বুবুন শহর

105

চারদিক সোনা রং। রাত্রী আসলে চিক চিক করে সারা শহর। ডিম লাইটের আলো কিংবা সোডিয়াম আলোর রং সাদা না হয়ে সোনা রঙা আলো হয়। সোনা সোনা আলো। মানুষগুলো আমাদের মতোই। নাক কান চোখ মুখ সবই আছে। কিন্ত কোথায় যেনো অমিল। তাদের সভ্যতার সাথে আমাদের সভ্যতার বিস্তর তফাৎ।
আমি কোন এক দিন বন্ধু চিতই এর বাড়িতে বেড়াতে যাই। বাস, তারপর উটপাখি, তারপর পঙ্খিরাজের ঘোড়ায় চরে। চিতই খুব আগ্রহে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
ওর কাঁচের বাড়ি দেখে বিস্ময়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে দেখছিলাম। আমাকে দেখার জন্য ওর বোন মেরি আসলো। কিন্ত কোন কথা বললোনা। সোজা বেড়িয়ে গেলো। ঠিক পাঁচ মিনিটে বাদে দেখি ওর বোন আরো পাঁচজনকে সাথে নিয়ে আমাকে দেখার জন্য আসলো এবং সবাই দাঁত বের করে এক সঙ্গে হাঁসছে। শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে খিল খিল করে হাঁসছে। তবে সবার দাঁতগুলো নীলচে কালারের। হাঁসলে সামনের পাটির সব দাঁত বেড়িয়ে আসে। আমি ওদের হাঁসি দেখে হতভম্ব। চিতইকে বললাম। বন্ধু ঘটনা কি? “ চিতই হেঁসে বললো “একা একা হাঁসার নিয়ম নেই”। আমি বিস্মিত হলাম । এরপর চিতই আমাকে ডাইনিং রুমে নিয় গিয়ে খেতে দিলো।
একটা কলার অর্ধেক সাথে একটি রুটির চার ভাগের একভাগ।
আমি বললাম “বন্ধু এই দিয়ে আমার এই পেটুক পেটের কি হবে? “
চিতই হেঁসে বললো “হবে, তোমার পেট ভরে যাবে “।
তারপর সত্যি দেখলাম পেটের কোন জায়গা বাদ থাকলোনা। যে কলা, রুটি খেতে সময় লাগবে পাঁচ মিনিট। অথচ সময় লেগে গেলো পুরো বিশ মিনিট।
-এতো সময় লাগছে কেনো বন্ধু? চিতোই ইয়ার্কি করে বললো।
আমি বললাম। “কি জানি বন্ধু। তোমার কলা রুটিতে বুঝি আল্লার বরকতের ঝুড়ি ফুটো হয়েছে “। চিতই খালি হাঁসে আর হাঁসে।
রাত্রীতে ঘুমোতে দিলো একটা ঘরে। চোখে ঘুম আসছেনা। এরমধ্যে ভিষণ রকমের হই হুল্লোর কানে আসলে। চিতইকে জিজ্ঞেস করলাম।
– বন্ধু এতো হইচই কিসের?
-পাশের বাসায় বিয়ে হচ্ছে তাই। চিতই বললো।
কিন্ত এতো কান্নার আওয়াজ কেনো। মনে হচ্ছে শত শত মানুষ এক সঙ্গে কান্নার বাইজ ধরেছে। চিতইকে বললাম “বন্ধু তোমাদের বিয়ে কেমন, দেখাবে না?” চিতই বেড ছেড়ে আমাকে নিয়ে পাশের বাসায় আসলো। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম বিয়ের কালাকানুন দেখে। সত্যি সকলের চোখে পানি। হাউ মাউ করে সব কাঁদছে। লোক সংখ্যাতো প্রায় দু শ হবে। তারপর একটু ভির কেটে সামনে গেলাম। দেখি তাজ্জব কান্ড একটা। কন্যার কোমরে এবং বরের কোমরে লম্বা একটা মোটা পাটের দড়ি বেঁধেছে। তারপর দুই দড়ি টেনে এনে একটি খুঁটোর সাথে শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে। মাটিতে পোঁতা খুঁটোর চারপাশে বসে সবাই কাঁদছে। সুর করে করে সব কাঁদছে। তারপর কান্নার পিড়িয়ড শেষে সকলে মিলে আবার গীত ধরলো।
“তমাং তমাং কাছে লইওগো
পিড়িতের মধু খাওয়াইওগো”
এরকম আরো অনেক গীত। কিন্ত যা করছে এতোগুলো লোক এক সঙ্গে করছে। চিতই কখন হারিয়ে গেছে টের পাইনি। তারপর খুঁজে বের করে বললাম।
-বন্ধু কি ব্যাপার বলতো?
