বৃক্ষনিধন ও পরিবেশ দূষণের বিরূপ প্রভাবে বাড়ছে বজ্রপাত

39

লায়ন ডা.বরুণ কুমার আচার্য

প্রকৃতির আপন নিয়মের ধারায় বজ্রপাত আগেও ছিল। এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর একটি। তবে এখনকার সময়ে বাংলাদেশেও বজ্রপাতের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর তাই বর্তমানে বাংলাদেশে দুর্যোগে নতুন মাত্রা বজ্রপাত। জলবায়ু পরিবর্তন, বৃক্ষনিধন ও পরিবেশ দূষণের ফলে সা¤প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাত, বজ্রবৃষ্টি, বজ্রঝড়ের ব্যাপকতা বেড়ে গেছে। এতে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি বেড়েছে। বাড়ছে প্রাণহানিও। তাই বজ্রপাত ঘিরে জনমনে ভয়-আতঙ্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক দশকে দেশে বজ্রপাতে মারা গেছে প্রায় ৩ হাজারের কাছাকাছি। আহত হয়েছে কয়েক হাজার। বজ্রাঘাতে বাথানের গবাদিপশু মারা পড়েছে অসংখ্য। তাই এই বজ্রপাত, বজ্রঝড়ের আধিক্য সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ এবং সরকারি দায়িত্বশীলদেরও ভাবিয়ে তুলেছে। বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ২০১৫ সালের ২৭ আগস্ট বজ্রপাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে। বর্তমানে দেশে বজ্রপাতের ভয়ঙ্কর রূপ দেখা যাচ্ছে। বজ্রপাত ও এতে মৃত্যুর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছেই। সাধারণত এপ্রিল মাসকে বজ্রপাত শুরুর মাস হিসাবে ধরা হয়। সেপ্টেম্বর মাস পর্যšত বজ্রপাত হয়। কিন্তু এবার এপ্রিলেই ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে বজ্রপাত। গত এক মাসে দেশে বজ্রপাতে মারা গেছে কমপক্ষে শতাধিক জন। যা গত বছরের তুলনায় প্রায় চার গুণ। করোনাভাইরাসের কারণে চলমান পরিস্থিতিতে এ বছর বজ্রপাতে কম মৃত্যুর আশঙ্কা করেছিলেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু প্রথম মাসেই অনেক মৃত্যুর ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে তাদের। আর নিহতদের অধিকাংশই পুরুষ। এর মধ্যে অন্তত ২৫ জন কৃষক। বজ্রপাতে নিহতদের বেশিরভাগই কর্মঠ ব্যক্তি। এদের হারিয়ে একেকটি পরিবার দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে। সা¤প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়ে পরিবেশগত পরিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। বিশেষ করে জলবায়ুগত পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমনÑবন্যা, খরা, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদী ভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টি, বজ্রপাত ইত্যাদির প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে বেশ কিছু দিন ধরে বজ্রপাতে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি অতীতের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধি জলবায়ুগত এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের উপাদানের পরিবর্তনের ফল তা সহজেই বলা যায়। বজ্রপাত সারা বছরই কম-বেশি হয়। তবে মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বজ্রপাতের হার বেড়ে যায়। দেশে পাঁচটি জেলা সবচেয়ে বেশি বজ্রপাতপ্রবণ। এগুলো হচ্ছে শ্রীমঙ্গল, সিলেট, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর ও সৈয়দপুর। এই পাঁচটি জেলায় বছরে গড়ে ৩২৪, ৩২৪, ২০৬, ১৯৫ ও ১৭৯টি বজ্রপাত ঘটে। আর রাজধানীতে গড়ে বছরে বজ্রপাত ঘটে ১২৪টি। বজ্রপাতের প্রবণতা বেড়ে গেছে এটা সত্যি। বৈশ্বিক উষ্ণায়নও এর জন্য দায়ী। স¤প্রতি অস্ট্রেলিয়ার একজন গবেষক জানিয়েছেন, ১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বজ্রপাত ১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। বাংলাদেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব বৃদ্ধির সাথে সাথে খোলা জায়গায় কাজকর্ম ও চলাচল বেড়ে যাওয়া এবং জীবনযাত্রার (লাইফস্টাইল) পরিবর্তন যেমনÑমোবাইল সেলফোনসহ বিভিন্ন ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স সামগ্রীর (গেজেট) মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারও অনেকটা দায়ী। এ ধরনের কোনো কোনো যন্ত্রপাতি বজ্রকে উপর থেকে মানুষের দিকে টেনে নিয়ে এসে বিপদ ঘটাতে পারে। তাছাড়া শহর-নগরে সারি সারি বহুতল ভবন তৈরি হচ্ছে। সেসব অধিকাংশ উঁচু ভবনে বজ্র-নিরোধক না থাকায় আশপাশে খোলা জায়গা থাকলে সেখানে বজ্রপাত হচ্ছে। সাধারণ কথায় মেঘে মেঘে ঘর্ষণে বজ্র এবং তা মাটির সংস্পর্শে এলেই বজ্রপাত হয়। বজ্রের ভেতরে ৫০ হাজার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত ভয়াবহ তাপমাত্রা বা ‘সুপার হিট’ তৈরি হয়। যার শব্দ ১০ মাইল দূর থেকেও শোনা যায়। মূলত আকাশে বিদ্যমান জলকণাগুলোতে চার্জ সঞ্চিত হওয়ার কারণে বিপরীত পোলারাইজেশন তৈরি হয়। আর জলকণায় ব্যাপক চার্জ হওয়ার কারণে যখন তা ধরে রাখতে পারে না, নিচের দিকে চলে আসে, বজ্রপাত হয়। এছাড়াও সা¤প্রতিক বছরগুলোতে তাপদাহে বজ্রপাত বেশি হারে হচ্ছে। বজ্রপাতের হার আরো বাড়লে মানুষ হতাহতের ঝুঁকিও বেড়ে যাবে। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশে বজ্রপাতের মাত্রা এখন বেশি। এতে প্রাণহানি রোধে ব্যাপক জনসচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন। মিডিয়ার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভূমিকা এক্ষেত্রে সহায়ক। বিশেষজ্ঞরা বজ্রপাতের হার বৃদ্ধির কারণগুলো উল্লেখ করে বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণতা বৃদ্ধি, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া, পরিবেশ বিপর্যয়ের বিরূপ প্রভাব তো আছেই। সেই সাথে বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, খোলা জায়গা ও ডোবা-জলাশয় ভরাট, বন-জঙ্গল কমে যাওয়া বিশেষত তাল, সুপারি, নারকেল গাছের মতো উঁচু উঁচু গাছপালা হ্রাসের কারণে বজ্রপাতে প্রাণহানি বেড়ে যাচ্ছে। উঁচু বৃক্ষ বা এসব বজ্র-নিরোধক প্রাকৃতিক ‘টাওয়ার বৃক্ষ’ বজ্রপাতকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে মানুষের ক্ষয়ক্ষতি কমানোর প্রাকৃতিক ক্ষমতা রয়েছে। অতীতে এসব উঁচু গাছে বাজ পড়তে দেখা যেতো। বর্তমানে এসব বন উজাড় বা উঁচু বৃক্ষ নিধনের ফলে এ তা আর চোখে পড়ে না। মনে রাখতে হবে, সাধারণত মে মাস থেকে জুলাই পর্যন্ত প্রাক-বর্ষা ও বর্ষা মৌসুমে শুষ্ক ও গরম আবহাওয়ায় হঠাৎ আকাশে মেঘ জমলে বজ্রপাতের ঝুঁকি বেশি হয়ে থাকে এবং খোলা মাঠে-ময়দানে, বিলে, হাওর-বাওরে, নদীতে খোলা জায়গায় বজ্রপাত সরাসরি আঘাত করতে পারে এবং এতে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশি। এর ফলে প্রধানত কৃষক-কিষাণী, জেলে ও মাঝি-মাল্লা, শ্রমজীবি, পথচারীসহ খোলা জায়গায় বিচরণকারী মানুষ বজ্রপাতের শিকার হয় সবচেয়ে বেশি। আমাদের দেশে মে-জুলাইয়ে শুষ্ক আবহাওয়ায় বজ্রপাত হয় বেশি। ভরা বর্ষায় বজ্রপাত কম হয়। সাধারণ কিছু সতর্কতা মেনে চললে এই দুর্যোগে মৃত্যুহার কমানো সম্ভব। আমাদের দেশের