বৃষ্টিবলয় থেকে মুক্তি মিলবে কাল থেকে

64

কালবৈশাখী মৌসুমের প্রস্তুতি পর্বে বছরের তৃতীয় বৃষ্টিবলয় দেশের আকাশ অনেকটাই দখলে নিয়েছে ফাল্গুনের দি¦তীয় সপ্তাহে। একইসাথে আবহাওয়া পরিস্থিতির ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোররাত থেকেই চট্টগ্রামসহ দেশের দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় শিলাবৃষ্টি ও বজ্রঝড় আকারে তান্ডবলীলা অব্যাহত রেখেছে। বছরের এযাবত সবচেয়ে শক্তিশালী এই বৃষ্টিবলয়ের গতিমুখ এখন দেশের উত্তরাঞ্চলের দিকে। চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের একেবারে শেষদিন বিকালনাগাদ আকাশের দখল হারাবে বৃষ্টিবলয়। তার বিদায়েই স্বাভাবিক হবে সার্বিক আবহাওয়া পরিস্থিতি।
এদিকে, উত্তর বঙ্গোপসাগর এলাকায় বজ্রমেঘের ঘনঘটার বেড়ে যাওয়ায় দেশের সমুদ্রবন্দরসমূহে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাঝারি ধরনের ভারী বৃষ্টি ও কোথাও কোথাও শিলাবৃষ্টিরও পূর্বাভাস দিয়েছে। তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত মানে হল, বন্দর ও বন্দরে নোঙ্গর করা জাহাজগুলো দুর্যোগকবলিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বন্দরে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে এবং ঘূর্ণি বাতাসের একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার হতে পারে।
গতকাল মঙ্গলবার আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের সর্বশেষ সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, বজ্রমেঘের ঘনঘটা বৃদ্ধির কারণে উত্তর বঙ্গোপসাগর, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্র বন্দরসমূহের উপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে।পূর্বাভাসে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে। রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, বরিশাল, ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ী দমকা বা ঝড়ো হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সাথে কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী বৃষ্টি ও বিক্ষিপ্তভাবে শিলা বৃষ্টিও হতে পারে। এ সময়ের মধ্যে সারাদেশে রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে এবং দিনের তাপমাত্রা সামান্য কমতে পারে। গতকাল সোমবার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল তেঁতুলিয়া ও রাজারহাটে ১৪ দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সর্বোচ্চ ৩০ দশমিক দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে কক্সবাজারে।
আবহাওয়া পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত ২৪ ফেব্রæয়ারি দিবাগত ভোর রাতে বৃষ্টিবলয় দেশের দক্ষিণ হতে মধ্যাঞ্চলের অনেক এলাকায় আঘাত করে, এবং তা এখন পর্যন্ত এসকল এলাকায় কালবৈশাখী ঝড়সহ কোনও কোনও এলাকায় প্রবল বজ্রপাত ও শিলাবৃষ্টি ঘটিয়ে চলেছে। তবে এখনও রংপুর বিভাগসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের অনেক এলাকায় তেমন সক্রিয় হয়নি। ফেব্রুয়ারি একেবারে শেষদিকে এটি দেশের উত্তরাঞ্চলের অনেক এলাকায় ভারি বৃষ্টি আকারে দেখা দিতে পারে। বঙ্গোপসাগরে একটি উচ্চচাপ বলয় সৃষ্টি হয়েছে। একইসময়ে পূর্ব-মধ্য ভারতের ওপর একটি স্থল নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে। বঙ্গোপসাগরের উচ্চচাপ বলয় থেকে প্রচুর জলীয়বাস্প সমৃদ্ধ বায়ু ওই স্থল নিম্নচাপ এর দিকে এগিয়ে পশ্চিমা জেট বায়ুর সাথে সংঘর্ষ বাঁধিয়ে এবারের আংশিক শক্তিশালী বৃষ্টিবলয় তৈরি করেছে। বঙ্গোপসাগরে বায়ুচাপের তারতম্যের আধিক্য বিরাজমান থাকায় উত্তর বঙ্গোপসাগর উত্তাল রয়েছে। আগামী ২৮ ফেব্রæয়ারি দুপুরের পর দেশের সার্বিক আবহাওয়া পরিস্থিতি পুরোটাই স্বাভাবিক হয়ে আসতে পারে।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, দেশের কোনও কোনও অঞ্চলে এবারের আগাম কালবৈশাখীর প্রথম শিলাবৃষ্টির ধরণ স্থানীয় বাসিন্দাসহ অনেকের ‘চোখ কপালে’ তুলে দিয়েছে। বিশেষ করে রাজশাহীর পুঠিয়ায় শিলাবৃষ্টির তান্ডবলীলার সাক্ষী হয়ে স্থানীয় প্রবীণরা বলছেন, বিগত ৬০ বছরে এমন ভয়াবহ শিলাবৃষ্টি তারা আগে কখনও দেখেন নি। গত ১৭ ফেব্রæয়ারি ভোরের এই শিলাবৃষ্টির অসংখ্য ছবি এবং ভিডিওচিত্র গণ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ছবিগুলোর দিকে তাকালে দেশের প্রত্যন্ত জনপদের যে কোনও মানুষের চোখ হঠাৎ করে আটকে যেতেই পারে বিস্ময়ে! এমন দৃশ্য আমাদের দেশে খুব একটা পরিচিত নয়। দেখে মনে হবে ইউরোপ কিংবা আমেরিকার মত শীতপ্রধান কোনও দেশের তুষারপাতের দৃশ্য। শিলাবৃষ্টির তীব্রতা এতোটাই বেশি ছিল যে, গ্রামগুলোতে টিনের চাল ছিদ্র হয়ে ঘরেও শিলা ঢুকে যায়। শিলাবৃষ্টি থামার তিন ঘণ্টা পরও বাইরে চলাচল করা সম্ভব হচ্ছিল না। স্থানীয়রা কোদাল দিয়ে রাস্তায় জমে যাওয়া শিলা সরিয়ে চলাচলের উপযোগী করে। ৩৮ মিনিট স্থায়ী শিলাবৃষ্টিতে ১৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিকেলে দিল্লিতে অনেকটা একইধরণের শিলাবৃষ্টি হয়েছে। ধোঁয়াশা-দূষণের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকা দিল্লিতে শিলাবৃষ্টি কখনো-সখনো হয়, কিন্তু এত তীব্র শিলাবৃষ্টি শহরের অনেক বাসিন্দাই আগে দেখেন নি। সাথে সাথেই শোরগোল পড়ে যায় সামাজিক মাধ্যমে। বহু লোক ফেসবুক-টুইটার-হোয়াটস অ্যাপে শিলাবৃষ্টির ছবি ও বরফ-ঢাকা রাস্তায় গাড়ি চালানো কিংবা হৈ-হুল্লোড়ে মাতামাতির ছবি পোস্ট করতে থাকেন।
উল্লেখ্য, শীতের বিদায়ের পর বসন্তের প্রথম সপ্তাহেই আগাম কালবৈশাখী? জানান দিয়েছে প্রকৃতি। চট্টগ্রামের কয়েকটি এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মৌসুমের প্রথম তুমুল শিলাবৃষ্টি ও বজ্রঝড় কেড়ে নিয়েছে দুই শিশুসহ চার জনের প্রাণ। আমের মুকুল, গাছপালা ও ক্ষেতের ফসলের বুকে রেখে গেছে ক্ষতচিহ্ন। সর্বশেষ বছরের তৃতীয় ও আংশিক শক্তিশালী বৃষ্টিবলয় অব্যাহত রয়েছে।