল। সমাজতন্ত্রের পরিবর্তে মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগ এসে গেল এবং সাথে সাথে জাতীয়তাবাদ প্রচারের সুযোগও এসে গেল। ভারতে আর.এস.এস. জাতীয়বাদের আড়ালে উগ্র হিন্দুত্ববাদ প্রচার শুরু করল। ১৯৯২ ফলে ডিসেম্বর মাসে আর.এস.এস. এর নেতৃত্বে বাবরী মসজিদ ভেঙে দেওয়া হলো। ঐ ঘটনাই ‘সাম্প্রদায়িকতাকে’ নিবার্চনে জেতার একটি অস্ত্রে পরিণত করে দিল। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বিজেপি বাজপেয়ীর নেতৃত্বে ক্ষমতায় ছিল। ভারতের বড় ব্যবসায়ীরা বিজেপি’র মধ্যেই তাদের প্রকৃত মিত্র খুঁজে পেল। ফলে ২০১৪ সালে বিপুল ভোটে বি.জে.পি. মোদী-অমিত শাহের দলে পরিণত হলো। ঐ সময়ে সমস্ত রেকর্ড ভঙ্গ করে তরুণ সমাজে বেকারত্ব ৪৫% শতাংশে গিয়ে দাঁড়াল। ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ১২ হাজার ২১ জন কৃষক আত্মহত্যা করল। মহারাষ্ট্রের ত্রাণ ও পূনর্বাসন মন্ত্রী সুবাস দেশমুখ রাজ্য সভাকে এই তথ্য দিয়েছেন। বিপুল পরিমাণ ঋণের বোঝা, করপোরেট বাজার ব্যবস্থার উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে ঠিকতে না পারায় আত্মহত্যাই ভারতের কৃষকদের নিয়তি হয়ে দাড়িয়েছে। মন্ত্রী আরও জানান ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে মোট আরও ৬১০ জন কৃষক একই কারণে আত্মহত্যা করেছে। প্রতিক্ষেত্রে এই আত্মহত্যার কারণ ঋণের বোঝা। এর মধ্যেই মোদী সরকার হাজার এবং পাঁচ শত রুপির নোট বাতিল করে জনগণের অশেষ ভোগান্তি ঘটাল, গো-রক্ষার নামে মুসলমান এবং দলিত সম্প্রদায়ের শত শত মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হল। কিন্তু এত বড় বড় ব্যর্থতার পরও কোন্্্ মন্ত্রবলে ২০১৯ সালের নির্বাচনে আরও বিপুল জয়ের কৃতিত্ব নিয়ে বিজেপি তথা নরেন্দ্রমোদী এবং অমিত শাহের দল ক্ষমতায় ফিরে এলো তা গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য নরেন্দ্র মোদী নির্বাচন উত্তর এক সভায় এব্যাপারে কিছু ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি ঐ সভায় বলেছেন, নির্বাচনের অংকের হিসাব রসায়নের কাছে হেরে গেছে। এই রসায়ন হলো ধর্মীয় উন্মাদনাকে ব্যবহার করে মানুষ এই বিশ্বাস স্থাপন করা যে বিজেপি একমাত্র দল যে দলের কাছে তাদের ধর্ম বা হিন্দুত্ব ভারতের অন্য যেকোন দলের চেয়ে অধিকতর নিরাপদ। নরেন্দ্র মোদীর রসায়নের রহস্য এইখানেই নিহিত। মানুষের হৃদয়ের গভীরে যে সাম্প্রদায়িক মানসিকতার বীজ লুকানো রয়েছে বিজেপি তা দক্ষতা এবং বুদ্ধিমত্তার সহিত ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে। যেমন বিজেপি নাগরিক পঞ্জি করে বাংলাদেশি মুসলমানদের পশ্চিম বঙ্গ থেকে বিতাড়নের যে কর্মসূচি দিয়েছে তার উপর পশ্চিম বঙ্গের হিন্দু ভোটারেরা পূর্ণ আস্থা রেখেছে। ভারতের এই সাধারণ নির্বাচনে হিন্দু উগ্রবাদী দল আর.এস.এস. যেভাবে বিজেপির পক্ষ হয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছে তা অবিশ্বাস্য। নির্বাচনের পর আর.এস.এস. এর প্রধান মোহন ভগবত উদয়পুরে এক জনসভায় বলেছেন, ‘রামের কাজ করতেই হবে। আর সে কাজ হবেই। রামের কাজ তা নিজেদের কাজ।’
মনে হয় রামের কাজ শুরু হয়েছে। সম্প্রতি ঝাড়খন্ডে গণপিটুনিতে তাবরেজ আনসারী নামে এক মুসলিম তরুণ প্রাণ হারিয়েছে। প্রতিবাদে ভারতের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাহুল গান্ধী এই ঘটনাকে মানবতার কলঙ্ক বলে আখ্যায়িত করেছেন। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ষ্টেট ডিপার্টমেন্টের বার্ষিক প্রতিবেদনে ভারতের সংখ্যালঘুদের উপর হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের আক্রমণের একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। গত বছর (২০১৮) বহুবার উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে হামলার শিকার হয়েছেন সংখ্যালঘু মুসলমানেরা। গত ২১ই জুন ২০১৯ সালে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের বার্ষিক প্রতিবেদনে এমনটাই দাবি করা হয়েছে। ঐ প্রতিবেদনটি মার্কিন পর-রাষ্ট্র দফতর মার্কিন কংগ্রেসে পেশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০১৭ সালেও ভারতের নাগরিকদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা অব্যাহত ছিল। ভারতের মতো একটি বহু ধর্মবিশ্বাস ও বহুসংস্কৃতির দেশে এই ঘটনা প্রতিবৎসরই বেড়েই চলেছে। সুচতুরভাবে ধর্মের সঙ্গে ভারতীয় জাতীয়বাদকে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে।
হিন্দু জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী এবং তাদের বিভিন্ন সংগঠনগুলি অ-হিন্দু ও হিন্দু দলিতদের বিরুদ্ধে হিংসা ও হেনস্থার ঘটনা দিনের পর দিন বাড়িয়ে দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে ভারতীয় সরকার প্রায় সময়ই সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্বাধীনতা রক্ষা করতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। গো হত্যার নামে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ করছে, এর ফলে আহরহ প্রাণহানি ঘটছে। ধর্মীয় স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হওয়ার ঘটনা সবচেয়ে বেশি হচ্ছে ভারতের ১০টি রাজ্যে এর মধ্যে রয়েছে উত্তর প্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, বিহার, ছত্তীশগড়, গুজরাট, ওড়িষ্যা, কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও রাজস্থান। বর্তমান কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যুক্তরাষ্ট্রের উক্ত রিপোর্টটির বিরোধিতা করেছে। আজকাল ডিজিটাল যুগে ইহা অস্বীকার করে ভারত সরকার নিজেদের ভাবমুর্তি নষ্ট-করছে।
লেখক : কলামিস্ট