বিষাক্ত নেশা সেবনে মানুষ কি মরতেই থাকবে?

338

বিষাক্ত নেশা সেবনে মানুষ মরছে; আর নেশাগ্রস্তরা সুস্থ্য মানুষ নেশার ঘোরে হত্যা করছে। এমনটাই চলছে দেশে। মদকের নেশায় এদেশের হাজার হাজার পরিবার আজ পথে বসেছে। ইয়াবা, ফেন্সিডিল, হেরইন আর মদ্যপান করে মানুষ কেবল অসুস্থ আর বিকারগ্রস্ত হচ্ছে না, ঘটছে মানুষের জীবনহানীও। বিষাক্ত মদ্যপানে মানুষের মৃত্যুর খবর আমরা প্রায়সই পাচ্ছি।৬ জুলাই একটি সংবাদে আমার চোখ আটকে যায়। রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার হারাগাছে চোলাই মদপান করে পাঁচজনের মৃত্য। আশংকাজনক অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে আরো ২ জন।স্থানীয় প্রশাসন এবং ভুক্তভোগীদের পরিবার মদপানে মারা যাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছে।
বিষাক্ত মদ পানে মানুষ মারা যাবার ঘটনা ঘটছে; সরকারের সংশ্লিষ্টরা কি করছে? এ মুহ‚র্তে দিন তারিখ আর স্থান মনে নেই, স¤প্রতি একই পত্রিকায় পাব্যত্য কোন জেলায় এক ব্যক্তি মদের নেশায় নিজের স্ত্রী আর কন্যাকে হত্যা করেছে বলে সংবাদপত্রে দেখেছি। স্ত্রী কন্যাকে হত্যা করে তাঁর ছোট ছেলেটিকেও গলাতেও কোপ বসিয়ে দিয়েছিল ঐ নেশাগ্রস্ত বাবা। মুম‚র্ষ অবস্থায় হাসপাতালে থাকা ঐ সন্তানের ভাগ্যে পরবর্তিতে কি ঘটেছে তা আর পরে জানতে পারিনি। নেশা সেবনে মানুষ মরছে; নেশা সেবন করে নেশাগ্রস্তরা মানুষ মারছে। এমন অসংখ্য ঘটনার জন্ম দিচ্ছে নেশাগ্রস্ত মানুষ।
মাদক আর মাদকাসক্ত মানুষ আমাদের সত্যিই ভাবিয়ে তুলেছে। এদের কর্মকান্ডে আমরা; আমাদের দেশ প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবুও দেশ থেকে কেন মাদক নিয়ন্ত্রণ করা হয় না? প্রশ্ন হলো, যারা মাদক নিয়ন্ত্রণ করবেন কী করছেন তারা? দু/চারজন চুনপুটিকে ক্রসফায়ারের আওতায় আনলেই মাদক রোধ হবে এমনটা না। মাদকের মূলউৎপাটন করতে হবে। গডফাদারদের ধরে আইনের আওতায় আনতে হবে। মাদক পাচার, ব্যবসা ও ব্যবহারকারীর ক্রমপ্রসার রোধকল্পে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে নানারকম কার্যক্রম দেখা গেলেও তেমন কোনো ইতিবাচক ফল মিলছে না। মাদক শুধু একজন ব্যক্তি কিংবা একটি পরিবারের জন্যই অভিশাপ বয়ে আনে না, দেশ-জাতির জন্যও ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনছে। নানারকম প্রাণঘাতী রোগব্যাধি বিস্তারের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও খারাপ করে তুলছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় দেশের অভ্যন্তরে মাদকের বিকিকিনি এবং বিভিন্ন সীমান্তপথে দেশের অভ্যন্তরে মাদকের অনুপ্রবেশ নিয়ে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগও দীর্ঘদিনের। এবার পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে মাদক ব্যবসার অত্যন্ত নিরাপদ স্থানগুলোর একটি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। কারারক্ষীদের