বৈশাখে চট্টগ্রাম : বলীখেলা আর মেলায় একাকার

150

বিশাল অম্বধি নীল দক্ষিণে পশ্চিমে বয়।
উত্তরেতে ফেণী নদী ফেনিল তরঙ্গময়।।
নভস্পর্শী শৈলমালা গরবে তুলিয়া শির।
পূরবে প্রাচীর সম দাঁড়ায়ে র’য়েছে স্থির।।
শঙ্খ কর্ণফুলী আদি ঢালিয়া রজত ধার।
তরঙ্গে ধাইছে রঙ্গে যথা বঙ্গ পারাবার।।
প্রচন্ড বাড়বানল জ্বলিতেছে দিবানিশি।
আদিনাথ, চন্দ্রনাথ, শম্ভুনাথ, তীর্থরাশি।।
শ্যামল শীতল কুঞ্জে গায় সদা পিকদল।
এই সে চট্টভূমি প্রকৃতির লীলাস্তল।।- (সংগৃহীত)
নদী পাহাড় সমুদ্র বেষ্টিত প্রাচ্যের অপার সৌন্দর্য্যরে লীলাভূমি চট্টগ্রাম। প্রকৃতি যাকে সাজিয়েছে নিজ সৌন্দর্যে। তাই সৃষ্টির আদিকাল থেকে এই পুণ্যভূমি দখলের চেষ্টায় বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই চট্টগ্রাম মগ, ফিরিঙ্গী, আরকান, মোগল, পুর্তগীজ, বৃটিশ শাসনে প্রতিনিয়ত যুদ্ধবিগ্রহ ঘাত প্রতিঘাত সংঘাতে লিপ্ত ছিল বিবধামন গোষ্ঠী তদুপরি জলোচ্ছ্বাস বন্যা, খরায়, প্রকৃতিক বিপর্যয় তাঁর মাঝে থেমে থাকেনি এই অঞলের সংস্কৃতির লোকধারা। চট্টগ্রামের মানুষ নিজস্ব স্বতন্ত্রবোধ নিয়ে তাদের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে পালন করেছে ঋতু বৈচিত্রের লোকধারা। বৈশাখী মেলা, চৈত্র সংক্রান্তি, অগ্রানে নবান্ন বছরব্যাপী গ্রামজুড়ে উৎসব আনন্দেরর ফল্গধারা বয়ে যেত। এত্তঅঞ্চলের প্রায় প্রতিটি গ্রামেই বৈশাখী মেলা ও লোক উৎসব বসত। মেলার পসরা সাজাতে সারা বছরব্যাপী পরিশ্রম করত কামার, কুমার, তাঁতি, হস্ত শিল্পী, গৃহস্থলী সাম্রগী, জাল, শীতল পাঠি, কৃষি সামগ্রী, মিষ্টি, দই, মুড়ি, মুড়কি বাঁশি, তাল পাতার সেপাই, মেয়েদের প্রসাধনী, মৌসুমী ফল নিয়ে মেলা আয়োজন হতো। দূরদুরান্ত থেকে মানুষ ছুটে আসত। সারাদিন বাদ্য বাজনা, বাঁশির সুর, নাগরদোলা, গরুর লড়াই, যাত্রা, আঞ্চলিক পল্লী গীতি, কবি গানের আসর রাত জেগে উপভোগ করে সকালের মহাআনন্দে বাড়ি ফেরা। চট্টগ্রামের উল্লেখযোগ্য মেলাসমূহ লাল দীঘি বলি খেলা আনোয়ারা এরশাদ আলী সরকার বলি খেলা, মক্কার খেলা, চকরিয়া ঘোড় দৌর, বাঁশখালীর চেচুরিয়া, আগ্রাবাদ জাম্বুরি মাঠ, কুয়াইশ বুড়িশ্চর, শাহাজাহান শাহ্ (রহ.) মেলা, মাইজভান্ডার মেলা, সীতাকুন্ড শিব চর্তুদর্শী, আদিনাথ মেলা, তাছাড়া মৌসুমী নৌকা বাইচ, ঘোর দৌড়, হা ডু ডু, দারিয়াবান্দা, চুয়া খেলা, তম্ব্রু খেলা, কাবাডি, সাঁতার, ধান কাটা ও রোপনে গাইনের গান, গাজির গান, জারি গান, হালদা ফাটা গান, ঈদ, পূজা-পার্বণে ড্রামা, নাটক, পুতি পাঠ, মনসা মঙ্গল, বৃদ্ধরা নাতি-নাতনি নিয়ে রাক্ষস বিহংগমা, ঠাকুরমার ঝুলি, কিচ্ছা কাহিনী পাঠ, ঘুড়ি উড়ানো, লাঠিম, হিন্দুদের চরক পূজা, ডাঙ্গুলি, গ্রামের মানুষের বছরব্যাপী আনন্দ ফূর্তির খোরাক জোগাত।