চিতই বললো।
-এখানে একা একা কিছু করা যায়না। সবাইকে নিয়ে করতে হয়। কান্নার কেউ না থাকলে লোকজন হায়ার করে এনে কাঁদতে হবে। এমন কি হাঁসলেও। তারপর এদেরকে খাওয়াইতে হয়।
আমি বললাম – বাহ! খুব মজারতো! কিন্ত বর কনেকে দড়ি দিয়ে খুঁটোয় বাঁধা কেনো বন্ধু?
– সকলের স্বাক্ষীতে দুইজনকে প্রেমের টানে টানানো হয়েছে।
– ওহ! সুইট বন্ধু। এমন নিয়ম যুজ্ঞেও দেখিনি।
পরের দিন গেলাম শহরে চিতইকে নিয়ে। ওদের বাসা থেকে অল্প। হাঁটার পাঁচ ছ মিনিটের পথ। চিতই ভদ্র স্বভাবের। দেখলাম শহরের প্রধান ফটকে পঙ্খিরাজের স্ট্যাচু। স্ট্যাচুর ভেতর দিয়ে সুড়ুঙ বয়ে গেলাম আরও কিছুদূর। >> চতুর্থ পৃষ্ঠায় দেখুন
>> তৃতীয় পৃষ্ঠার পর

তারপর আরেক বন্ধু মিদেন এর সঙ্গে দেখা। তিনজন হাঁটছি। আমি ও চিতই দুইজনই শ্যামলা বর্ণের। অথচ হাত মুখ সারা শরীর ডিমের মত সাদা হয়ে গেলাম। আর উঁচু থেকে ডিমলাইট এবং সোডিয়াম লাইটগুলো সোনা রঙের আলো দিচ্ছে। অনেকগুলো দোকানের গ�াসে দাঁড়িয়ে দেখলাম ক’বার। একই অবস্থা। শরীরের সব জায়গা ফকফকে সাদা। চিতইকে বললাম।
-আরে শালা তুই ডিম, আমিও ডিম, কারণ কি?
চিতই ফিক ফিক করে হেঁসে বললো।
-এটা বুবুন শহর। এখানে এলে সকলের রং সাদা হয় । আর এই সাদা রঙের ওপর লাইটগুলো সাদা আলো দিতে পারেনা। কারণ তখন কাউকে চেনা যায়না। তাই লাইটগুলো সোনার মত আলো দিয়ে সাদাকে আরও বেশি আকর্ষণ করে তোলে। এটা এখানকার বৈশিষ্ট।
আমি চিতই এর ব্যাখ্যা ব্ঝুলাম ঠিকই কিন্ত ভালোলাগার আগাগোড়ায় যেনো আরও রহস্য বিঁধে গেলো। শহরের লোকদের কথা খানিকটা বোঝা যায় আবার যায়ওনা। বেড়ালের মত মেঁও মেঁও মার্কা কথা। চিকন গলা। মিদেন আমার হাত ধরে একটি শপিং মলে উঠলো। নারী পুরুষ চেনার উপায় নেই। আমি একজনকে বললাম
– ভাইয়া টি শার্টটার প্রাইজ কতো?
ওমা। আমাকে এক থাপ্পর কষে দিলো গালে। বললোঃ আমি মেয়ে তুমি চিন্তে পাওনা?
