‘বোমা’ হয়ে উঠেছিল গ্যাস রিফিলের ক্যানেস্তারাগুলো

50

ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা মোড়ে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের একদিন পর ঘটনাস্থলে গিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছেন সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা, আর তাতে বেরিয়ে আসছে নতুন নতুন তথ্য। ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত দল বলছে, ঘটনাস্থলে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলোতে বিপুল পরিমাণ রাসায়নিকের মজুদের কারণেই আগুন ছড়িয়েছে দ্রুত, হয়েছে দীর্ঘস্থায়ী। আর সিটি করপোরেশনের তদন্ত দল জানিয়েছে, অনুমতি না থাকলেও ভবনগুলোতে রাসায়নিক ও বিভিন্ন দাহ্য সামগ্রীর গুদাম গড়ে তোলা হয়েছিল। ভবনগুলো বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি হয়নি, আগুন নেভানোর কোনো ব্যবস্থাও সেখানে ছিল না। খবর বিডিনিউজের
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, বুধবার রাতে একটি পিকআপের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর চুড়িহাট্টা মোড়ে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়। এরপর সেই আগুন প্রথমে রাস্তায় থাকা যানবাহন এবং পরে ঘটনাস্থলের পাঁচটি ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে সেই আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস, অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণ যায় অন্তত ৬৭ জনের।
শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেছিলেন, চুড়িহাট্টার অগ্নিকান্ড সিলিন্ডারের বিস্ফোরণেই হয়েছে, এর সঙ্গে রাসায়নিক গুদামের কোনো সম্পর্ক নেই। তবে শুক্রবার সকালে তদন্ত শুরু করার পর মন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত দলের সদস্যরা।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লে. কর্নেল এস এম জুলফিকার রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ভবনের ভেতরে গ্যাস লাইটার রিফিলের ক্যানেস্তারা ছিল। এটা নিজেই একটা দাহ্য পদার্থ। এছাড়া আরও অন্যান্য কেমিক্যাল ছিল। প্রত্যেকটা জিনিসই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করেছে। পারফিউমের বোতলে রিফিল করা হত এখানে। সেই বোতলগুলো ব্লাস্ট হয়ে বোমার মত কাজ করেছে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের বক্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জুলফিকার বলেন, অবশ্যই কেমিকেল ছিল। যা যা ছিল, সেগুলো সবই রাসায়নিক। তিনি এমন বক্তব্য কোন প্রেক্ষিতে দিয়েছেন তা আমার জানা নেই। তবে কেমিকেলের জন্যই আগুন নিয়ন্ত্রণে সময় লেগেছে বেশি।
ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (অপারেশন্স) দিলিপ কুমার ঘোষকে প্রধান করে গঠিত তিন সদস্যের এই তদন্ত কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
অগ্নিকান্ডে যে ভবনটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেই হাজী ওয়াহেদ মঞ্জিলের নিচতলায় ডজনখানেক দোকান, আর দোতলায় পারফিউম ও প্লাস্টিক সামগ্রীর গোডাউন ছিল। আশপাশের বিভিন্ন ভবনেও রাসায়নিক ও দাহ্য সামগ্রীর গুদাম বা দোকান ছিল।
ওয়াহেদ মঞ্জিলের নিচতলাতেই একসঙ্গে ২৪টি মৃতদেহ পাওয়া যায়, যার মধ্যে দুই বছরের শিশু ও নারীও ছিল। সিঁড়ি ঘরের ফ্লোরে দলা পাকানো অবস্থায় ছিল পোড়া লাশগুলো।
