বেবী চৌধুরী

36

নামটি আব্বার কাছে শুনেছিলাম সেই অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন। আব্বা বলেছিলেন, বেবী বড়দা’র (শফিকুল ইসলাম চৌধুরী) ছেলেও তোমাদের সাথে অতুলানন্দ স্মৃতি বৃত্তি পেয়েছে। ওর সাথে পরিচিত হতে পার, ভালো ছেলে। কিন্তু আমিতো মৃদুভাষী প্রকৃতির, মানুষের সাথে কম কথা বলতাম, আমার পক্ষে হয়তো সেটা হয়ে উঠতো না। কিন্তু পরিচয় পর্বটা সহজ করে দিল আরিফুল ইসলাম চৌধুরী সোহেল। অবশ্য আমরা একজন আরেকজনকে চিনতামই না, কিন্তু সেটা দেয়াল হয়ে থাকেনি আর। পরিচয় পর্বটা আমার দিক থেকে হয়নি, সোহেলের দিক থেকে হয়েছে। আর এখন চিন্তা করছি, মানুষের সাথে পরিচিত হওয়ার ও নেতৃত্বের গুণাবলীটা আসলেই সে পেয়েছে তাঁর বাবা শফিকুল ইসলাম চৌধুরী (বেবী আঙ্কেলের) কাছ থেকে। এস.এস.সি. পরীক্ষার পর রাউজান কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। ধীরে ধীরে অনেকের সাথে পরিচয়। হঠাৎ একদিন দেখা হয়ে গেল সেই সোহেলের সাথে। তার মার্জিত ও সুন্দর কথা বলার ভঙ্গি দেখে ভাবলাম তার সাথে বন্ধুত্ব হলে মন্দ হয়না। একে একে আরো অনেকের সাথে ঘনিষ্ঠতা হতে লাগলো এবং ভারী হতে লাগলো আমাদের বন্ধুসার্কেল। বন্ধুত্বের খাতিরে এক অপরের বাড়ি যাওয়া হত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে; আর এভাবে একদিন বেবী আঙ্কেলের সাথেও পরিচয়টা হয়ে গেল। কাছ থেকে দেখা একজন অমায়িক, স্পষ্টভাষী আর সাদা মনের মানুষ। রাজনীতিকে তিনি তাঁর ধ্যান-জ্ঞান মনে করতেন। আঙ্কেলের সাথে অনেকভাবে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। একবার আমার মনে আছে, আমি, বন্ধু সাফকাত নিজাম, রুবেল দাশগুপ্ত, মান্না কর্মকার, রাহুল দাশ, জনি বিশ্বাস, খোরশেদ আলম, দেবাশীষ, সাজু মুহুরী, সাহেদ ইসলাম, আমরা সোহেলের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ওই দিন আমাদের সাথে বেবী আঙ্কেল প্রায় দু’ঘন্টার উপরে কথা বলেছিলেন। উনার রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া, দেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, পঁচাত্তর পরবর্তী রাজনীতি, কিভাবে আওয়ামী লীগের হাল ধরে রেখেছিলেন এবং বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ইত্যাদি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছিলেন। অথচ তখন আমরা সবে মাত্র ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র, কতইবা বয়স আমাদের! আর উনি তখন রাউজান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং একই সাথে রাউজান পৌরসভার মেয়র। তাঁর এতো ব্যস্ততার ভিড়ে আমাদের সাথে কথা না বললেও চলে। কথাটা এজন্যই বলছি যে, বেবী চৌধুরী আঙ্কেলেকে একদম কাছ থেকে দেখেছি, উনার কাছে ছোট-বড়, ধনী-গরিব, ধর্ম- বর্ণ নির্বিশেষে সকলের সমান প্রাধান্য ছিল। সকলের সমস্যার কথা মনযোগ দিয়ে শুনতেন এবং সাধ্যমতো সমাধানে উপায় বলে দিতেন অথাব নিজেই সমাধান করে দিতেন। উনার দীর্ঘ রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনে কোনদিন কারো বিরাগভাজন হননি। উনার রাজনীতির দিকে তাকালে আমরা দেখি সদা একজন অসম্প্রদায়িক, নির্ভেজাল এবং নিরহংকার মানুষ হিসেবে তাঁর দলকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। ছাত্র জীবনে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি দিয়ে রাজনীতির হাতে কড়ি হলেও পরবর্তীতে তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতা অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদের হাত ধরে আওয়ামী রাজনীতিতে প্রবেশ করেন তিনি। গতানুগতিক রাজনৈতিক ধারার বিপরীতে মানবিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা এবং সে সময়কার পেশী শক্তির রাজনীতি ও অস্ত্রবাজির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুৃ শেখ মুজিবর রহমানের একজন আদর্শ সৈনিক হিসেবে একাই মাঠের লড়াই চালিয়ে গেছেন। রাজনীতি করেছেন আদর্শের জন্য, রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি প্রতিষ্ঠর জন্য, মে?লিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। কথা বলেছেন শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে, সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য। স্বপ্ন দেখতেন একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। লড়াই করেছেন একটি প্রগতি মুখী- বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য। মাও সেতুং এর ভাষায়, খবঃ ধ যঁহফৎবফ ভষড়বিৎং নষড়ড়স, ষবঃ ধ যঁহফৎবফ ংপযড়ড়ষ ড়ভ ঃযড়ঁমযঃ পড়হঃবহফ’. আমরা এখন রাজনীতি নিয়ে অনেক কথা শুনি। অনেকেই বলে থাকেন রাজনীতিতে ভালো মানুষের জায়গা নেই। রাজনীতিতে নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিতে হয়। এমনকি রাজনীতি বিজ্ঞানী ম্যাকীয়াভ্যালি বলেছেন, চড়ষরঃরপং যধাব হড় ৎবষধঃরড়হ ঃড় সড়ৎধষং’. কিন্তু শফিকুল ইসলাম চৌধুরী বেবী ছিলেন তার ঠিক বিপরীত মেরুতে। রাজনীতে যে একটা আদর্শ, রাজনীতি মানে গণমানুষের কল্যাণ সাধনকে বুঝায়, তা তিনি রাউজানের মানুষকে দেখিয়ে দিয়েছেন। জমিদারী রাজনৈতিক প্রথা ভেঙ্গে আওয়ামী লীগের যে ঐতিহাসিক রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য মধ্যবিত্ত শ্রেণি আর সাধারণ মানুষের কাতারে রাজনীতিকে নিয়ে আসা তা রাউজানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শফিকুল ইসলাম চৌধুরী তথা সবার প্রিয় বেবী ভাই। রাজনীতি করে বেবী চে?ধুরী লাভবান হয়েছেন এমন কথা কখনো শুনিনি, এমনকি তাঁর কোন বিরোধী পক্ষও সে কথা বলতে পারবে না , উনি রাজনীতি করে লাভবান হয়েছেন। আমার জানা মতে, তিনি অনেক পৈতৃক সম্পত্তি হারিয়েছেন শুধুমাত্র তাঁর রাজ নৈতিক আদর্শের কারণে। কীর্তিমান এই সাদা মনের মানুষটি আমাদের সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে গত ২৭ অক্টোবর, ২০১৬ তারিখ সকালে মৃত্যুবরণ করেন। ডরহংঃড়হ ঈযঁৎপযরষষ এর একটা উক্তি মনে এসেছে, ঝড়সব সবহ পযধহমব ঃযবরৎ ঢ়ধৎঃু ভড়ৎ ঃযব ংধশব ড়ভ ঃযবরৎ ঢ়ৎরহপরঢ়ষবং; ড়ঃযবৎং ঃযবরৎ ঢ়ৎরহপরঢ়ষবং ভড়ৎ ঃযব ংধশব ড়ভ ঃযবরৎ ঢ়ধৎঃু. আশা করবো তাঁর উত্তরসূরিরা তাঁর দেখানো পথে হাঁটবেন। নিজেকে একটু হালকা মনে হতো যদি এসময় বন্ধু সোহেলের পাশে পাশে থাকতে পারতাম। সোহেল ও রানা ভাইয়াকে বলছি ভেঙ্গে পড়ো না, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক চেতনায় বাংলাদেশকে পরিচালিত করতে হলে আপনাদের আমাদের আরো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। শক্ত হও, বাবার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হবে, আদর্শিক সংগ্রাম জাগিয়ে রাখতে হবে।
জয় হোক মানুষের, জয় হোক মানবিক রাজনীতির। ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে বিনম্রশ্রদ্ধা।