সতর্ক পাহারা থাকতেও যদি কারাগারে মাদক ঢুকতে পারে তাহলে সারাদেশের অবস্থা যে কী তা সহজেই অনুমান করা যায়। দেশের প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় মাদকদ্রব্য বিকিকিনির বিষয়টি বলতে গেলে ওপেন সিক্রেট। বিভিন্ন সময়ে পুলিশি অভিযানে মাদকদ্রব্য আটক ও জড়িতদের আটকের কথা শোনা গেলেও মাদক ব্যবসার নেপথ্যে থাকা গডফাদারদের আটক করা হয়েছে কিংবা দৃষ্টান্তম‚লক শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে এমন কথা শোনা যায় না। ফলে মাদকবিরোধী নানা অভিযানের কিছুদিন যেতে না যেতেই আবারো নতুন করে মাদক ব্যবসার প্রসার ঘটে। মাদক ব্যবসায়ীদের প্রধান টার্গেট হচ্ছে তরুণ সমাজ। দেশের তরুণ সমাজ মাদকের ভয়াবহ প্রভাবে বিপথগামী হচ্ছে। মাদকের নীল ছোবলে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আমাদের আগামী প্রজন্ম। যা একটি দেশের ভবিষ্যতের জন্য ভয়াবহ দুঃসংবাদ। সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার প্রকট রূপের পেছনে মাদক অন্যতম বড় একটি উপসর্গ হয়ে দেখা দিয়েছে। এর মতো উদ্বেগজনক ঘটনা আর কী হতে পারে?
২০১৭ এর শেষের দিকে, লায়ন্স ক্লাবের বাংলাদেশ দলের সাথে মিয়ানমার সফরের অভিজ্ঞতা আমাকে বেশ ব্যথিত করে। বাংলাদেশ ঘেঁষা সীমান্তে মিয়ানমারে অসংখ্য ইয়াবা কারখানা গড়ে উঠেছে। সে সব কারখানায় কোটি কোটি পিস ইয়াবা তৈরি হচ্ছে। অবাক করা কথা, মিয়ানমারের মানুষ, সেখানকার যুবসমাজ খুব একটা ইয়াবা আসক্ত নয়। কোনো কোনো এলাকায় তো ইয়াবা কী- অধিবাসীরা জানেনই না। ম‚লত বাংলাদেশিদের জন্যই সেখানে ইয়াবা কারখানা গড়ে উঠেছে। যতদ‚র জানতে পারি, তাতে নাকি এ ব্যাপারে সে দেশের সরকারের মৌন সম্মতিও আছে। মিয়ানমার সীমান্তে ইয়াবা কারখানার কথা আমরা জানি, আমাদের সরকারও জানে, কিন’ ইয়াবা চোরাচালান রোধ হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না? মিয়ানমার ইয়াবা তৈরি করে প্রতিদিন আমাদের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে, তাতে আমাদের যুবসমাজ ইয়াবা আসক্ত হয়ে ধ্বংসে নিপতিত হচ্ছে। কী করছি আমরা? আমাদের সরকারও কী করতে পারছে? এতে সরকারের সম্মতি আছে এ কথা বলার সুযোগ নেই, তবে সরকারে কর্তাবাবুদের ম্যানেজ হয়ে যাওয়ার কারণে মাদককারবারিরা প্রতিদিন দেশে মাদকে সয়লাব করে দিচ্ছে। মাদক তথা ইয়াবা ব্যবসা নির্বিঘ্ন হচ্ছে তা বলছি না। মাদক কারবারিরা ধরাও পড়ছে মাঝে-মধ্যে। যে দিন এ লেখাটি লিখছি- ২৫ আগস্ট কক্সবাজারের টেকনাফে ১ লাখ পিস ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করেছে বিজিবি। তবে এ সময় কাউকে আটক করতে পারেনি। ১ লাখ পিস ইয়াবা সে কি সহজ কথা? ১ লাখ লোক আসক্ত হতে পারবে এ ইয়াবায়। দামও তো কম নয়। বাজারম‚ল্যে কম করে হলেও ৫ কোটি টাকা। এত টাকার মাদক ধরা পড়লো আর কাউকে গ্রেপ্তার করা গেলো না এটা প্রশ্ন সামনে আসে বৈকি! এই তো হচ্ছে বেশিরভাগ সময়। যারা মাঝে-মধ্যে ধরা পড়ে তারা কেবল চুনোপুঁটি। আবার ওদের গডফাদারদের বদান্যতায় সহজেই ছাড়া পেয়ে যায়। দেশের প্রতিটি সীমান্তেই এমন হচ্ছে। ভারতের সীমান্তেও অসংখ্য ফেনসিডিলের কারখানা আছে। সেখানেও এই একই অবস্থা। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো আমাদেরও দেশে মাদকের বাজার তৈরি করে নিয়েছে। এ জন্যই হয়তো দেশ মাদকে সয়লাব হচ্ছে। মাদক ব্যবসার সাথে দেশের অনেক রাঘববোয়াল জড়িত। তাই ওদের টিকিটিও ছোঁয় না কেউ। যা হওয়ার তাই হচ্ছে দেশে। আমরা দেশবাসী দুর্ভাগা বলেই আমাদের যুবসমাজ সহজে মাদক হাতের নাগালে পাচ্ছে। এ সংক্রান্ত আইনের তেমন শাসন সক্রিয় নয় বলে আমাদের সন্তানরা দিন দিন অধঃপতনে নিপতিত হচ্ছে।
মাদক সেবনের কুফল সম্পর্কে মহাসমারোহে আলোচনা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়। বিভিন্ন এনজিও মাদক সেবন নিরুৎসাহিত করতে বিভিন্ন কর্মস‚চি গ্রহণ করে। মাদক পাচার, বহন ও ব্যবহারের বিভিন্ন শাস্তি রয়েছে। তবু মাদক ব্যবহার কমেনি। ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইন, ইয়াবা, প্যাথেডিনের ব্যবসা রমরমা। নারী, পুরুষ উভয় শ্রেণির মধ্যে মাদক সেবন প্রবণতা বাড়ছে। ডিশ এন্টেনার যুগে বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন এ দেশের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীকে সমকামী, নেশাগ্রস্ত ও পশুপাখি সহযোগে বাস করার মানসিকতা তৈরি করছে। ঘুমের ওষুধ, হেরোইন, গাঁজা, এমনকি কুকুর মারার ইনজেকশন সেবন করছে মাদকসেবীরা। বিষ শরীরে ঢুকিয়ে নেশা করার মতো অভ্যাস গড়ে উঠছে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। এ ব্যাপারে প্রশাসন নির্বিকার। কাজের কাজ কিছুই করে না। করবেই বা কেন? মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন জানে এ সব। জানে কোথায় মাদকদ্রব্য বিক্রি হয়, কোথা থেকে আসে এসব আর কারাই বা বিক্রি করে তা। এর সবই তাদের নখদর্পণে। যদিও এ সব ধরার দায়িত্ব তাদের। কিন্তু মাদক ব্যবসায়ী গডফাদারদের ধরা তো দ‚রের কথা, সংশ্লিষ্টরা এর পাড় ঘেঁষেও দাঁড়াতে রাজি নয়। সময়মতো মাসোহারা পেলেই তারা তুষ্ট। নিজেদের উদরপূর্তি হলেই হলো। নগদ পেলে তো সবার মুখেই কুলুপ এঁটে থাকে; তখন চোখ হয় অন্ধ। আর এ সুযোগে নেশার রাজ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে গোটা দেশের যুবসমাজ। এগুলোকে ঘিরে পারিবারিক ও সামাজিক শান্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ঘটছে সহিংস ঘটনা। বেড়েছে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি। তবে মাদক বিক্রেতাদের যে পুলিশ একেবারেই ধরছে না তা নয়। মাঝে মাঝে মাদকসহ ২/৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হলেও মাদক বিক্রেতারা আইনের ফাঁক-ফোকরে আবারও জেল থেকে বেরিয়ে এসে পুনরায় ব্যবসা পরিচালনা করছে।