ঘটনাস্থল ঘুরে দেখার পর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তদন্ত দলের সদস্য বুয়েটের অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ওয়াহেদ মঞ্জিলের দোতলার পুরোটাতেই গোডাউন ছিল। প্রায় ১০ কাঠা জমির ওপর এই ভবন নির্মিত হলেও সিঁড়ির পরিমাণ যথেষ্ট ছিল না। আগুনের কোনো ইক্যুইপমেন্ট নাই, ভবনগুলো বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি হয়নি। অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়ত সিলিন্ডার বিস্ফোরণে, কিন্তু কেমিকেলের কারণেই আগুনটা এত ছড়িয়েছে।
এই তদন্ত কমিটির প্রধান প্রকৌশলী রেজাউল করিম বলেন, আগুনে যে পাঁচটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার মধ্যে তিনটি ভবন ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে বলে প্রাথমিকভাবে তারা মনে করছেন।
‘আবাসিক এলাকায় কেমিকেল গোডাউনের কোনো অনুমতি নেই। সরকারের নির্দেশনার পর নতুন করে লাইসেন্সও দেওয়া হয়নি। এ ঘটনায় কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের রিপোর্টের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মেয়র বলেছেন, যে কোনো মূল্যে সবাই মিলে এসব এলাকার কেমিকেল গোডাউন সরিয়ে নেওয়া হবে।’
এতদিন সরানো হয়নি কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছি। এবার যে কোনো মূল্যে সেগুলো সব সরিয়ে নেওয়া হবে।
অধ্যাপক মেহেদী আহমেদ আনসারী বলেন, ওয়াহেদ মঞ্জিলের গ্রাউন্ড ফ্লোর ও দোতলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তৃতীয় ও চতুর্থ তলার বিম ও কলামগুলো ততটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সে বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। এক সপ্তাহ পর জানা যাবে, ভবনটি আদৌ ব্যবহারের উপযোগী কি না।
তবে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলো রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউকের) অনুমোদিত কিনা, তা নিশ্চিত করে বলতে পারেননি রাজউকের অথরাইজড অফিসার মো. নুরুজ্জামান জহির। বৃহস্পতিবার সরকারি ছুটি থাকায় কাগজপত্র দেখা সম্ভব হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে তারা খোঁজ খবর নেবেন।
গায়ে গায়ে লাগিয়ে ভবন নির্মাণের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে জহির বলেন, ‘আপনাকে বুঝতে হবে এটা পুরান ঢাকা। এখানে অনেক আগে থেকেই ভবন তৈরি হচ্ছে। এ বিষয়ে রাজউক অনেকদিন ধরে কাজ করছে। তবে সবার আগে দরকার সচেতনতা।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত দল বেলা ১১টার দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার পর সাংবাদিকদের সামনে আসে।
কমিটির আহবায়ক ও মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, আমাদের তদন্ত কমিটির সকলে মতবিনিময় করেছি এবং এখানে সবকিছু দেখেছি। এখন আমরা তদন্ত কাজ শুরু করব। আমাদের প্রাথমিক কাজ হবে অগ্নিকান্ডের উৎস খুঁজে বের করা, কারণ খুঁজে বের করা। এবং ভবিষ্যৎ এ ধরনের দুর্ঘটনা যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে সরকারকে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণের পরামর্শ দেওয়া।
এ কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখবে কি না-এমন প্রশ্নে অতিরিক্ত সচিব বলেন, ‘অবশ্যই আলোর মুখ দেখবে তদন্ত প্রতিবেদন। আমরা এখানে এসেছি, সবার সাথে কথা বলছি।’
তদন্ত কমিটির সদস্য পুলিশের লালাবাগ জোনের উপ কমিশনার ইব্রাহিম খান সাংবাদিকদের বলেন, অগ্নিকান্ডের ঘটনায় আমরা পুলিশ বাদী হয়ে একটা মামলা করেছি। যেহেতু একটা মর্মান্তিক ঘটনা, আমরা তদন্ত করব। তদন্তে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আদালতের কাছে সুপারিশ করব।
এদিকে চুড়িহাট্টা মোড় থেকে পুড়ে যাওয়া গাড়িসহ অন্যান্য ধ্বংসস্তূপ সরাতে কাজ শুরু করেছে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ।