ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে তামাকের বিজ্ঞাপন বন্ধ করা জরুরি

92

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাপান ভ্রমণ ইতিহাস নিয়ে তারকা শিল্পী তাহসান খানের একটি অনুষ্ঠান সম্প্রতি দেশের একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছে, সাধারণ চোখে দেখলে ভালো লাগার মতো অনুষ্ঠান বটে। কিন্তু অভিযোগ আছে এর পিছনে রয়েছে জাপান টোব্যাকোর বিজ্ঞাপন। এটা গুরুতর এবং ন্যাক্কারজনক ব্যাপার। শেষপর্যন্ত তামাকজাত কোম্পানিগুলো বাঙালির আবেগ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ব্যবহার করছে তামাকের প্রমোশনাল বিজ্ঞাপনে। অভিযোগ হচ্ছে ‘প্রমোশনাল বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হয়েছে জাপান টোব্যাকোর (জেটিআই) ব্রান্ড কালার এবং স্লোগান ‘জাপানিজ কোয়ালিটি’। জাপান টোব্যাকো তাদের ব্রান্ড প্রমোশনের ক্ষেত্রে একই কালার এবং স্লোগান ব্যবহার করে থাকে।’ এই অভিযোগ একেবারে ফেলনা বলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই, বরং অভিযোগটি খতিয়ে দেখলে এর সত্যতা পাওয়া যায়। কোন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এমন প্রচারণা নজিরবিহীন এবং আইনের প্রতি সরাসরি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের সামিল। আর লজ্জাজনক বিষয় তামাক কোম্পানিগুলো নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তিত্বকে ব্যবহার করতে দি¦ধা করছে না।
ভারতের আরেকটি ঘটনা সম্প্রতি আলোড়ন তুলেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। বলিউড অভিনেতা অজয়দেবগনের প্রতি অভিযোগের আঙুল তুলেছেন রাজস্থানের ক্যান্সার আক্রান্ত ৪০ বছর বয়সী নানাক্রম। একসময়ে অজয়দেবগনের ভক্ত নানাক্রম অজয়ের তামাক বিজ্ঞাপনে অনুপ্রাণিত হয়ে তামাক গ্রহণ শুরু করে। কিন্তু ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পর ভূল ভাঙে তার। অবশ্য ততদিনে অনেকদেরি হয়েগেছে, নানারকমের প্রশ্ন অজয়ের কাছে “আপনি নিজে দৈনিক কতটুকু তামাক খান? তার অনুরোধ ভবিষ্যত প্রজন্মের স্বার্থে, জনস্বার্থে ও সমাজের স্বার্থে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন যেন আর না করেন। সচেতনতা বাড়াতে শহরের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুস্তিকা বিলি করে বেড়াচ্ছেন তিনি। উপরের দুটো ঘটনার মধ্যে একটা মিল আছে, দুটো ঘটনায় দু’জন তারকা শিল্পীর প্রতি অভিযোগ তামাকের বিজ্ঞাপন করার? তারকা শিল্পীদের এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ তাদের প্রতি সাধারণ মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে ভিন্ন পথে পরিচালিত করে। একজন তারকার দায়িত্বজ্ঞান প্রখর হওয়া উচিত, কারণ তাদের আচরণ সর্বসাধারণের জীবনে প্রভাব রাখে। এখানে একটা শিক্ষনীয় ব্যাপার আছে, বাংলাদেশের তারকা শিল্পীরা চাইলে নানাক্রম থেকে শিক্ষা নিতে পারে। নয়তো কোন একদিন এমন অভিযোগের আঙুল তাদের দিকেও উঠবে।
এখানে অবশ্য একটি বিষয় লক্ষণীয়, তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে এবং এর বিজ্ঞাপন বন্ধে আইন থাকা সত্তে¡ও কেন এর লাগাম টানা যাচ্ছে না? কিভাবে তারা এখনো বহালতবিয়তে নিজেদের ব্যবসা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করছেন। তবে কি বলা যায় তাদের হাত আইনের হাতের চেয়েও শক্তিশালী? তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারা (৫) ও তামাক নিয়ন্ত্রণ বিধিমালার ধারা-৩ অনুসারে কোনো তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন যেমন: কোনো বই, ম্যাগাজিন, লিফলেট, হ্যান্ডবিল, বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড, পোস্টার, ফিল্ম বা ভিডিও টেপসহ সব ধরণের তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করা দÐনীয় অপরাধ। আইন থাকা সত্তে¡ও শুধুমাত্র প্রয়োগের অভাবের সুযোগ নিচ্ছে তামাকজাত কোম্পানিগুলো। প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ স্থানেই তামাক পণ্যের বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে গ্রাহকদের তামাকপণ্য সেবনে আকৃষ্ট করতে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো কোম্পানি, জাপান টোবাকো (পূবের্র ঢাকা টোব্যাকোকোম্পানি) এবং আবুল খায়ের টোবাকো কোম্পানি কতৃর্ক বিজ্ঞাপন সংবলিত শোকেস, ফেস্টুন, চায়ের কাপ, ছাতা ইত্যাদি দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া টিভি, ফ্রিজ, ডিনার সেট, বাল্টি, মগ ইত্যাদি পুরস্কার ঘোষণা করে গত অক্টোবর থেকে প্রচারণা চালাচ্ছে আবুল খায়ের টোবাকো কোম্পানি। এর সত্যতা মিলেছে সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব থিয়েটার আর্টস (বিটা) (বিটা, ইলমা ও ক্যাব কনর্সোটিয়াম) পরিচালিত একটি জরিপ থেকে। এই জরিপ থেকে জানা যায় নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডে তামাকপণ্যের বিক্রয়কেন্দ্রে তামাকের বিজ্ঞাপন ও প্রমোশন পাওয়া গেছে ৮৪.৫০% এবং তামাকজাত পণ্যের প্রদর্শনী পাওয়া গেছে ৮৫.১০%। এরমধ্যে তামাক পণ্যের বিজ্ঞাপন ও প্রমোশনে পোস্টার/সাইনবোর্ড/স্টীকার/ব্যানার পাওয়া গেছে ৭৫.৮৬%, ডামি প্যাকেট ৬৩. ০৮%, তামাকপণ্য বিক্রয়ের বক্স ৫৫.৭৪%, কাঠামোর উপর ব্র্যান্ডের ছাপ ৪৪.৭৩%, ডিসকাউন্ট কুপন ৩.৩১%, ফ্লাইয়ার, লিফলেট, পেমপ্লেট পাওয়া গেছে ৩.০৮%। স্তরে স্তরে সাজানো তামাক পণ্য ৮৩.৩১%, তামাক পণ্যের ট্রে, টেবিল বা অন্যান্য উন্মুক্ত স্থানে প্রদর্শিত হচ্ছে ৪৯.৩৫%, পাওয়ার ওয়াল (লেনদেন কাউন্টারের দেয়ালের পিছনে প্রদর্শিত সারিবদ্ধ তামাক পণ্য) ৮.৩৯%, তামাক পণ্যের ঝুলন্ত প্রদর্শনী হচ্ছে ৬.১১% এবং আলোকিত প্রদর্শনীর পরিমাণ০.৭১%। অথচ আইনে স্পষ্ট বলা আছে, স্বল্পমূল্যে, জনসাধারণকে দেয়া বা এর প্রস্তাব করা, তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার বা তা ব্যবহার, উৎপাদন বাড়ানোর উদ্দেশ্যে কোনো পুরস্কার, বৃত্তি প্রদান বা কোনো অনুষ্ঠানের ব্যয়ভার বহন করা আইন বহির্ভূত এবং দÐনীয়।
অভিযোগ আছে তামাক কোম্পানিগুলো তাদের প্রচারণার জন্য বেছে নিচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চল। নগরে কিছু ক্ষেত্রে রয়েসয়ে বিজ্ঞাপন বা প্রচারণা চালালেও গ্রাম, পাহাড়ে অনেকটা প্রকাশ্যেই সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে তাদের প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। তামাকে উৎসাহ নয়, অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে সহজ সরল এসব মানুষকে তামাক চাষেও উদ্বুদ্ধ করছে কোম্পানিগুলো।
অন্যদিকে গানা, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া, ইরিত্রিযয়া এবং পানামা পৃথিবীতে তামাকসেবনের পরিমাণের দিকে থেকে সর্বনিম্ন। বিশ্বজুড়ে গড়ে ২২ শতাংশ মানুষ ধূমপান করলেও আফ্রিকায় প্রায় ১৪ শতাংশ মানুষ ধূমপান করে। এসব দেশের দিকে তাকালে দেখা যায় তামাকের বিজ্ঞাপন প্রচারে এসব দেশের কঠোর অবস্থান। সাথে সাথে তামাক গ্রহণকে একটি নেতিবাচক দিক হিসেবে বিবেচনা করা হয় এখানে। এসব দেশে তুলনায় বাংলাদেশের চিত্র সম্পূর্ণ উল্টো, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ধূমপান করা ১০ টি রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। বর্তমানে সারা বিশ্বে ১৫ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে ১১০কোটি ধূমপান করছে। এ ধূমপায়ীদের প্রায় ৮০ শতাংশ হল নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে। বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৪ কোটি ১৩ লাখ (৪৩.৩%) তামাক সেবন করে। পুরুষদের মধ্যে তামাক সেবনের হার ৫৮% এবং নারীদের মধ্যে ২৮.৭%। এবং এই হার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী ২৫ বছরে তামাকিজনিত কারণে বিশ্বে ২৫ কোটি শিশু-কিশোরের মৃত্যু হবে। বর্তমানে সারা বিশ্বে ১৫ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে ১১০কোটি ধূমপান করছে। এসব ভয়ংকর তথ্য উঠে এসেছে গ্লোবাল টোব্যাকো সার্ভে রিপোর্টে। আরো হতাশ হওয়ার মতো তথ্য হলো, ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ম্যাট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশন (আইএইচএমই) ২০১৩ গবেষণা অনুসারে তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লক্ষ ৬১ হাজার মানুষ অকালমৃত্যু বরণ করে। তামাকখাত থেকে সরকার যে পরিমাণ রাজস্ব পায় তামাক ব্যবহারের কারণে অসুস্থ রোগীর চিকিৎসায় সরকারকে স্বাস্থ্যখাতে তার দ্বিগুণ ব্যয় করতে হয়। আইন থাকলেও প্রয়োগের অভাব, কিংবা যৎসামান্য প্রয়োগ হলেও তা এতটাই সামান্য যে এতে রাঘববোয়াল কোম্পানি গুলোর কিছুই যায় আসেনা। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোকে কোন প্রকার জবাবদিহির মধ্যে যেতে হচ্ছেনা। বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো যেভাবে অভিনব কৌশলী ভূমিকা গ্রহণ করছে, সুদুরপ্রসারি চিন্তাভাবনা করছে সে অনুসারে আইনের প্রয়োগ কোন অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারছেনা।
শক্তিশালী আইন থাকার পরও মূলত বাস্তবায়নের অভাব এবং দুর্বল মনিটরিংয়ের কারণে তামাক পণ্যের প্রচার প্রচারণা বেড়েই চলেছে। তামাকের বিজ্ঞাপন সম্পূর্ণ বন্ধ করা গেলে তামাক সেবনের পরিমাণ অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। এক্ষেত্রে নিমোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।
পদক্ষেপ : জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ এর বিজ্ঞাপন প্রচারণা অথবা পৃষ্ঠপোষকতা সংক্রান্ত আইন বাস্তবায়নকে ত্বরান্বিত করতে হবে। বিক্রয় কেন্দ্রে তামাক পণ্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করতে হবে এবং ধোঁয়াবিহীন তামাক পণ্যের বিজ্ঞাপন, প্রচারণা ও পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধে শহরের পাশাপাশি গ্রামীণ এলাকাগুলোতেও মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে পৃষ্ঠপোষকতা নিষিদ্ধ করা হলেও তামাক কোম্পানিগেুলোকে সিএসআর কর্মসূচির মাধ্যমে সামাজিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের বৈধতা দেওয়া হয়েছে। ফলে তামাক কোম্পানিগুলো আইনের এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের প্রচারণামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তাই অবশ্যই তামাক কোম্পানির সকল সিএসআর কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। এছাড়া তামাক পণ্য বিক্রেতার জন্য আইন প্রতিপালনের শর্তসহ লাইন্সেস প্রথা প্রচলন করতে হবে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নের মোবাইল কোর্ট পরিচালনা বৃদ্ধি করা।
অবশেষে বলতে চাই ১৫ এপ্রিল বিটা(বিটা, ইলমা ও ক্যাব কনর্সোটিয়াম) আয়োজিত সাংস্কৃতিক প্রচারণার উদ্বোধন কার্যক্রমে চট্টগ্রামের সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের ঘোষণা অনুযায়ী চট্টগ্রামকে তামাকমুক্ত চট্টগ্রাম নগরী গড়ে তুলতে উপরোক্ত করণীয় কার্যক্রমগুলো গ্রহণ করার কোন বিকল্প নেই। এবং সেই সাথে সিটি মেয়র ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তামাকমুক্ত চট্টগ্রাম নগরী গড়তে একটি সমন্বিত উদ্যোগ গড়ে তুলতে হবে। না হয়, বিষাক্ত এই মরণ থাবায় ধুকে ধুকে মরবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।

লেখক : প্রাবন্ধিক