বৈশাখী মেলা : বাংলার মেলা

288

মেলা বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। মেলা মানেই আনন্দ। সারা দিন মজা করে ঘুরে বেড়ানো। ইচ্ছে মতো এটা-ওটা কেনা। বাঁশি বাজিয়ে, ধুলো উড়িয়ে দিনভর হাঁটাহাঁটি। তারপর ক্লান্ত দেহে ঘরে ফেরা। মেলায় মানুষ যেমন জুটে যায়, তেমনি তারা ঘনিষ্টও হতে পারে। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনে থেকে এই মিলনক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। এটি কেবল সাংস্কৃতিক মিলন ক্ষেত্র বা লেনদেনের স্থান নয়, ব্যবহারিক জীবনেরও এক বিরাট লেনদেনের স্থান। যে যুগে দোকান বা হাট সৃষ্টি হয় নি, তখন এই মেলাতেই বিনিময়ের লেনদেনের সূচনা হতো। সেদিনের মানুষ নৃত্যগীতের মাধ্যমে এক গোষ্ঠী থেকে অন্য গোষ্ঠীর সঙ্গে পরিচয়, আদানপ্রদান, সংগৃহীত বস্তু ও জীবজন্তুর বিনিময় করতো। সভ্যতার বিবর্তনে মানুষে মানুষে মিলনমেলার বিশেষ উপযোগিতা রয়েছে। কিন্তু যেহেতু এর গতি অতি মন্থর, তাই তাকে উপলদ্ধি করতে পৌরাণিক জীবনকে পর্যালোচনা করার প্রয়োজন আছে।
প্রকৃতির সন্তান মানুষ, এই প্রকৃতির কোলে সে লালিত পালিত হয়ে আধুনিক একবিংশ শতকে পদার্পণ করেছে। তাই মানুষের আচার-অনুষ্ঠান, পুজা-পার্বণে বিশ্বপ্রকৃতির প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়।
মানুষ যখন আরণ্যক প্রাণী মাত্র, ঋতু পরিবর্তনের কারণ, চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ ইত্যাদি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তাদের কাছে ছিল না। কিন্তু মননশীল বুদ্ধিজীবী মানুষ, জ্যোতিষ-শাস্ত্রের জ্ঞান, জ্ঞানী-গুণীর আয়ত্বে এলেও আজকের মতো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ তাদের ছিল না। কিন্তু এই সব গুণী ব্যক্তিগণ অজ্ঞজনকে যে ভাবে ব্যাখ্যা করতেন এবং চালনা করতেন জনসাধারণ তাকে বেদবাক্যরূপে গ্রহণ করতো। তাই দেখা যায় মকর সংক্রান্তিতে স্নানযাত্রা। এদিন নদীতে অবগাহন করলে পূণ্য লাভ করা যায়। তাই এদিনে বিশেষ বিশেষ নদী তীরে বহু মানুষের সমাগম হতে দেখা যায়।
মানুষ গ্রাম নগর বা শহর যেখানেই বাস করে, সেখানেই তারা পরস্পরকে অবলম্বন করে জীবন নির্বাহ করে। তার জন্য নদী তীরে স্নানযাত্রার দিনে মানুষের পূণ্য কর্মের সঙ্গে সেখানেও একটা পূণ্য উৎসব বসে যায়। প্রবীণেরা এই দিনের স্নানের মাহাত্ম উপলদ্ধি করে ম্লান করতে যান, কিন্তু তাদের সঙ্গে বহু ছেলে, মেয়ে, বুড়ো সেখানে যান কেবল আনন্দ-উপভোগ করতে এবং ব্যাপারীরা পসরা সাজিয়ে বসে কিছু অর্থ উপার্জনের আশায়। পূণ্যার্থীরা যখন দেবদেবীর মাহাত্ম কীর্তন করতে রাস্তা দিয়ে মিছিল করে চলতে থাকে, তখন মনে হয় স্বর্গীয় মহিমা ধারা বর্ষিত হচ্ছে। অন্যদিকে ব্যাপারীরা কেউ রেশমী চুরি, ইমিটেশন গহনা, বাচ্চাদের নানা খেলনা বা গৃহস্থের ঘরের প্রয়োজনীয় বাঁশের কুলো, চুপড়ি ইত্যাদি দ্রব্য নিয়ে পশরা সাজিয়ে বসে কেনাবেচা শুরু করে দেয়। আবার অন্যদিকে নটনটীরা নৃত্যগীত করে দর্শকদের আকর্ষণ করেও কিছু পয়সা উপার্জনের চেষ্টা করে। কোথাও জিলিপি, পাপড় ভাজা, লাড্ডু ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্য বিক্রি হচ্ছে। আজকাল ডিমের রোল বা চাইনিজ-এর দোকানও দেখতে পাওয়া যায় মেলায়। লোকসমাগমে কয়েক দিনের জন্য সেই স্থান গমগম করতে থাকে সরকার থেকে সেখানে অস্থায়ী বিজলী বাতির ব্যবস্থাও কোথাও কোথাও হয়ে থাকে। নইলে কুপিবাতি বা হ্যাজাকের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে মেলা। তবে মানব জীবনের আদিম রূপটি আদিবাসী সমাজে দেখা যায়, তা নগর-শহরের মেলার রূপের থেকে অনেক আলাদা। তবে যা-ই হোক না কেন আমাদের মধ্যে যদিও লৌকিক ধর্মের প্রয়োজনে মেলার সৃষ্টি হয়েছিল, কিন্তু এই মেলার মধ্য দিয়েই জাতি সকল সংকীর্ণতার উদ্ধে উঠতে পারে এবং হৃদয় খুলে দু-হাত ভরে দিতে সক্ষম হয় একদিকে, অন্যদিকে অপরকে গ্রহণ করবার ক্ষমতাও তার থাকে। তাই বলা যেতে পারে হৃদয়ের লেনদেনের মিলনমেলা হয় আমাদের মেলা।
চট্টগ্রামের মেলা
চট্টগ্রাম নামটি সমগ্র ভারতেবর্ষে সুপরিচিত ও সু-উল্লেখ্য। পরাধীন ভারতে এবং অভিভক্ত বাংলার ইতিহাসে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন এক বিষ্ময়কর ও চাঞ্চল্যকর ঘটনা।
দুই বাংলায় অর্থাৎ পশ্চিমবাংলা এবং বাংলাদেশে যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সূত্রে এক মন, একপ্রাণ। তা দুই দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চাও মেলাগুলি দেখলে বোঝা যায়। কবি নজরুলের কণ্ঠে একদা যেমন ধ্বনিত হয়েছিল—- ‘একই বৃন্তে দুইটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান’-ঠিক তেমন করেই বলা যেতে পারে পশ্চিম বাংলায় রাম নামের এক ভাই থাকেন আর বাংলাদেশে থাকেন অপর ভাই রহিম নামের মানুষটি, দুই ভাই দুই দেশের উপমা ও দুই মেরূর অধিবাসী হলেও আন্ত ফল্গু স্রোতে দুজনেই যে একই প্রবাহ তা দুই বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা, হাট, মেলা এবং ভাবের আদান-প্রদানের যোগসূত্র দেখে ধরা যায়। বিশেষ করে হাট বা মেলার সূত্রে যে সমাজ জাতীয়তাবোধ ও মেলবন্ধনের সূত্র ধরেই হ’ল কৃষ্টিগত প্রমাণ।
