বৃষ্টির রিনিঝিনি শব্দ সবার মন রাঙায়

184

বৃষ্টির রিনিঝিনি শব্দে সবারই মন রাঙিয়ে যায়। কেউ বলে টুপটাপ বৃষ্টি কেউবা বলে রিমঝিম বৃষ্টি। বিরামহীন গতিতে বৃষ্টির শব্দে আমরা সবাই কেমন যেন উতলা হয়ে যাই ছোট্টবন্ধুরা, তাই না ? প্রতিবছরই আমাদের দেশে আষাঢ়-শ্রাবণ দুই মাস বর্ষাকাল আসে নানান ছন্দে নানান আবেশে। বর্ষা নিয়ে আমাদের জীবনে নানা বিষয় বৈচিত্র্য বর্ষা ঋতুর সৌন্দর্যে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। বর্ষার জল, বর্ষার ঘাস, বর্ষার ফুল, বর্ষার প্রকৃতি, সবুজের সমারোহ সারাক্ষণ আমাদের মন ভরিয়ে রাখে। বর্ষায় টিনের চালে পড়ে থাকা ঝুমঝুম বৃষ্টিতে অন্যরকম সুরের খেলায় আমরা বিমুগ্ধ চিত্তে মেতে উঠি। বর্ষাকে আমরা প্রকৃতির রাণী হিসেবেই জানি। কবি সাহিত্যিকদের জন্য ও বর্ষা প্রিয় মাস। ষড়ঋতুর সৌন্দর্যময় এই বর্ষাকে নিয়ে লেখকরা নানাভাবে তাঁদের ভাবনাকে তুলে ধরেছেন। বর্ষা নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ঋতুভিত্তিক গান আছে ২৮৩টি। তার মধ্যে ১১৫টিই হলো বর্ষার গান। তেমনই বর্ষাকে অভিবাদন জানিয়ে কবিগুরু যখন লিখেন তখন সত্যিই মনটা অন্যরকম হয়ে ওঠে সবার-

“নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে!
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।
বাদলের ধারা ঝরে ঝরো-ঝরো, আউষের ক্ষেত জলে ভরো-ভরো,
কালিমাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনিয়েছে দেখ্ চাহি রে।
ওই শোনো শোনো পারে যাবে ব’লে কে ডাকিছে বুঝি মাঝিরে।

খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে।
পুবে হাওয়া বয়, কূলে নেই কেউ, দু’কূল বাহিয়া উঠে পড়ে ঢেউ-
দরো-দরো বেগে জলে পড়ি জল ছলো-ছল উঠে বাজি রে।
খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে”।

