বোবায় ধরা

120

মাঝরাতে ঝুমার হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। চারিদিকে ঘোর অন্ধকার। বুকের ভেতর কোন অজানা আশংকায় শত চেষ্টার পরও তার চোখে ঘুম আসছে না। এমনিতেই তার রাতে একা থাকবার কোন অভ্যাস নেই। সবসময় দাদির সাথে এক খাটে ঘুমাতো সে। দাদির কাছ থেকে রোজ নতুন নতুন গল্প শুনতো। আজ সকালেই দাদি তার ছোট ফুপুদের বাড়িতে বেড়াতে গেছেন। সেই থেকে ঝুমার বুকের ভেতর এক অজানা ভয় লেগে আছে। সে মনে মনে দোভাবে- কাউকে একা পেলে নাকি ভূতেরা সরব হয়। তাহলে আজ আমার কী হবে? ওরা কী আমার কোন ক্ষতি করবে!
আবার ভাবে- শুনেছি ভূতেরা গায়ে পড়ে কারো সাথে লাগতে আসে না। কেউ তাদের রাগালে ওরাও রেগে ক্ষতি করতে আসে। ওরা কেন আমার ক্ষতি করবে? আমি তো ওদের পিছে লাগিনি।
এইসব ভাবনা থেকে সে চিন্তিত হয়ে পড়ে।
একবার ভাবে – যদি আম্মুকে বলি। তাহলে-। না, আম্মুকে বলা যাবে না। তাহলে আম্মু আমায় ভীরু ভাববেন। থাক, আজ একাই শোব।। এই ভেবে সন্ধ্যায় পড়তে বসে সে। তার মনে হচ্ছে আজ কেন জানি ঘড়ির কাটাও দ্রæত চলছে। সবকিছু কেমন যেন ব্যতিক্রম ব্যতিক্রম লাগছে। কিছুক্ষণ পড়তেই আটটা বেজে যায়। যা ওর কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হলো না। তারওপর তার বাবা প্রতিদিন বাসায় ফিরেন সন্ধ্যা সাতটার পর। আজ কেন যেন ছয়টায় বাবা বাসায়। সবসময় রাত নয়টার দিকে আম্মু খেতে ডাকেন। কিন্তু আজ আটটায় খাবার টেবিলের দিকে ডাকছেন।
আটটায় পড়া বন্ধ করে ঝুমা তার বাবা-মা’র সাথে বসে খাবার শেষ করে সে। এরপর সোজা নিজের রুমের দিকে চলে আসে। একটুপর তার মা এসে মশারীটা টাঙিয়ে বাতি নিভিয়ে দিয়ে চলে যান।
রুমের বাতি নেভানোর পর থেকে ঝুমার বুকের ভেতর ভয় জমতে শুরু করেছে।
এখন যদি কোন ভূত এসে আমায় মেরে ফেলে। শুনেছি ভূতে ধরলে নাকি চিৎকার করলেও পাশের কেউ শুনতে পায় না। তবে আমার কী হবে?
এসব ভাবতে ভাবতে মনে মনে দোয়া পড়তে শুরু করে সে। কম্বলের নিচে দোয়া পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে চোখ বন্ধ করে রাখে। মুহূর্তে মনে মনে স্বস্তি অনুভব করে সে। একসময় চোখের পাতা জোড়া যুক্ত হয়ে যায়।
হঠাৎ জানালার দিক থেকে একটা আওয়াজ আসে, ঝুমা! ও ঝুমা! একা একা কি করছো? এদিকে এসো।
ঝুমা ভয়ে আঁতকে ওঠে। এতো রাতে আবার কে ডাকতে পারে? ভয় ভয় চোখে কম্বলের ফাঁক দিয়ে জানালার দিকে তাকায়।
– হায় আল্লাহ! সে একি দেখছে- জানালা খোলা। জানালার ওপাশে একটা সাদা ছায়ার মতো কী যেনো নড়ছে। সাথে সাথেই তার মনে হলো- ওটা ভূত নাতো ?
মুহূর্তে ভয়ে তার গলা শুকিয়ে আসে। বুক ধড়ফড় করছে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি ভূতটা জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে যাবে।

