বুদ্ধের পথে বৌদ্ধ সন্যাসীরা

136

সুশান্ত বড়ুয়া

পৃথিবীতে যতো সাধু সন্যাসী আছেন, তাদের মধ্যে বৌদ্ধ সন্যাসীরা হচ্ছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন। শুধু ভিন্ন নয়, শিক্ষা দর্শনে জ্ঞান প্রজ্ঞায় অনেক এগিয়ে। সেই এগিয়ে থাকার মূলে রয়েছে বুদ্ধ দর্শন। ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা না করে যদি জীবন দর্শন নিয়ে আলোকপাত করি, তাতে সুষ্পষ্ট প্রতিয়ামান হয় যে বৌদ্ধ সন্যাসীরা শুধু সন্যাসী নন। তাঁরা এক একজন শিক্ষক, যেখানে বুদ্ধ মন্দিরগুলি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং যেখানে বুদ্ধ হলেন বিজ্ঞান, দর্শন এবং মানবতার প্রতীক এবং উদ্ভাবক।
অন্যান্য ধর্মের সন্যাসীদের তুলনায় বৌদ্ধ সন্যাসীরা ভিন্ন এবং বাস্তব ধর্মী। তার মূলে রয়েছে বিজ্ঞান সম্মত বুদ্ধ দর্শন। যেখানে সব ধর্মের সন্যাসীরা ঈশ্বরের আরাধনা নিয়ে ব্যস্ত, সেখানে বৌদ্ধ সন্যাসীরা নিজের জীবনকে পরিশুদ্ধ করে এবং অন্যদের জীবনকে পরিশুদ্ধ করে সঠিক পথে পরিচালিত করে। তাঁরা ঈশ্বরের আরাধনা করেনা। তারা ঈশ্বরের জন্য সময় নষ্ট করে না। স্বয়ং বুদ্ধ ঈশ্বরকে অন্ধকারে রেখে বৌদ্ধ সন্যাসীদের বাস্তবমুখী শিক্ষা দিয়েছেন। বুদ্ধ বলেছেন যে শোনা কথায়, পুস্তকের লেখায় বিশ্বাস না করে নিজ জ্ঞানে প্রজ্ঞায় বিচার বিশ্লেষণ করে যথার্থ সত্যটা গ্রহণ করতে হবে। এই হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্মের একটা গুরুত্ব পূর্ণ দর্শন এবং বিজ্ঞান সম্মত উক্তি। বিজ্ঞান যেমন অলৌকিক কিছুই বিশ্বাস করেন না, তা বিজ্ঞানের অনেক আগেই বুদ্ধ সেই পথ দেখিয়েছেন। তাই বৌদ্ধ ধর্মকে বিজ্ঞান সম্মত ধর্ম বলা হয়। আর সেই পথের পথিক বৌদ্ধ ভিক্ষুরা। বুদ্ধের অনেক দর্শনের মাঝে আমাকে অন্য একটা দর্শন মুগ্ধ করে তা হল- ‘একো পাসসেকু।’ অর্থাৎ এসো দেখো, বিচার করো, বিশ্লেষণ করো ভাল লাগলে গ্রহণ করো, অন্যথায় বর্জন করো। বুদ্ধের ন্যায় এমন উদাত্ত আহŸান কেউ করতে পারেননি।
প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকা কিংবা প্রত্যেক প্রাণীর প্রতি মৈত্রী পোষণ করা বুদ্ধের এই সব অভুতপূর্ব নীতি বৌদ্ধ সন্যাসীরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। শুধু পালন করেন তা নয়, সবার মাঝে সেই শিক্ষা প্রদান করেন। এই হচ্ছে বুদ্ধের মানবতা শিক্ষা। আর এই শিক্ষা গুলি চর্চা হয় বৌদ্ধ মন্দিরে। মূলতঃ বৌদ্ধ মন্দিরগুলি জ্ঞান প্রজ্ঞার চর্চা কেন্দ্র। যেখানে বুদ্ধের শিক্ষাগুলি জ্ঞান প্রজ্ঞায় পূর্ণ দর্শন।
বৌদ্ধ ধর্মের আরেকটা বিশেষ দিক হল পুনঃজম্ম বিশ্বাস। যার রয়েছে যথার্থ ব্যাখ্যা। যদি বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ব্যাখ্যা করি তাহলে বুঝা যাবে তার গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু। বিজ্ঞান বলে পৃথিবীতে শক্তির পরিমান নিদিষ্ট এবং তার বিনাশ নাই। তা কেবল রূপান্তরিত হয়। তা যদি সত্য হয়, তাহলে পুনঃজম্ম সত্য। কেননা- জীবের প্রাণ শক্তিও একটা শক্তি। সেই শক্তির বিনাশ নাই। কিন্তু রূপান্তর আছে। সেই রূপান্তরই হচ্ছে পুনঃজম্ম। তবে পুনঃজম্মের আগে প্রজম্মের মাধ্যমে প্রাণী তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে। আত্তা বিহীন বৌদ্ধ মতবাদে পঞ্চ ইন্দ্রীয় এবং কর্ম শক্তি সমন্বয়ে যে রূপান্তর তাই পুনঃজম্মের মৌলিক তত্ত¡।
বৌদ্ধ ভিক্ষুদের অন্য একটা দিক হল- তাঁদের বিলাসীহীন গেরুয়া বসন এবং চুল বিহীন মস্তক এবং সংসার বিহীন সমাজ নির্মাণ। সমাজের কোন যুবকটি পারবে এমন সাদাসিদা জীবন যাপন করতে। সব ভোগ বিলাস ছেড়ে মানব সমাজ নির্মাণে কাজ করছেন। তাঁদের ফলশ্রæতিতে আমরা পেয়েছি প্রাচীন নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়, তক্ষশীলা, ময়নামতি, পাহাড়পুর আরো অনেক। বুদ্ধের আবিষ্কার নিয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও সেই নির্বাণ পথে যে পথ শূন্য থেকে সৃষ্টি শূন্যতে বিলীন।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা-ত্রৈমাসিক অরুণোদয়