ছোট্টবন্ধুরা, বুঝতেই পারছো- বর্ষার নান্দনিক সৌন্দর্যকে কবি একেবারে প্রকৃতরূপে নির্ণয় করেছেন। কবির সুরের পাশাপাশি বলা যায়, বর্ষা মানে ফুল, বর্ষা মানে প্রকৃতি। বর্ষায় নানা রকম ফুল ফোটে আমাদের প্রকৃতির সৌন্দর্যকে নতুন মাত্রা দেয়। গ্রামে শহরে প্রতিটি জায়গায় বর্ষা আমাদের আমাদের আনন্দও দেয়। সবুজময় প্রকৃতির পাশে বর্ষায় ফোটে বাহারি ফুল। ফুলে ফুলে সুবাসিত শোভিত রূপ আমাদের নয়ন মনকে করে তোলে প্রফুল্ল। বর্ষায় ফোটা ফুলগুলোর মধ্যে উলে­খযোগ্য হলো কদম, বকুল, কলমি ফুল, স্পাইডার লিলি, দোলনচাঁপা, সুখদর্শন, ঘাসফুল, শাপলা, সন্ধ্যামালতি, কামিনী, গুল নার্গিস, দোপাটি, অলকানন্দ, রঙ্গন। তার মধ্যে শাপলা হলো আমাদের জাতীয় ফুল। সাদা, গাঢ় লাল, নীল ও গোলাপি রঙের শাপলার সাথে আমাদের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। শাপলা ফুল না চেনার লোক খুব কমই আছে। বর্ষায় ফোটা ফুলগুলোর মধ্যে শাপলা কদম বকুলের পাশে যখন কচুরিপানার ফুল ভেসে ওঠে প্রকৃতি ধারণ করে ভিন্নরূপ।
গ্রামাঞ্চলের খাল,বিল,পুকুর জলাশয়ে গাঢ় সবুজপাতার ওপর সাদা আর বেগুনি রঙে মেশানো নয়নাভিরাম ফুলগুলো হৃদয় কাড়ে সবার। প্রকৃতির নান্দনিক আরেক সৌন্দর্য কচুরিপানার ফুল। খুব অবহেলিত হলেও এর সৌন্দর্য হৃদয় কাড়ে। তোমরা তো জােেনাই বর্ষার সাথে কদম ফুলের নিবিড় এক সম্পর্ক। গ্রামাঞ্চলে নদীতীরে খোলা প্রান্তরে কদমের সমারোহ চোখে পড়ে। শহরে মাঠে পার্কে কদাচিৎ দেখা যায় কদম গাছ। ছ্ট্টোবন্ধুরা বর্ষার সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে চাইলে আমাদের ছুটে যেতে হবে গ্রামাঞ্চলে। কেবল ফুলই নয় ফলের সাথেও আমাদের দেখা মেলে বর্ষাকালে। এই সময়ের ফলগুলো পুষ্টিগুণে ভরা থাকে। পেয়ারা, লটকন, আমড়া, জাম্বুরা, জামরুল, ডেউয়া, কামরাঙা, কাউ, গাব ইত্যাদি বর্ষার ফল হলেও বাজারে গ্রীষ্মের ফল আম, কাঁঠালও থাকে। বর্ষাকালের ফলের মধ্যে নরসিংদী থেকে আসা লটকন,বরিশালের আমড়া পেয়ারা, রাজশাহীর টক-মিষ্টি বাতাবি লেবু বা জাম্বুরা, টাঙ্গাইল মধুপুর গড়ের আনারস কার না প্রিয়? সব বয়সী মানুষের পছন্দের ফুল এগুলো। ফুল ফল নিয়েই কিন্তু বাংলাদেশের ষড়ঋতুর চমক এই বর্ষা আসে না। সারাদিনের অঝোর বর্ষা আমাদের অন্তরে যেমন একটা সুন্দর ছন্দের দোলা দিয়ে যায় তেমনি প্রকৃতিতে এনে দেয় বিশাল সৌন্দর্য। বর্ষার জলে মাঠ-ঘাট,খাল-বিল টইটুম্বুর হয়ে পড়ে না কেবল। ধুয়ে মুছে সাফ করে দেয় সমস্ত ময়লা আবর্জনা, মানুষের দেহ মনে এনে দেয় সজীবতা। বর্ষাকে মাথায় নিয়ে আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতিতে সুরের ছন্দাবেশ ছড়ায়। ছোট্টবন্ধুরা আসো, প্রকৃতিকে জানি। বর্ষাকেও আমরা আপন করে নিই। প্রকৃতির ও যে সৌন্দর্য আছে সেটা অনুভব করি। তাই তো কবি নজরুলের সত্যেন্দ্র প্রয়াণ কবিতায় আমরা বর্ষাকে খুঁজি ভিন্ন আঙিকে ও আবহে-
“আজ আষাঢ়-মেঘের কালো কাফনের আড়ালে মু’খানি ঢাকি
আহা কে তুমি জননী কার নাম ধরে বারে বারে যাও ডাকি?
মাগো কর হানি দ্বারে দ্বারে
তুমি কোন হারামণি খুঁজিতে আসিলে ঘুম-সাগরের পারে?”