চট্টগ্রামের মেলা সম্পর্কে বলা যায়, সমগ্র ভারতবর্ষ থেকে বৈচিত্র্যময় চট্টগ্রামের মেলা। চট্টগ্রামের বাঙালি, হিন্দু, বৌদ্ধ, মগ, মুসলমান ছাড়াও পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, মারমা সহ তেরটি নৃ-গোষ্ঠীর এক ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান। এতগুলো জনগোষ্ঠীর এক জায়গাতে বসবাস ভারতবর্ষের আর কোথাও নেই। তাই চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের মেলার ঐতিহ্য বাংলাদেশের এক বিশেষ ও অভিনব দিক।
চট্টগ্রামে ছোট-বড় নানা ধরনের মেলা-খেলা ও উৎসব অনুষ্ঠিত হয় জাতি ধর্ম নির্বিশেষে। এরই মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য মেলা হল—- সীতকুন্ডের মেলা, রাউজান মহামুণির মেলা, লালদীঘির জব্বারের বলী খেলা ও মেলা, পটিয়ার সূর্য খোলার মেলা ইত্যাদি।
সীতাকুন্ডের মেলা ঃ শিব চতুর্দশীতে আরম্ভ হয়ে দোল পূর্ণিমা পর্যন্ত চলে এই মেলা। প্রতি বছর একই সময়ে এবং একপক্ষ কালের কিছু কম বেশি সময় ধরে চলে এই মেলাটি। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয় যে, এখানে দেবী সতী বা দূর্গার খণ্ডিত দেহাংশ পড়ে, সেই থেকে তীর্থক্ষেত্র হয়েছে এবং এটি ধর্মীয় পীঠস্থান স্বরূপ। এটা পৌরাণিক ৫১ আদ্যাপীঠের অন্যতম একটি।
অবিভক্ত বাংলার একটি বিখ্যাত মেলার স্বরূপ। অতীতে এবং আধুনিককালেও ধর্ম বিশেষের পথ ধরেই পশ্চিম বাংলা, ত্রিপুরা ও আসাম থেকে এই মেলায় নানা সূত্রে মানুষ আসে। কথিত আছে যে, স্থানীয় চন্দ্রনাথ পাহাড়ে চন্দ্রনাথ শিবের মন্দিরে ওই দিন স্বয়ং দেবতা শিব এসে বসত করে থাকেন। এই পুণ্যতীর্থ লোক বিশ্বাসের কলাণে এবং ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কল্যাণ কামনায় লোকে দূর-দূরান্ত হ’তে এখানে এসে গিরিশ ধর্ম শালায় রাত্রি যাপন করে সীতাকুন্ডে স্নান করে, চন্দ্রনাথ মন্দিরে পুজা দেয়। সূউচ্চ চন্দ্রনাথ পাহাড়ে সবাই পৌঁছায় না বা পারে না। তাই স্থানীয় অনেকেই কাছাকাছি ব্যাসকুÐে স্নান সেরে অদূরবর্তী ভৈরব মূর্তিতে পুজা দেয়-প্রসাদ খান। অনেকে আবার আরও কিছু দূরে শম্ভুনাথ শিবের মন্দিরে উঠে পুজা দেয়। যারা আরও শক্তি রাখেন তারা পায়ে হেঁটে চন্দ্রনাথ পাহাড়ে পৌঁছে চন্দ্রনাথ মন্দির সংলগ্ন চাতালে বসে পুজা দিয়ে প্রসাদ খেয়ে, কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে নেমে আসেন নিচে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়ে মেলা সেরে চন্দ্রনাথ দর্শন করে ফিরে আসতে পারেন লোকেরা, মেলায় বেচা-কেনা,খাই-খাওয়া, যাত্রা, পালাগান প্রভৃতি চলে। ধর্মশালা, যাত্রী আবাস এবং জল ও বৈদ্যুতিক আলোর সুবিধা থাকায় অনেকে এখানে ২/৩ দিন বাস করেও থাকেন। তাই এটাকে নানাভাবে শ্রেষ্ঠতর মেলা বলা চলে।
ঠিক এই সময় মহেশখালীতে আদিবাসীদের শিব মন্দিরে মেলা হয়। নৌকা যোগে দ্বীপে পৌঁছে পুজো দেয় মেলার লোকেরা। বিশেষ করে সীতাকুন্ডের মেলায় এসে এখান থেকেই লোকজন মখেশখালীর মেলায় যোগদেয়। এই উপলক্ষে তখন চট্টগ্রাম বেশ উৎসব মূখর হয়ে ওঠে।