আমাদের বর্তমান সমাজজীবনে মাদকের ব্যবহার সবাইকেই উদ্বিগ্ন করেছে। এর বিষাক্ত ছোবল অকালে কেড়ে নিচ্ছে অনেক প্রাণ। অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণী হচ্ছে বিপথগামী। এ থেকে পরিত্রাণের আশায় ১৯৯০ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন (১৯৯০ সালের ২০ নম্বর আইন) প্রণীত হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনকল্পে ওই আইন ১৯৯০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি প্রণয়ন করা হয়। ওই আইনের ২(ঠ) ধারায় মাদকের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। সে মতে ম‚লত অপিয়াম পপি বা তৎনিঃসৃত আঠালো পদার্থ- আফিম; আফিম থেকে উদ্ভ‚ত মরফিন, কোডিন, হেরোইন ইত্যাদি এবং এদের ক্ষারগুলো; শতকরা ০.২%-এর অধিক মরফিনযুক্ত যে কোনো পদার্থ, কৃত্রিম উপায়ে তৈরি আফিমের সমধর্মী দ্রব্য যথা- পেথিডিন, হাইড্রোমরফিন, ডিমেরাল, বেটাপ্রোডাইন ইত্যাদি, কোকা পাতা এবং তা থেকে উদ্ভ‚ত সব দ্রব্য, কোকেন এবং ০.১%-এর অধিক কোকেনযুক্ত যে কোনো পদার্থ অথবা কোকেনের যে কোনো ক্ষার, চরস, হাশিশ, গাঁজাগাছ, গাঁজা, ভাংগাছ, ভাং, গাঁজা বা ভাং সহযোগে প্রস্তুত যে কোনো পদার্থ, এ্যালকোহল এবং ০.৫%-এর অধিক এ্যালকোহলযুক্ত যে কোনো পদার্থ, রেক্টিফাইড স্পিরিট এবং তৎসহযোগে যে কোনো ওষুধ বা তরল পদার্থ, বিয়ার, বারবিচুয়েটস, তাড়ি, পচুই, মেথিলেটেড স্পিরিট ইত্যাদি দ্রব্য মাদক হিসেবে পরিচিত। ভারতে তৈরি ফেনসিডিল সিরাপ আমাদের দেশে মাদক হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এ সিরাপের একটি গুরুত্বপ‚র্ণ উপাদান আফিম থেকে উদ্ভ‚ত কোডিন, এ কারণেই ফেনসিডিল সিরাপ সেবন করলে মাদকতা আসে। তাই ফেনসিডিল সিরাপ মাদক হিসেবে পরিচিত। এ্যালকোহল ব্যতীত অন্য কোনো মাদকদ্রব্যের চাষাবাদ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বহন, পরিবহন, আমদান্তিরপ্তানি, সরবরাহ, ক্রয়, বিক্রয়, ধারণ, সংরক্ষণ, গুদামজাতকরণ, প্রদর্শন, প্রয়োগ ও ব্যবহার ওই আইনের ৯ ধারায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর নবম দশকে (১৯৮১ থেকে ১৯৯০ সাল) বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে মাদকের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় বিদেশ থেকে আসা মাদক সম্পর্কিত অপরাধের বিচার করা হতো ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন অনুসারে। সেখানে শুধু শুল্ক ফাঁকি দিয়ে চোরাপথে আমদানি নিষিদ্ধ পণ্য দেশে নিয়ে আসা বা নিজ হেফাজতে রাখার অপরাধেই আসামির বিচার হতো। জনজীবনে ব্যাপক ক্ষতি সাধনকারী এই মাদকসংক্রান্ত অপরাধ দমনের জন্য ওই আইন পর্যাপ্ত ছিলো না। তাই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনকল্পে ১৯৯০ সালে ‘মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন’ প্রণয়ন করা হয়। ১৩৯৬ বঙ্গাব্দের ১৯ পৌষ মোতাবেক ১৯৯০ সালের ২ জানুয়ারি তারিখ থেকে এ আইন কার্যকর হয়। কিন’ কুড়ি বছরেরও অধিককাল পথপরিক্রমায় মাদকদ্রব্য ব্যাপকভাবে নিযন্ত্রিত হয়নি। এর ব্যবহার এবং প্রসার বেড়েই চলেছে। অভিভাবকরা আজ চিন্তিত তাদের সন্তানদের মাদকাসক্তি নিয়ে। মাদকের হিংস্র ছোবল থেকে সারা জাতি চায় আত্মরক্ষা করতে। আইনের কার্যকর প্রয়োগ হয়নি বলেই আজ মাদক নিয়ে এত সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। বেড়েছে উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ।
দেশে মাদক যেন মুড়ি-মুড়কির মতো বিকিকিনি হচ্ছে। পত্রিকার স‚ত্র মতে, দেশে বছরে ২৫ হাজার কোটি টাকার মাদক কেনাবেচা হয়। মাদক গ্রহণকারীর সংখ্যা কত তার সঠিক পরিসংখ্যান কারও কাছে নেই। সরকার বলছে, ৫০ লাখ, কিন্তু বেসরকারি স‚ত্র মতে, ৭০ লাখেরও বেশি। এদের অধিকাংশই যুবক-যুবতী ও তরুণ-তরুণী। মাদক গ্রহণকারীর ৮০ ভাগের বয়স ১৫ থেকে ৩৫ বছর। বিশ্বের নেশাগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭ম। এর ভয়াল থাবা বিস্তৃত হয়েছে শহর হতে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত। বিভিন্ন মাদকের মরণনেশায় প্রতিদিন আক্রান্ত হচ্ছে ৮-১০ বছরের শিশু হতে শুরু করে নারী এমনকি বৃদ্ধরাও। ২০০২ সালে দেশে মাদক অপরাধীর সংখ্যা ছিল ৬ শতাংশ। বর্তমানে তা ৪০ শতাংশের বেশি। এর ব্যবসা জমে ওঠেছে দেশে। মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও লাওস নিয়ে গঠিত ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’, ভারত, নেপাল ও তিব্বতের সীমান্তবর্তী অঞ্চল নিয়ে ‘গোল্ডেন ওয়েজ’ এবং পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরানের সীমান্তবর্তী অঞ্চল নিয়ে ‘গোল্ডেন ক্রিসেন্ট’ বাংলাদেশকে ঘিরে ফেলেছে। ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম মাদক উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের থাবার মধ্যে অবস্থান করছে। বাংলাদেশকে ঘিরে প্রতিবেশী দেশের সীমান্তে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার ফেনসিডিলের কারখানা। সংঘবদ্ধ চক্র মিয়ানমার হতে কক্সবাজার দিয়ে সারাদেশে সুকৌশলে ছড়িয়ে দিচ্ছে ইয়াবা। নতুন নেশা ইয়াবার ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছে তরুণ সমাজ। বিশেষ করে স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয়গামী ছেলেমেয়েরা। ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবার কোনটি দেশে উৎপাদিত না হলেও তা পাওয়া যাচ্ছে যত্রতত্র। সামাজিক সমস্যা ছাপিয়ে এটি যেন গত দু’দশকে পারিবারিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। প্রায়ই চোখে পড়ে মাদকের করাল গ্রাস থেকে ফেরাতে না পেরে পরিবারের শান্তি রক্ষায় বাবা-মা তার সন্তানকে, সন্তান বাবাকে পুলিশে সোপর্দ করছেন। মাদকাসক্ত সন্তানের হাতে পিতা-মাতা খুন্তজখমের ঘটনা অহরহ ঘটতে শুরু করেছে। সন্তানের নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত বাবা-মা ও সমাজের দৃষ্টি রাখা দরকার।