বিবাহ রীতিতে যৌতুকের প্রচলন ছিলনা। তানজাম, পালকি, নৌকা নিয়ে বরযাত্রী বাঁজি ফুটিয়ে রাতব্যাপী নির্ঘুম থেকে সকালে বৌ নিয়ে বাড়ি ফিরত। সমাজের লোকেরা নিজেরাই বিয়ের সমস্ত আয়োজন ও তদারকি করত। বিয়ের পূর্বে পান চল্লাহ আয়োজন থাকত। বিয়েতে হলা, পুথি পাঠ, হত। ঘাটা ধরা, পান বাতাসা, সুপারী আনা, জামাই পক্ষের উঠান খরচ বা কন্যা পক্ষের খাওয়া খরচ, বর পক্ষকে পরিশোধ করতে হত বাসন হিসেবে এক প্ল্যাটে(কুঞ্চা) চার জন বা পাঁচ জনের খাওয়ার ব্যবস্থা থাকত। সিল্মিচি বধনা দিয়ে হাত ধোয়ানো হত। তাছাড়া ভাদ্র মাসে কনে নাইওর সন্তান হলে খাদ্য ও দোলনা প্রেরণ, বিবাহোত্তর দুধ, কলা, আম, কাঁঠাল দেওয়া এখনো কিছু জায়গায় প্রচলন আছে।
গ্রামীন জনপদের প্রধান বাজার ছিল হাট। যা সপ্তাহে দু’দিন বসত। নদীর তীরে বটের ছায়ায় পসরা সাজাতো বেপারী প্রতিটি ঘর থেকে নিজ উৎপাদিত মাছ মুরগি, ডিম, চাউল, কলা, দুধ, দৈ, ফলমূল, তরীতরকারী নিয়ে মানুষ ক্রয়-বিক্রয় করত। যা বর্তমান সময়ে হাট প্রথা বিলুপ্ত হয়ে নিত্যদিন বাজার প্রথা চালু হয়েছে। গ্রামীন মেয়েদের পোশাক ছিল থামি, চুলি, পুরুষের লুঙ্গি কোর্তা, যাতায়ত ব্যবস্থা ছিল নদী বা হাঁটা পথ, কোথাও গরুর গাড়ি। প্রতিটি বাড়ি ছিল ‘‘একটি খামার একটি বাড়ি’’ তরিতরকারী ফলমূল, ধান, মাছ, হাঁস, মুরগী নিয়ে প্রতিটি পরিবার ছিল স্বয়ং সম্পূর্ণ জনসংখ্যার বৃদ্ধির চাপে মধ্য প্রাচ্য নগরের পুঁজির প্রবাহে মানুষকে করেছে অলস ইলেক্টিক মিডিয়া সংস্কৃতিকে করেছে কলুশিত নতুন প্রজন্মকে করেছে সংস্কৃতিকে বিচ্যুতি অরিকল্পিত গ্রহায়ণ নষ্ট হয়েছে কৃষি জমি। উঠতি পুঁজি সমাজকে করেছে বিভক্তি।
মেজবান তখন এত ব্যাপক ছিল না। সামন্ত পরিবারে সীমাবদ্ধ ছিল। প্রতি কোরবাণীর ঈদে সচ্ছল পরিবার মেজবানের ব্যবস্থা করত। মেয়েদের কান ফোঁরা, ছেলেদের সুন্নত, আনুষ্ঠানিকতা ছিল। তখন মানুষের অভাব ছিল না বিধায় মানুষ সংস্কৃতি উৎসব পার্বণে মেতে থাকত। প্রতিটি পরিবারে ছিল পার্শপরিক সহযোগিতা। মানুষের মাঝ সৌহার্দ্যের বন্ধন সামাজিম অনাচার কুটিলতা রোধ করত। গ্রামীণ শালিশি প্রথা নৈতিকতা রক্ষায় সহায়তা করত। রোগ শোকে ছিল বৈদ্য, ওজা ও কবিরাজী প্রথা। জটিল বৈদ্য হাট বসাত। যেখানে গাছা নেচে নেচে রোগ শোকের বয়ান দিত। তাছাড়া মৌলভীরা জ্বিন হাজিরা, তাবিজ, কবচ, ঝাড়ফুক থাকত। গরীব কৃষকের ছেলেমেয়ে টোল ও ফোরকানিয়া মাদ্রাসায় যেত। সামন্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি স্কুলে পড়ত। সকালে পান্তা ভাত সফরে গেলে ভাতের মৌচা, ধুপ পিঠা, ঝালা পিঠা, ছৈই পাকান, খৈই, মলা, মুড়ি,আম দুধ ভাত, কাঠাল ভাত, বৈচিত্র সাধের চাহিদা মিটাত। এখনো নাড়ির টানে মানুষ ঈদ পূজা পার্বণে গ্রামে যায়। পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে প্রজন্মান্তরে টিকে থাকুক গ্রামীন সংস্কৃতির ঐতিহ্যে। প্রজন্ম টিকে থাকুক আপন ঐতিহ্যে সমহিমে।