আমি হতবাক। কি করে চিনবো। সবাই প্যান্ট শার্ট, গেঞ্জি পড়া। সবার বুক পুরু ষদের মতো সমান এবং চুল খাটো। নারীদের বৈশিষ্ট আলাদা- তা চিনবো কি করে। মিদেন লজ্জা পেলো আমাকে থাপ্পর মারা দেখে। কিন্ত প্রতিবাদ বা প্রতিকার করার সুযোগ নেই। মিদেন আমাকে পাশে নিয়ে গিয়ে কানের পাশে আসেÍ বললো “দোকানে প্রবেশ করার পর সবাইকে চোখ মারবি। যে এর উত্তর দেবে বুঝে নেবে সে নারী, তারপর আপা ভাইয়া ডাকবি”।
আমি আরও কতোই যে জানছি আর শিখছি। দোকানে ঢুকছি আর সবাইকে চোখ মারছি সমানে। যে নারী সে ঠিকই ছোট্ট করে চোখ মেরে উত্তর দিচ্ছে। ভাবও জমছে খুব। তবে দোকানীতে কেতাদুরস্ত। যা কিনবে একদামে এবং যাতে হাত দেবে তো সেটা নিতেই হবে।
আমি চশমায় হাত দিয়ে বললাম “প্রাইজ? উনি রীতিমত চশমাটা সোকেস থেকে বের দিলেন আমার হাতে। বললেন “পাঁচশ টাকা দিন”।
আমি বললাম “এটাতো আমার পছন্দ হয়নি”।বলতেই গালে কষে থাপ্পর হাঁকিয়ে দিয়ে বললেন “টাচ করেছেন ওটা নিতেই হবে ”
আমি দুঃখ পাইনি ভান করে বললাম “আপনার থাপ্পরটা বেশ সুন্দর চশমাটাও সুন্দর”।
চিতই শালারা আমাকে কিছু শেখায়নি। আমি থাপ্পর খাচ্ছি আর ওরা মিটমিট করে হাঁসছে। আমি বললামঃ কিরে এখানে কি থাপ্পরের চর্চা হয় নাকি? চিতই উত্তর না দিয়ে বললো “চল বেড়িয়ে যাই” ।
শমিংমল ত্যাগ করলাম তিনজন। এবার একটা ক্যাফেতে ঢুকলাম। মিদেন চিকেন ফ্রাই ওর্ডার দিলো। চিতই আরেকজনকে ড্রিংক আনতে বললো তিনটি। ফ্রাই মুখে দিতেই চমকে উঠলাম। যা তেতো আর নোনতা! মিদেন কানের কাছে বললোঃ মুখে মুখে একবার ‘বুবুন’ উচ্চারণ করে দেখ্। আমি তাই করলাম। ওমা! ফ্রাই দেখি হেব্বি টেস্ট দিচ্ছে। যা মজাদার! তোতো – নোনতা আর কিছুই নাই। এর পর ড্রিং আনলো। কূলুপ খুলতেই বিচ্ছিরি গন্ধ নাকে ঢুকলো। আমি খ্যাক খ্যাক করতেই মিদেন আবার বললো “ বুবুন “ বল্। আমি “বুবুন “বলে গোটা শিশি শেষ করলাম। কি স্বাদ আর ঘ্রাণ!
ওরা আমাকে স্মৃতিস্বরুপ একটি টি শার্ট কিনে দিলো অন্য মার্কেট থেকে। হলুদ কালারের। কিন্ত রঙের ভেতরে হলুদ পোকারা ঝিক ঝিক করছে। আমি বললাম “এটা গায়ে পড়া যাবে দোস্ত ? ”
মিদেন বললো “এই শহর ত্যাগ করলেই এই পোকারা আর ঝিক ঝিক করবেনা”।
মিদেনকে রেখে আমি চিতই ফিরলাম বাসায়। চিতই এর বাসায়। একটু পর নিজ দেশে রওনা দেবো । দুইজন বেসিনে গিয়ে ফ্রেস হলাম। এর মধ্যে মেরি আধা ছটাক আন্দাজের লেবুমিশ্রি শরবত এনে বললো।
-আপনার জন্য এটা। খুব যতনে নিজ হাতে করেছি।
আমি বললাম।
-তুমি খুব কিউট। বলতেই মেরি মুচকি হেঁসে চলে গেলো। আমি শরবতে চুমুক দিলাম। কিন্ত এই আধা ছটাক শরবত শেষ করতে পারলামনা। চিতই বললো।
– হে পেটুক বন্ধু, তুমি তো কিছুই খেলেনা। যা দেই সেটাই রেখে দিচ্ছো। ঘটনা কি?
– দোস্ত তোমাদের এখানে এসে বিয়া করুম। এখানে বরকত বেশি। আর আমার দেশে জনগনের ঠেলাই কোন বরকত নাই। এক কলস শরবতও চলে যায় পেটে। চিতই হাঁসে আর হাঁসে।
এর কিছুক্ষণ পর আমি রওনা দেবো ভেবে মেরিকে ডাকলাম।
– মেরি ও মেরি? মেরি আসলোনা। চিতই ভেতরে এসে দেখে মেরি খুব টেনশনে আছে। মেরি বললো “ওনাকে বিদায় জানাবো তা কাউকে খুঁজে পাচ্ছিনা ভাইয়া, তাওতো কমপক্ষে পাঁচজন লাগবে, ওই বাসায় কে যেনো মারা গেছে। সবাই ওখানে”। চিতইও চেষ্টা করলো । আর চারজন হলেই হয়। কিন্ত নাই কেউ। মরার বাসায় সবাই।
আমি মেরি মেরি বলে ডাকলাম আরও দুইবার। মেরি আসলোনা । চিতই বললোঃ মেরি কাউকে হায়ার করেও পাচ্ছেনা তোকে বিদায় জানাবে”। অবশেষে মেরি আসলোনা। আমি চিতইকে বুকে চাপড়ে ধরে টা টা বলে পথ ধরলাম।
মেরি তখন জানলার ফাঁক দিয়ে অনেকদুর পর্যন্ত যাওয়া দেখলো আমার ।