মতো অনুন্নত দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুহার বেশি। কেননা বাইরে খোলামেলা জায়গায় থাকা কর্মজীবী মানুষের সংখ্যা বেশি। তাই সচেতন হলে এই ব্রজপাত থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। সাধারণত বজ্র নিচের দিকে নেমে আসার অল্পক্ষণ আগে (কেউ বাইরে থাকলে) শরীরের লোম, চুল হঠাৎ খাড়া হয়ে উঠতে পারে, যা বজ্রপাতের পূর্ব-লক্ষণ। তখনই দৌড়াদৌড়ি না করে দুই হাঁটুর মাঝখানে মাথা গুঁজে (মাতৃজঠরে থাকা সন্তানের মতো) থাকলে বিপদ এড়ানো যেতে পারে। বজ্রপাতের সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার বিপদজ্জনক হতে পারে। ধারে কাছে কেউ মোবাইল ফোন ব্যবহার করলেও বিপদের শঙ্কা আছে। তাছাড়া বিশেষজ্ঞদের দেয়া আরও পরামর্শের মধ্যে রয়েছে: (১) আকাশে ঘনকালো মেঘ দেখা দিলে বজ্রপাতের আশংকা তৈরি হয়। ৩০-৪৫ মিনিট বজ্রপাত স্থায়ী হয়। এ সময় ঘরে অবস্থানই নিরাপদ। (২) ঘনকালো মেঘ দেখা দিলে খুব প্রয়োজন হলে রাবারের জুতা পরে বাইরে যাওয়া যেতে পারে। (৩) বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গা, মাঠ বা উঁচু স্থানে থাকা নিরাপদ নয়। গাছের তলায় থাকা বিপদজ্জনক। (৪) যতদ্রæত সম্ভব দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে। টিনের চালা এড়িয়ে যেতে হবে। (৫) উঁচু গাছপালা বৈদ্যুতিক তার ধাতব খুঁটি, মোবাইল টাওয়ার থেকে দূরে থাকতে হবে। পরিহার করতে হবে ধাতব মাথা বের করে থাকা ছাতা। প্লাস্টিক বা কাঠের ছাতা ব্যবহার করা যাবে। (৬) বজ্রপাতের সময় গাড়ির ভেতরে অবস্থান করলে গাড়ির ধাতব অংশের সাথে শরীরের সংযোগ ঘটানো যাবে না। সম্ভব হলে গাড়িটি নিয়ে কোনো কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে। (৭) এ সময় বাড়িঘরে থাকলে জানালার কাছাকাছি বা বারান্দা পরিহার করতে হবে। বাড়ির জানালা বন্ধ রাখতে হবে এবং ঘরের ভেতরে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, ধাতব কল, সিঁড়ি, পাইপ স্পর্শ না করা নিরাপদ। (৮) বজ্রপাতের সময় সমুদ্র সৈকতে থাকা এবং ছাউনিবিহীন নৌকায় মাছ ধরতে যাওয়া নিরাপদ নয়। তবে এ সময় নৌকার ছাউনির নিচে অবস্থান করা উচিত। পানি থেকে দূরে থাকতে হবে। (৯) প্রত্যেকটি ভবনে বজ্রনিরোধক দন্ড স্থাপন ও আর্থিং ব্যবস্থা থাকা নিশ্চিত করতে হবে এবং তাল জাতীয় সুউচ্চ প্রজাতির গাছ প্রচুর পরিমাণে মাঠের মধ্যে লাগানোর ব্যবস্থা করতে হবে। বজ্রপাতে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা বৈদ্যুতিক শকে আহত ব্যক্তিদের মতো। শরীর থেকে দ্রুত বৈদ্যুতিক চার্জ অপসারণের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আহত ব্যক্তির অস্বাভাবিক আচরণে বিচলিত না হয়ে দ্রুত চিকিৎসা কেন্দ্রে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রচার-প্রচারণা চালনার মাধ্যমে জনসাধারণকে সচেতন করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যবইয়ে পঠিত বিষয় হিসেবে সংযুক্ত করতে হবে যেন শিক্ষার্থীরা বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত হয়। মনে রাখতে হবে বজ্রপাত সম্পর্কে জানা এবং করণীয় সম্পর্কে সচেতনতাই পারে বজ্রপাতের হাত থেকে জানমাল রক্ষা করতে। তাই ইচ্ছামাফিক পরিবেশ ধ্বংস করা বন্ধ করে তালগাছ জাতীয় উঁচু বৃক্ষরোপণে মনোযোগ দিলে এবং পরিবেশ ধ্বংস না করে সবুজ পৃথিবী গড়ার প্রত্যয় হতে পারে প্রাকৃতিক বিপর্যয় এই বজ্রপাত থেকে রক্ষার উপায়।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও মরমী গবেষক।