বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা ও যানজটে স্থবির নগরী

59

চট্টগ্রাম মহানগর ও আশপাশের এলাকায় গতকাল সন্ধ্যা ৬টা থেকে পূর্ববর্তী ২৪ ঘণ্টায় ১০৪ মিলি মিটার বৃষ্টি রেকর্ড করেছে চট্টগ্রাম আবহাওয়া অধিদপ্তর। ভারী বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় নগরীর নিম্নাঞ্চল। ফলে সকাল থেকে নগরীর সবক’টি সড়কে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। হালকা, মাঝারি ও ভারী যেকোনো ধরনের বৃষ্টিতেই এমন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে। বৃষ্টি মানেই যেন জলজট আর যানজটে স্থবির নগরী।
এদিকে জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন। প্রকল্পের মেয়াদের দুই বছর পেরিয়ে গেলেও নগরবাসীর ভাগ্য বদলের কোনো লক্ষণ দৃশ্যমান হয়নি। দায়িত্বশীলদের আর আশ্বাস নয়, এমন নাকাল অবস্থার পরিবর্তন চায় নগরবাসী।
গতকাল সকাল ১১টা। বৃষ্টিতে সিক্ত বন্দরনগরী। তলিয়ে গেছে প্রবর্তক মোড়। সড়কে আটকা পড়েছে সারি সারি গাড়ি, সৃষ্টি হয়েছে তীব্র যানজট। সেই যানজট ছড়িয়েছে আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত। স্থবির হয়ে পড়ে সড়ক। সড়কে বয়ে চলা পানির কারণে শুধু গাড়িই নয়, মানুষও হেঁটে পার হতে পারছেন না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটের বিরক্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে গাড়িতে আটকে পড়া মানুষগুলোর মুখে।
প্রবর্তক মোড়ের চেয়েও বেশি পানি জমে পাঁচলাইশ এলাকার কাতালগঞ্জ মোড়ে। জলজটে আটকে রয়েছে অনেকগুলো সিএনজি অটোরিকশা। এই মোড়ে ভোগান্তি আরও বেড়েছে রাস্তার উপর সারিবদ্ধ করে পার্কিং করা মাইক্রোবাসগুলোর কারণে। দখলের ফলে সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে সড়ক, বেড়েছে পানির পরিমাণও। ফলে জলাবদ্ধতায় গাড়ি আর মানুষ একসাথে আটকা পড়ে। এছাড়াও বাইপাস সড়কগুলোতে, অর্থাৎ কাতালগঞ্জের আবাসিকের সড়কগুলো হাঁটু পানিতে তলিয়ে যায়। ফলে গন্তব্যে পৌঁছাতে ভোগান্তিতে পড়েন জনগণ। সেই দুরবস্থাকে পুঁজি করে অতিরিক্ত ভাড়া হাতিয়ে নিচ্ছেন রিকশাচালকরা।
একটু সামনে এগোলে পানি আরও বেশি। চকবাজারের নবাব ওয়ালি বেগ খাঁ মসজিদ মোড় পর্যন্ত সৃষ্টি হয়েছে জলজটের। যানজট ছড়িয়ে পড়েছে জামালখান-আন্দরকিল্লা পর্যন্ত। একে তো সড়কে বৃষ্টির পানি, তার উপর ওয়াসার সদ্য খুঁড়ে রাখা গর্ত। ফলে পানি মাড়িয়ে চলাচলও পথচারীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। পানি নেমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় পথচারীদের। বৃষ্টি হলে জলজট আর যানজটে নষ্ট হয় কোটি কোটি টাকার কর্মঘণ্টা। এ যেন নগরবাসীর বিধিলিপি।
কাঁধে অফিস ব্যাগ আর হাতে টিফিন বক্স। পানির দিকে তাকিয়ে ভাবছেন জুতা খুলে হাঁটবেন, নাকি অপেক্ষা করবেন। কাতালগঞ্জের মোড়ে ক্লান্তি আর দ্বিধাদ্বন্দ্বের এমন ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কলেজ শিক্ষক হোসাইন আহমদ। বৃষ্টি হলেই নগরে জলাবদ্ধতাকে কিভাবে নিচ্ছেন? তাঁর কাছে এমন প্রশ্ন ছুড়ে দিলে অনিচ্ছা সত্তে¡ও পূর্বদেশকে বলেন, বৃষ্টি তো এখন ট্রামকার্ড। বৃষ্টি হলেই পানি উঠবে। দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হবে। সাংবাদিকরা লিখবেন। আর দায়িত্বশীল কর্তারা যাচ্ছেতাই বুলি আওড়াবেন। এসব আর দেখতে ইচ্ছে করছে না। আমাদের নিয়ে আর কত ছিনিমিনি খেলা চলবে, তাও জানি না। তবে এর শেষ দেখতে চাই। কোনো ব্যাখ্যা চাই না, আশ্বাস বা আস্থাও না। ভোগান্তির শেষ চাই। সারাদিন ক্লাস করিয়ে এখন দাঁড়িয়ে আছি সড়কে!
