বিয়ে বিচ্ছেদ বাড়ছেই, ৪০ বছরের সংসারও ভাঙছে

92

উচ্চশিক্ষিত নওরিন ফারজানা (ছদ্মনাম)। গত দুইবছর ধরে বেসরকারি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করছেন। তিনি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পারিবারিক আদালতের বিচারক (যুগ্ম জেলা জজ) জাহানারা ফেরদৌসের কাছে এসেছেন স্বামীকে ডিভোর্স দিতে। কলেজ জীবনের শুরুতেই ফারজানার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ক্লাসমেট তানজিল চৌধুরীর (ছদ্মনাম) সাথে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের চার বছর মিলিয়ে ৬ বছর প্রেম করেছেন তারা দুইজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পসে তাদের পরিচিতি ছিল ‘বেস্ট কাপল’ হিসেবে। অনার্স শেষ করেই পারিবারিক সম্মতি আদায় করে সংসার পাতেন তানজিল-নওরিন। কিছুদিন সংসার করে উচ্চশিক্ষার জন্য সুদূর জার্মানিতে পাড়ি দেন তানজিল। তারপর মাস্টার্স শেষ করে চাকরি শুরু করেন নওরিন। দুই বছরের মাথায় তানজিলের দেশে ফিরে আসার কথা থাকলেও ফিরেছেন তিন বছর পর। চার মাস দেশে থেকে ফের জার্মানিতে ফিরে যান তিনি। তখনও সংসার টিকে ছিল, কিন্তু ভালোবাসার বড্ড অভাব অনুভব করেন নওরিন। দ্বিতীয়বার জার্মানিতে যাওয়ার পর হঠাৎ যোগাযোগ করার সবগুলো মাধ্যম ব্লক করে দেন তানজিল। তারপর শতচেষ্টা করেও ভালোবাসার জায়গায় ফিরতে পারেনি কাম্পাসের সেই ‘বেস্ট কাপলটি’।
তানজিলকে ডিভোর্স দিচ্ছেন নাওরিন। বিচ্ছেদের আবেদনে পারস্পরিক বোঝাপড়া না হওয়াকে কারণ হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন নওরিন। হয়ত এ দুইজনের সংসার সমীকরণে অনেক জটিল কিছু ঘটে গেছে। সেটা জানা না থাকলেও ভালোবাসার যে বড্ড অভাব ছিল, সেটা বুঝা কঠিন নয়।
গতকাল সকাল ১১টায় সিটি কর্পোরেশনের যুগ্ম জেলা জজ (স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট) জাহানারা ফেরদৌসের কার্যালয়ে সালিশি মামলার শুনানি চলছে। এ সময় হাজির হন এক বৃদ্ধ যুগল। তাদের সংসারের বয়স ৪০ বছর। সংসারে তিন মেয়ের সবার বিয়ে হয়ে গেছে। আর ছেলে দুইজন মাস্টার্স শেষ করে চাকরি খুঁজছেন। এ সময়ে এসে স্বামী আরিফ খান ( ছদ্মনাম) স্ত্রীকে ডিভোর্স দিতে চাচ্ছেন। কারণ স্ত্রীর যন্ত্রণা সহ্য হচ্ছে না তার। তিনি পেশায় একজন সরকারি চাকরিজীবী। তার স্ত্রী হাফেজা চৌধুরী (ছদ্মনাম)। তিনি সংসারে গৃহিণী হয়ে ৪০ বছর ধরে ছেলে- মেয়েদের মানুষ করে গেছেন। তার কাছে কারণ জানতে চান ম্যাজিস্ট্রেট জাহানারা ফেরদৌস। তখন হাফেজা চৌধুরী হেসে বুড়োর ভীমরতি ধরেছে বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও লুকোতে পারেননি চোখের জল। পরে অকপটে বললেন, আমার হাসি খুশির হাসি নয়, দুঃখের হাসি। গত ছয়মাস ধরে তিনি আলাদা বাসা নিয়ে থাকছেন। সবাইকে বলে বেড়াচ্ছেন আমাকে ডিভোর্স দিবেন। লজ্জায় কোথাও মুখ দেখাতে পারছি না। আর কদিন বাঁচবো বলেন, এ বয়সে এসব মানায়? এ সময় ম্যাজিস্ট্রেট তাদের বুঝিয়ে বললেন, এমন পরিণতি কখনও মেনে নেওয়ার মত নয়। অবুঝ বালকের মত নীরবে শুনছিলেন আরিফ খান। হঠাৎ চোখ দিয়ে পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন, আমাদের ডিভোর্স লাগবে না। আমরা একসাথে মিলেমিশেই থাকবো।
দুটো ঘটনা দুই মেরুর। তবে শেষেরটার পরিণতি থামানো গেলেও প্রথমটার পরিণতি বিচ্ছেদের পথে এগিয়েছে। তবে কারণটা ছিল অভিন্ন, দুটো সংসারেই ছিল প্রকৃত ভালোবাসার অভাব।
চসিক সূত্র জানায়, গত ১ বছরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের দুটি আদালতে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন জমা পড়েছে ৩ হাজার ৯৬৮টি। এছাড়াও ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৯২৮টি, ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৯৬১টি এবং ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৪৮৬টি বিয়ে বিচ্ছেদের জন্য আবেদন জমা পড়েছিল। বছরের পর বছর এভাবে বাড়ছে বিয়ে বিচ্ছেদের সংখ্যা। তবে এসব বিচ্ছেদ হওয়া বিয়ের শতকরা ৪০ শতাংশ প্রেমের এবং বাকি ৬০ শতাংশ পারিবারিক আয়োজনের বিয়ে বলে জানিয়েছেন সিটি কর্পোরেশন বিচারক জাহানারা ফেরদৌস। এমন ক্রমবর্ধমান বিয়ে বিচ্ছেদের কারণ জানতে চাইলে তিনি পূর্বদেশকে বলেন, বর্তমানে দেখা যাচ্ছে বিয়ে বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ স্মার্টফোনের প্রতি আসক্তি। কেননা দুই জনেই আলাদা স্মার্টফোন ব্যবহার করছেন। তাদের পারস্পরিক অনুভূতি বিনিময়টা কেড়ে নিচ্ছে স্মার্টফোনই। ফলে এক সময়ে গিয়ে তাদের মধ্যে বিস্তর ফারাক তৈরি হয়ে যায়। এভাবে একই সংসারে দুই জনের তৈরি হচ্ছে দুইটি আলাদা জগত। ফলে তারা একসময় পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে, তখনই বিচ্ছেদের সূত্রপাত হয়।
তিনি আরও বলেন, পারস্পরিক আস্থাহীনতা, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একে অপরের প্রতি সন্দেহ-অবিশ্বাসসহ নানা কারণে চট্টগ্রামে বিয়ে বিচ্ছেদের হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে। এছাড়া ফেসবুক, ইন্টারনেট ও মোবাইলের অপব্যবহারের মাধ্যমে সম্পর্কে জড়িয়ে বর্তমানে অধিকাংশ যুবক-যুবতী বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছেন। পরে একে অপরের প্রতি আস্থাহীনতাসহ নানা কারণে অধিকাংশ সংসার ভেঙে যাচ্ছে। তিনি বলেন, উচ্চবিত্ত এবং নি¤œবিত্তদের মধ্যে বিয়ে বিচ্ছেদের প্রবণতা বেশি। এছাড়া পারিবারিক কলহ, যৌতুক দাবিসহ নানা কারণে বিয়ে বিচ্ছেদের হার বেড়েছে।
বিয়ে বিচ্ছেদ ও প্রকৃত ভালোবাসার বিষয়ে বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত¡ বিভাগের প্রফেসর ড. গাজী সালেহ উদ্দিন পূর্বদেশকে বলেন, আমাদের সমাজে সামাজিক বন্ধনগুলো অনেক শিথিল হয়ে গেছে। আগের মত সেই অনুভূতি বিনিময় নেই। অর্থনৈতিক, সেক্সুয়াল, ধর্মীয় ও পারিবারিক অনুশাসন মেনে না চলা, ম‚ল্যবোধের অবক্ষয় এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ না থাকায় বাড়ছে বিচ্ছেদের ঘটনা। সমাজের কিছু ধারণা এসব সমস্যা রেখেই দিচ্ছে। আমরা শুধু বিয়ে বিচ্ছেদ দেখছি, পেছনের কারণটা দেখছি না। একটা ছেলে পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করতে বয়স ত্রিশ পেরুচ্ছে। তখন তার যৌবনকাল শেষের দিকে বললে চলে। কারণ তখন অনুভূতির চেয়ে শারীরিক চাহিদাই বেশি প্রাধান্য পায়। আবার সমবয়সীদের মধ্যে বিয়েও ঠিক না।
তিনি আরও বলেন, প্রযুক্তিকে আমরা ব্যবহারের চেয়ে অপব্যবহার বেশি করছি। আধুনিক প্রযুক্তিগুলোকে অনুভূতি শেয়ারের অনুষঙ্গ বানিয়ে ফেলছি। তাই আমাদের জীবনের সঙ্গীও প্রযুক্তির মত যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে। ফলে বিয়ে বিচ্ছেদের মত ঘটনা বেড়েই চলেছে।