পাহাড়তলীতে মহামুনির মেলা ঃ স্থানের নাম মহামুনি, গ্রাম-পাহাড়তলী, থানা রাউজান। সেখানে মায়া বা বৌদ্ধমূর্তি সু উচ্চ ও সুপরিসর ছাপ জুড়ে এই মায়ার কাছে সবাই জড়ো হয়। চৈত্র সংক্রান্তিতে এ মেলা হয়। সংক্রান্তির দু-একদিন আগে থেকে লোকেরা এখানে আসেন মহামুনির মেলাতে যোগ দিতে। এখান থেকে কিছু দূরে এবং উচুঁতে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী অঞ্চল থেকে চাকমা-মারমা সহ ক্ষুদ্র উপজাতির লোকেরা নেমে আসেন। ওখানেই তারা পাত্র-পাত্রী নির্বচন করে মায়াকে প্রদক্ষিণ করে বিয়ে-শাদি সেরে, নাচগান করে আবার মেলা শেষে নববর্ষের দিনে নিজ নিজ এলকায় ফিরে গিয়ে উৎসব প্রভৃতি সারেন। আসলে মায়ার সামনে তারা বাগদান বা পাকাকথার অনুষ্ঠান সেরে আনন্দ উৎসব করে থাকে। তাই মেলাকে ঘিরে উপজাতিদের বিবাহ উৎসব ও নাচগান দেখার মতোই, সুখশ্রাব্য ও আনন্দদায়ক।মেলা শেষে উপজাতিরা হাঁড়ি ভর্তি করে জিলাপী প্রভৃতি মিষ্টি নিয়ে ঘরে ফেরে।
লালদীঘির জব্বারে বলী খেলা ঃ জব্বারের বলি খেলার অবস্থান চট্টগ্রাম নগরীর কেন্দ্রস্থল লালদীঘির ময়দানে। এই মেলা বা মেলাটি নানাভাবে উল্লেখযোগ্য। বলী অর্থাৎ বলশালী বা শক্তি প্রদর্শন করা। ১২ বৈশাখ মেলাটি হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই মেলা চলে। আবদুল জব্বার নামে এই মুসলমান খুবই শক্তিশালী ছিলেন। তিনিই এই মেলাটি প্রতিষ্ঠা করেন। চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে এই মেলা হয় এবং প্রতিযোগিদের মধ্যে পুরুষ্কার বিতরণ করা হয়। চট্টগ্রামের পুলিশ প্রশাসন পুরো মেলাটির দেখভাল করে থাকেন। নানাভাবে সহযোগিতায় থাকেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। মেলা শুরুর কয়েকদিন আগে থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বেত ও বাশের জিনিস, মাটির তৈরী বিভিন্ন মৃৎশিল্প, খেলনা, মিষ্টি খাবার, ফলসহ নানা ধরণের জিনিষ নিয়ে ব্যবসায়ীরা ছুটে আসে চট্টগ্রাম শহরে। মেলা শেষ হবার পরও দু-একদিন কেনাকাটা চলে। এই মেলাকে উপলক্ষ করে যে কুস্তি খেলার মাধ্যমে শক্তি প্রদর্শন দেখানো হয় তাতে যুব সমাজের শক্তি দেখানোর প্রতি এক উৎসাহ উদ্দীপনা থাকে।
সূর্য খোলার মেলা ঃ এটি ব্রত উৎসব ও উৎসব পালন জাতীয় সামাজিক ঘরোয়া উৎসব ও মেলা। সারা চট্টগ্রাম জুড়ে মাঘ মাসে এই মেলা ও আনন্দ উৎসব হয়ে থাকে। প্রায় প্রতি ঘরে ঘরে নানা গ্রামে এই মেলা ও উৎসব হয়ে থাকে। সনাতন ধর্মাবলম্বী লোকেরা ঘর থেকে রওনা হয়ে এক এক জায়গায় জমায়েত হয়ে স্নান সেরে পুজো দিয়ে সূর্যের উদ্দেশ্যে প্রণাম ও প্রার্থনা জানানো হয়। বোয়ালখালীর জ্যেষ্টপুরা গ্রামের মেলায় ভেষজ গাছগাছরা বেচাকেনা হয়। সাদা রঙের মিষ্টি আলু পোড়ানো বা আগুনে ঝলসানো হয়ে সুমিষ্ট খাদ্য বস্তু ও স্মারক হিসেবে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। তাই পোড়া আলু ঐ সময়ে গ্রামবাসীরা খেয়ে থাকেন। এইভাবে মাঘমাস থেকে সূর্য দেবতার নামে এই মেলা ও লোকউৎসব হয়।
এছাড়া সমগ্র চট্টগ্রামে অন্যান্য যেসব মেলা হয়ে থাকে সেগুলোর মধ্যে পটিয়া থানায় ১ বৈশাখ হতে তিন দিন শ্রীমাই মেলা , সীতাকুন্ড থানায় ১বৈশাখ অনুষ্টিত হয় বৈশাখী মেলা, রাউজান থানায় ১ বৈশাখ অনুষ্টিত হয় বৈশাখী মেলা, রাউজান থানায় ১ বৈশাখ অনুষ্টিত হয় বৈশাখী মেলা। রাঙ্গুনিয়া থানার মহামুনি পাহাড়তলীতে ২০ আষাঢ় বৌদ্ধদেবের পূজা উপলক্ষে অনুষ্টিত হয় অষ্টমী পূণিমা। রাঙ্গুনিয়া থানার বিজুড়ি গ্রামে বৌদ্ধদেবের পূজা উপলক্ষে ১৫ আশ্বিন হতে তিন দিন ব্যাপী অনুষ্টিত হয় আশ্বিনী পূর্ণিমা। চট্টগ্রাম নগরীর হাজারী লেইনের কালীবাড়ি মন্দিরে হিন্দু স¤প্রদায়ের সপ্তমী উপলক্ষে আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে অনুষ্টিত হয় মহালয়া। সীতাকুন্ড থানায় আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষের সপ্তমী উপলক্ষে ৬দিন ব্যাপী অনুষ্টিত হয় দূর্গাপুজা মেলা। চট্টগ্রাম নগরীর হাজারী লেইনস্থ কালীবাড়ি মন্দিরে কার্তিক মাসের অমাবস্যা হতে ৩ দিন ব্যাপী অনুষ্টিত হয় কালী পুজা। পটিয়া থানার চিৎমরং গ্রামে মাঘ মাসের পূণিমার দিন হতে ৫দিন ব্যাপী অনুষ্টিত হয় মাঘী পূণিমা। সীতাকুন্ড থানার হিন্দু স¤প্রদায়ের পুজা উপলক্ষে অনুষ্টিত হয় শিব যাত্রা। বোয়ালখালী থানার কদুরখীল গ্রামে জগদানন্দ তিরোভাবে ৩১ আষাঢ় অনুষ্টিত হয় কদুরখীল মেলা। বোয়ালখালী থানার কোককন্ডি গ্রামে ৩১ আষাঢ় অনুষ্টিত হয় কোকদন্ডি মেলা। ২৯ ভাদ্র বোয়ালখালী থানার খিতাবচর গ্রামে অনুষ্টিত হয় খিতাবচর মেলা।পটিয়া থানার আমীর ভান্ডারে ২৯ আশ্বিন অনুষ্ঠিত হয় আমীর ভান্ডার মেলা। ফটিকছড়ি থানার মাইজভান্ডার ৩০ আশ্বিন অনুষ্টিত হয় ওরশ মেলা। চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়তলী কৈবল্যধামে আাশ্নিন মাসের শুক্লপক্ষের সপ্তমীতে অনুষ্টিত হয় শ্রী শ্রী কৈবল্যধাম মেলা। চন্দনাইশ থানার জোয়ারা গ্রামে ২০ আাশ্বিন জংলী পীরসাহেবের বাষিক ওরশ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত হয় জোয়ারার মেলা। কার্তিক মাসের অমাবস্যায় ১৪ অগ্রহায়ণ পতেঙ্গায় অনুষ্ঠিত হয় কালীবাড়ি মেলা। ১২ পৌষ কক্সবাজারের সরস্বতী বাড়িতে অনুষ্টিত হয় সরস্বতী মেলা। ১২ পৌষ বোয়ালখালীর সরোয়াতলী গ্রামে অনুষ্টিত হয় সরোয়াতলী মেলা। ১৬ পৌষ বোয়ালখালী থানার কদুরখীল গ্রামে অনুষ্টিত হয় কদুরখীল মেলা। ১৫ মাঘ স›দ্বীপের হরিশপুর গ্রামে অনুষ্টিত হয় হরিশপুর মেলা। ১৫ মাঘ বোলায়খালী থানার করনখাইন গ্রামে অনুষ্টিত হয় করণখাইন মেলা। আনোয়ারা থানার আনোয়ারা গ্রামে অনুষ্টিত হয় ইছামতি মেলা। ২৮ চৈত্র কাট্টলী সমুদ্র উপকুলে অনুষ্টিত হয় কাট্টলী মেলা, এসব মেলা সহ চট্টগ্রামের সর্বত্র বৈশালী মেলা থেকে শুরু করে বছরধরে নানা ধরনের মেলা অনুষ্টিত হয়ে আসছে সেই আদিকাল থেকে। উল্লেখ্য যে, এসব মেলায় বিকিকিনি হয় কাঠের পুতুল, শুকানো লাউ-এর খোসার ভেলা, বাঁশের বাশি, কাজু বাদাম, পাহাড়িয়াদের তৈরী বাঁশের ঝুড়ি, নানা ধরনের খেলনা, পোড়া মাটির তৈরী পুতুল, কাঠ ও প্লাষ্টিকের পুতুল, নারিকেলের মালা ও খোসার নানা প্রকার পুতুল, বেত, কাঠ ও বাঁশের আসবাব পত্র, চিকা চটের ব্যাগ, পাটের বাটি, পেয়ালা, বাঁশের পাখা, বাঁশের চালনী, ডালা, বেতের মোড়া ইত্যাদি।
এছাড়ও আধুনিকতার হাত ধরে যেমন দেশে কলকারখানা গড়ে উঠেছে, তেমনি নগরায়ণ সভ্যতার হাওয়া বইছে দেশে। তাতে দেখা যাচ্ছে প্রাচীন লৌকিক দেব;েদবীর স্থানে আজ উচ্চমানের দেবদেবীর পূজার আয়োজনে প্রাণচুর্যের বন্যা বেড়েই চলেছে। যেমন দূর্গা, কালী বা সরস্বতী পুজা। আর এই সব পূজো প্যান্ডেল ঘিরে মেলার প্রতিযোগীতাও লক্ষ্যণীয়। স্বদেশী যুগে শুরু হয়েছিল স্বদেশীমেলা। সেখানে গান-নাটক ইত্যাদি হত। কিন্তু এর কোন স্থায়ী রূপ হয় নি। দেশ স্বাধীন হবার পর মেলার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রদর্শনী। শিল্পামেলা, বইমেলা, বিজ্ঞানমেলা। স্কুল-কলেজে অথবা ক্লাবঘরের মাঠজুড়ে অনুষ্ঠত হয় এসব মেলা বা প্রদর্শনী।
এগুলো জাতীয় জীবনে বিজ্ঞান ও শিল্পকে উৎসাহিত করে। এই মেলাগুলোর সঙ্গে নাটক, গানের জলসা যুক্ত থাকে। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে সাক্ষরতার মেলা। কবিগুরু বরীন্দ্রনাথের শতবার্ষিকীর মেলা থেকে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্মদিন-মৃত্যুদিন বা ঐতিহাসিক বিশেষ দিনের স্মরণেও আধুনিক কালে মেলা হচ্ছে। এই সব মেলায় যুক্ত হচ্ছে দেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো, ফলে দেশের আর্থিক বিকাশে এদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
আমাদের বাঙালিদের মধ্যে যদিও লৌকিক ধর্মের প্রয়োজনে মেলার সৃষ্টি হয়েছিল কিন্তু এই মেলার মধ্য দিয়েই জাতি সকল সংকীর্ণতার উদ্ধে উঠতে পারে এবং একদিকে হৃদয় খুলে দু-হাত ভরে দিতে সক্ষম হয় অপরদিকে অপরকে গ্রহণ করবার ক্ষমতাও তার থাকে। তাই বলা যেতে পারে ভেদাভেদ ভুলে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের হৃদয়ের মিলনমেলা হয় আমাদের মেলা।