শুধু এই শিক্ষক নন, সকাল থেকে টানা বর্ষণ এবং জোয়ারের কারণে নগরের অক্সিজেন, বাকলিয়া, চান্দগাঁও, মুরাদপুর, ষোলশহর, ওয়াসার মোড়, প্রবর্তক মোড়, আগ্রাবাদ এবং হালিশহরের অধিকাংশ এলাকা পানিতে ডুবে যাওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েন হাজারো নগরবাসী।
গতকাল ছিল অফিসে সপ্তাহের শেষ দিন। ফলে বাড়ি ফেরা মানুষের চাপে নগরজুড়ে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজটের। নতুন ব্রিজ থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সড়কের বেশ কয়েকটি এলাকা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় যান চলাচল স্থবির হয়ে পড়ে। এতে আটকা পড়েন বিমানবন্দরের যাত্রী, রোগীসহ নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষ। অন্যদিকে বরাবরের মতই বৃষ্টির কারণে জোয়ারের পানিতে আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালের নিচতলায় হাঁটু পানি জমে। এতে হাসপাতালের শিশু বিকাশ কেন্দ্র, জেনারেল ওয়ার্ড, বহির্বিভাগ ও প্রশাসনিক কার্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়।
নগরীর জলাবদ্ধতা সম্পর্কে জলাবদ্ধতা নিরসন মেগাপ্রকল্পের পরিচালক কর্নেল শাহ আলী বলেন, আমরা পানিতে তলিয়ে যাওয়া এলাকাগুলো পরিদর্শন করেছি। পানি জমার কারণগুলো খুঁজে বের করা হয়েছে। এ নিয়ে কাজ করা হবে। সামনের শুষ্ক মৌসুমে কাজ করা হলে আগামী বর্ষায় এসব জায়গায় পানি জমবে না।
জলাবদ্ধতা নিয়ে মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ। তবে দায় এড়াতে পারে না সিটি কর্পোরেশনও। কারণ ৩ ফুটের কম চওড়া নালাগুলো নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব তাদের। বাকিগুলোর স্থায়ী সমাধানের কাজ করা হচ্ছে মেগাপ্রকল্পের অধীনে। সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্ন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রতি ওয়ার্ডে ৬০ থেকে ৭০ জন পরিচ্ছন্নকর্মী রয়েছেন। যাদের মধ্যে প্রতিদিন ড্রেন পরিষ্কারের কাজ বন্টন করা হয়। এছাড়া রয়েছে বর্জ্য সংগ্রহের কাজও। তবে প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ জন পরিচ্ছন্ন কর্মী শুধু ড্রেন পরিষ্কারে নিয়োজিত থাকেন। অন্যদিকে সিডিএ’র মেগাপ্রকল্প অনুমোদনের আগে এসব নালা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে বাজেট রাখত সিটি কর্পোরশেন। সিডিএ’র মেগাপ্রকল্প অনুমোদনের পর জলাবদ্ধতা নিয়ে এখন বাজেট রাখেনি সিটি কর্পোরেশন। ফলে নিজস্ব শ্রমিক দিয়ে ড্রেন পরিষ্কারের কাজ অনেকটা ধীরগতিতে চলছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, আমাদের পরিচ্ছন্নকর্মীরা প্রতিদিন নালা পরিষ্কার করছেন। তারপরও মানুষ প্রতিদিন নালায় ময়লা ফেলছে। আবারও পরিষ্কার করা হচ্ছে। তবে আমার যখন জলাবদ্ধতা নিয়ে কাজ করেছি, তখন এভাবে হালকা-মাঝারি বৃষ্টিতে পানি উঠেনি। কারণ আমাদের লোকগুলোর কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। কোথায় কাজ করলে সহজে পানি সরে যাবে, তারা সেটা জানে। এখনও যেখানে পানি জমছে সেখানে সিটি কর্পোরেশনের পরিচ্ছন্নকর্মীরা কাজ করছে। কিন্তু জলাবদ্ধতা নিয়ে যারা কাজ করছেন, তাদের অগ্রগতি কতটুকু? কেন জলাবদ্ধতা না কমে বাড়ছে ? এ প্রশ্ন রাখেন সিটি মেয়র নাছির।