বাইরে কেমন যেন একটা খসখস শব্দ হচ্ছে। তার মনে হচ্ছে কেউ যেন হেঁটে হেঁটে তার দিকেই আসছে। সে আবার কম্বলটা গায়ে মুড়িয়ে চোখ বন্ধ করে সমানে দোয়া পড়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ তার মোবাইলের কথা মনে হলো।
বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা হাত বাড়িয়ে নিজের কাছে নিতে তার খুব ভয় করছে। যদি ভূতে দেখে যায়!
এরিমধ্যে মোবাইলটা ক্রিং ক্রিং করে বেজে ওঠলো। ঝুমা প্রচন্ড ভয়ে আঁতকে ওঠে। মনে মনে ভাবে-
এতোরাতে আবার কে কল করলো? রাতে তো কখনও কেউ আমায় কল করে না। তবে আমার সাথে আজ এসব কী হচ্ছে! একবার আব্বু আম্মুকে জোর গলায় ডেকে সব খুলে বলতে ইচ্ছে করছে।
কিন্তু শত চেষ্টার পরও তার মুখ থেকে কোন কথা বের হচ্ছে না। তবে কি তাকে কোন বোবায় ধরেছে?

ঝুমার হঠাৎ মনে হয়- ভারী কোন কিছু তার গায়ের ওপর বসেছে। একটু নড়েচড়ে বসতে সে প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু তাতে কোন কাজ হচ্ছে না। ওদিকে বিশালাকার দৈত্যের মতো কেউ একজন তার দিকে এগিয়ে আসছে।
ঝুমা চোখ মেলে দেখে। অদ্ভুত কেউ তার দিকে এগিয়ে আসছে। কুৎসিত কোন আগন্তুক। পৃথিবীতে কোন মানুষ এতো লম্বা হতে পারে না। আগন্তুকের মাথায় এলোমেলো সাদা লম্বা চুল। চোখ দুটো খুবই ভয়ংকর লাগছে। চোখের ভেতর যেন আগুন জ্বলছে। দুটো দাঁত ঠোঁট হয়ে বাইরে চলে আসায় খুবই বিদখুটে দেখাচ্ছে। আগন্তুক যতই কাছে আসছে ততই ভয়ে তার হাত-পা জমে যাচ্ছে।
একসময় ঝুমার মনে হলো আগন্তুক তার শরীরের সাথে মিশে যাচ্ছে। শরীরের ভিতরে ধীরে ধীরে অস্থিরতা শুরু হয়ে গেছে।
আগন্তুক ঝুমার দিকে আগুন চোখে তাকিয়ে বলল,
– ঝুমা, শুয়ে আছো কেন? ওঠো, আমার সাথে চলো।
ঝুমা ক্ষীণ কন্ঠে বলল,
– কে তুমি? আর এতো রাতে আমিই বা কেন তোমার সাথে যাবো?
আগন্তুক গম্ভীর হয়ে বলল,
– ওহ্! এই কথা। তোমার সাহস তো দেখছি কম না। আমার মুখে মুখে কথা বল। চল আমার সাথে।
– না, আমি যাব না। আগে বল, তুৃমি কে?
– নিশ্চয় আমি তোমার পরিচিত কেউ নই।
– অপরিচিত কারোর সাথে আমি কোথাও যাই না। তোমার সাথেও না। তুমি চলে যাও। নইলে আমি চিৎকার করে আব্বু-আম্মুকে ডাকবো।

আগন্তুক হো হো করে হেসে ওঠে বলল,
– এইটুকু ছোট্টমেয়ে কী বলে? তোমার বাবা-মাকে এখন যতই ডাকো তাতে কোন কাজ হবে না। তারা তোমার কোন কথাই এখন শুনতে পাবে না। আমরা যখন কারো কাছে আসি তখন তারা অনেকটা বোবার মতো হয়ে যায়। তুমিও তাই হয়ে গেছো। যতই চিৎকার চেঁচামিচি করো কাজ হবে না। তোমার আওয়াজ তুমি ছাড়া আর দ্বিতীয় কেউ শুনবে না।
– তাহলে তুমি কি ভূত? আমায় মিছেমিছি ভয় দেখাচ্ছো কেন?
– আমার পরিচয় জানলে তুমি ভয় পাবে। আমি সত্যি সেরকম কিছু।
– তোমার নাম কি? তুমি কোথায় থাকো?
– আমি ভূতশ্রী। থাকি তোমাদের বাড়ির পিছনের পুকুরপাড়ের পুরনো তালগাছটায়।
– সেখানে তুমি কি একা থাকো?
– না, আমার সাথে আমার মা-বাবাও থাকেন।
– এতো রাতে আমার কাছে কেন এসেছো? তোমার ঠিকানায় চলে যাও।
– আমি একাকী চলে যেতে আসিনি। তোমাকে আমার সাথে নিতে এসেছি। আমাদেরকে কষ্ট দিয়ে তুমি কীভাবে সুখে ঘুমিয়ে থাকতে পারো?
– আমি তোমার কথার কিছুই বুঝতে পারিনি। আমি কীভাবে তোমাদের কষ্ট দিতে পারি?
– গতকাল বিকালবেলা বাড়ির পিছনে খেলতে গিয়ে তুমি মজা করার ছলে তালগাছটিতে বারবার ঢিল ছুঁড়েছিলে। তুমি জানো? তোমার ছোঁড়া সেই ঢিলে আমার মা রক্তাক্ত হয়েছেন। আমার মায়ের মাথা ফেটে গিয়েছে।
– কী বলছো!
– হ্যাঁ, আমি একদম ঠিক কথা বলছি। এখন চলো আমার সাথে। আমার অসুস্থ মাকে দেখে আসবে। তোমরা মানুষেরা কারো সুখের পথকে মসৃণ করতে পারো না। পারলে সেপথকে অমসৃণ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করো।
ভূতশ্রীর কথা শুনে ঝুমার মন খারাপ হয়ে যায়।
সে দুঃখ ভরা কন্ঠে বলল,
– ভূতশ্রী, আমায় ক্ষমা করো। তোমরা যে সেখানে থাকো তা তো আমরা জানতাম না। আমরা না জেনে ভুল করেছি। তোমার মায়ের জন্য আমার খুব খারাপ লাগছে। তুমি এখন চলে যাও। তোমাকে আমি কথা দিচ্ছি, আর কোনদিন আমরা তোমাদের বিরক্ত করবো না।
– না, আজ তোমাকে আমি নিয়েই যাব। আমি ব্যথা পেলে হয়তো মাফ করে দিতাম। আমার বৃদ্ধা মাকে তোমরা কষ্ট দিয়েছো। তোমাদের কোন ক্ষমা নেই।

এই কথা বলে ভূতশ্রী ঝুমাকে শক্ত করে ধরে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। বাঁচার জন্য ঝুমা প্রাণপণ চেষ্টা করছে। বাঁচাও! বাঁচাও!” বলে জোরে জোরে গোঙানির শব্দে চিৎকার করছে। কিন্তু কেউ তার ডাকে সাড়া দিচ্ছে না।
হঠাৎ ঝুমার ঘুম ভেঙে যায়। সে খাটের ওপর হাঁটু গেঁড়ে বসে জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে। প্রচন্ড টেনশনে তার কপাল থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরছে।
রুমের সবগুলো বাতি জ্বলছে। ক্লান্তদেহে ঘাঁড় ফিরিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে দেখলো। জানালাটা বন্ধই আছে। এরপর পড়ার টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখে তার মা বইপত্র সব গুছিয়ে রাখছেন।

ঝুমাকে জোরে জোরে শ্বাস নিতে দেখে মা তার কাছে এসে বললেন,
– কিরে এমন করছিস কেন? বাথরুমে যাবি।
– হ্যাঁ, মা, তুমি আবার কখন এলে?
– এই তো কিছুক্ষণ হলো। কেন কি হয়েছে? তোর কথাগুলো কেমন যেন লাগছে? মুখে বেজে বেজে আসছে।
– আসবে না! এতো জোরে জোরে চিৎকার করে ডেকেছি। আর এখন এসেছো? আর একটু হলে তো আমি মরেই যেতাম।
ঝুমার কথা শেষ হতে না হতেই মা উদ্বিগ্ন হয়ে ছুটে এসে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
– কী বলিস? এখানে কী কেউ এসেছিল?
– হ্যাঁ, মা। ইয়া বড় দৈত্যের মতো কেউ একজন এসে আমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছে।
– আমার মনে হয় তুই স্বপ্নে কোনকিছু দেখেছিস।
– না, মা ভূতটা আমাকে বলেছে, আমি নাকি গতকাল ওর মায়ের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছি। মা তা কী করে হতে পারে?

বাথরুম থেকে বের হয়ে ঝুমার বাবা বললেন,
– তুই কি কিছু জিজ্ঞেস করিসনি, মা?
– করেছি তো। সে বলল, গতকাল বিকালে সুমাদের সাথে খেলার সময় আমি আমাদের পুকুরপাড়ের তালগাছটায় ঢিল ছুঁড়েছিলাম। আর সেই ঢিল নাকি গিয়ে তার মায়ের মাথায় পড়ে। আর তার মায়ের মাথা ফেটে যায়। তাই সে রেগে গিয়ে আমার কাছে এসেছিল। আমি ওর কাছে ক্ষমাও চেয়েছি। কিন্তু সে আমার কোন কথাই শুনছিল না। আমায় ধরে নিয়ে যাচ্ছিল।
এই কথা বলে ঝুমা মায়ের বুকে মাথাটা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।