আশির দশকে বাংলাদেশে মাদকের বিস্তার শুরু হয় মর্মে বিভিন্ন তথ্য মেলে। এ সময় লুকিয়ে-চুরিয়ে, প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে মাদক বিক্রি করা হতো। মাদক বিক্রি এখন আর অতটা গোপনে নেই বলেই প্রতীয়মান হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে জানা যায়, রাজধানীতে ডিজে পাটির্র নামে বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় মাদকের রমরমা আসর বসে। এখানে সাধারণত ধনী পরিবারের তরুণ-তরুণীদের যাতায়াত। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গামী তরুণ-তরুণীরাই ম‚লত মাদকের নেশায় বুঁদ। মাদক এখন আর অলিগলিতে নয়, এর বিস্তার ঘটেছে ভদ্র সমাজে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও মাদকের ভয়াবহ বিস্তার ঘটেছে বলে এর আগে উল্লেখ করেছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব। আর এবার খোদ কারাবেষ্টনীতে মাদকের নিরাপদ বিস্তারের কথা জানা গেলো। এ ঘটনাকে শষের্র মধ্যে ভ‚ত বলেই অভিহিত করা যায়। মাদকের ভয়াবহ আগ্রাসন শুধু নগর-মহানগরেই সীমাবদ্ধ নেই, গ্রামবাংলা পর্যন্ত মাদক এখন সহজলভ্য। হাত বাড়ালেই পাওয়া যায় মাদক। তবে মাঝে-মধ্যে মাদকদ্রব্য বহনের দায়ে কেউ কেউ ধরা পড়লেও ম‚ল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকে। দৃশ্যের আড়ালে এই যে অদৃশ্য মহাশক্তিধর চক্রটির জন্যই মাদকের ক্রমবিস্তার রোধ হয়ে উঠেছে অসম্ভব।
সুতরাং আমরা মনে করি মাদক সংশ্লিষ্ট চুনোপুঁটি থেকে রাঘব-বোয়াল পর্যন্ত প্রত্যেকের ব্যাপারেই আইন প্রয়োগে কঠোরতা দেখাতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগই মাদকের ভয়াবহ বিস্তার রোধে সহায়ক হতে পারে। মাদক আমাদের সমাজকে কীভাবে কুঁরে কুঁরে খাচ্ছে তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এ সমস্যা সমাজ ও রাষ্ট্রের। দেশের উদীয়মান শ্রেণি যদি সমাজ বৈশিষ্ট্যের বিরূপতার শিকার হয় তাহলে দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। দেশকে রক্ষা করতে হলে সংশ্লিষ্টদের অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করতে হবে। পরিস্থিতি উত্তরণে মাদকাসক্তি, যৌনাচার এবং পর্নোগ্রাফি প্রতিরোধে সুচিন্তিত ও সমন্বিত কর্মপন্থা গ্রহণ করা দরকার। একটি প্রজন্ম ধ্বংস হওয়ার আগে আমাদের সবার দায়িত্ব হবে দেশ থেকে মাদক নির্ম‚ল করা। এ জন্য দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি সবাই যে যার জায়গা থেকে মাদকের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। হুঙ্কার দিতে হবে দেশ থেকে মাদক নির্ম‚ল করার। আমরা বিশ্বাস করি রাষ্ট্রের কাছে মাদক সিন্ডিকেট মোটেও শক্তিশালী নয়। রাষ্ট্র চাইলে দেশের মাদক প্রসারতা কমবে। আর রাষ্ট্র তা সহসাই করবে এ প্রত্যাশা রইলো।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট