বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপট

74

২০০৮ সালের বিশ্বমন্দার পর থেকে বিশ্বরাজনীতি এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষনীয়। ২০১৬ সালে চীনা মুদ্রা ইয়ান বিশ্বমুদ্রায় পরিচিতি লাভ করে। মার্কিন মন্দার পর পরই ২০০৯ সালে গ্রিস পরে ঋণ সংকটে। ইউরোয়িান ইউনিয়নভুক্ত দেশ সমূহের মধ্যে একাঙ্গীকরণ প্রক্রিয়া জোরদার করতে শুরু করে অপর এই সময়ে ইৎবীরঃ (অর্থাৎ ঊট থেকে ব্রিটেনের) বেরিয়ে প্রকিয়া শুরু হয়। আবার ২০১৪ সালের শেষ পর্যায়ে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের ঋঊউ ফাÐ রেইট বাড়াতে শুরু করে যা আজ অবধি উর্ধমূখী। আবার উন্নয়নশীল দেশ সমূহ বিনিয়োগ প্রবাহ কমতে শুরু করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার পরবর্তী পর্যায়ে শুল্ক বিরোধের মাধ্যমে অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বিশেষ করে চীনের সাথে অর্থনৈতিক যুদ্ধ যা কিনা চীনদেশের থেকে আমদানী করা পণ্যের ওপর ২৫% শুল্ক আরোপ। মধ্যপ্রচ্যে বিনিয়োগ এবং মার্কিন অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষা এবং মানবাধিকার রক্ষার নামে বিশ্ব রাজনীতিতে ঝুঁকি ও সংঘাত বৃদ্ধি। উত্তর কোরিয়াতে ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা, সিরিয়া ও ইয়ামেনে সংঘাত। ইরানে মার্কিন অবরোধ। বিশ্ব শক্তি ধর রাষ্ট্র হিসেবে ইরানের হুমকী মার্কিন প্রশাসনকে ভাবিয়ে তুলেছে। জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন ও মর্যাদা হরণ ৩৭০ ধারা বাতিল কাশ্মীরে সহিংসতা বৃদ্ধি এবং পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধংদেহি মনোভাব। আর একটি নব মাত্রা যুক্ত করেছে বলা যায়।
২০০৮ সালে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার মুখে ও বাংলাদেশের ওপর তেমন অর্থনৈতিক ঝড়-ঝাপটা উপলব্ধি হয়নি। তখন ও আমাদের মুদ্রাস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে ছিলো। কর্মসংস্থান ঠিকটাক ছিলো বেকারত্ব ও দারিদ্রতা নিম্নমুখী ছিলো। পোশাক খাতে রপ্তানী প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যনীয় পর্যায়ে ছিলো। প্রাইভেট বিনিয়োগ প্রভাব ২০১০ সাল পর্যন্ত ভালো অবস্থায় ছিলো ২০১১,২০১২তে বিনিয়োগ ধ্বস নামলেও ২০১৪ থেকে বিনিয়োগ প্রবাহ অধঃমুখী ২০১৪ অর্থ বছরে এউচ সরকারী ও বেসরকারী বিনিয়োগের অনুপাত ছিলো ২৪:৭৬ আবার ২০১৮ অর্থবছরে ২৬:৭৪ তবে একই সময়ে এউচ তে মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ২৮.৮৯% ভাগ থেকে ৩১.৪৭ ভাগে উন্নীত হয়েছে। এই বর্ধিত বিনিয়োগ অর্থনৈতিক কর্মকাÐে ব্যাপৃত করা গেলে এবং রপ্তানী উন্নয়নে অবদান রাখতে পারলে বহিঃখাতের বর্তমান চাপ সামাল দেয়া যাবে।


বাংলাদেশের বহিঃখাত পর্যালোচনা করলে দৃশ্যমান হয় এখাতের চলিত হিসাব দীর্ঘদিন ধরে উদ্বৃত্ত থাকার পর জুন ২০১৮ এর সমাপ্ত অর্থবছরে প্রায় ৯.৮ বিলিয়ন ঘাটতি। জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০১৮ ত্রৈমাসিকে এ ঘাটতি ১.৩ বিলিয়ন। এ ভাবে যদি ঘাটতিজনিত কারণে বৈদেশিক রিজার্ভ ক্ষয়প্রাপ্ত হলে সমপরিমাণ রিজার্ভ ক্ষয়প্রাপ্ত হবে। এ পরিস্থিতিতে দেশীয় মুদ্রার মূল্যমানের উপর চাপ করবে। তখন টাকার অবমূল্যায় হবে।
২০১৮ অর্থবছরে দেশের সঞ্চয় ও বিনিয়োগের পার্থক্য ছিলো এউচ এর (-) ৩.৮২%। অর্থাৎ সঞ্চয়ের তুলনায় বিনিয়োগ বেশী ছিলো।
আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ঘাটতি। অর্থাৎ রপ্তানীর চাইতে আমদানী বেশী। যদি আমদানী রপ্তানীর অঙ্কের চাইতে বেশী তবে ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ঘাটতি সৃজন হয়। তবে এ ঘাটতিটা সব সময় সহনীয় মাত্রায় রাখা বাঞ্চনীয়। বিদেশের কাছে আমাদের দায়গ্রস্ততা বিদেশ থেকে কথিত ম্যাগা প্রকল্পের জন্য অতিমাত্রায় ঋণ গ্রহণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকার যোগান বৃদ্ধি কারণে আমাদের টাকার মূল্যমান হুমকীর মুখোমুখি পড়বে। টাকার মূল্যমানকে সহনীয় পর্যায়ে রাখতে প্রাণপণ প্রয়াসী হতে হবে।
এ বিষয়ে সাম্প্রতিক বিশ্বরাজনীতি ও অর্থনীতিতে ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক যে শুল্কযুদ্ধ অর্থাৎ ঢালাওভাবে চীনা পণ্য আমদানীতে ২৫% শুল্ক আরোপের কারণে মার্কিন বাইয়ার এলায়েন্সরা নতুন বাজার খুঁজবেই। এ সুযোগটা যতটা সম্ভব কাজে লাগাতে হবে। অথচ এর পূর্বেই সরকার সর্বনিম্ন মজুরী ৪ হাজার থেকে ৮ হাজার ঘোষণা করে ফেলেছে। অর্থাৎ দ্বিগুণ মজুরী, উৎপাদন খরচের সঙ্গে যুক্ত হওয়া মানেই আমাদের পায়ে আমরা কুড়ালের আঘাত মেরেছি।
ভারতে রুপির বড়ো অবমূল্যায়ন হয়েছে সে সুযোগটা গ্রহণ করে ভারত থেকে গার্মেন্টসের প্রাথমিক পণ্য আমদানী করলে আমরা স্বল্প খরচে পোশাক সামগ্রী উৎপাদন করতে পারবো।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে চীন যদিও গার্মেন্ট শিল্পে প্রতিকুল অবস্থয় অবস্থান করে তারপর ও চীনের বহুপণ্যের বাণিজ্যে এটা নগন্য চাপ কিন্তু চীন কোন ব্যবসা হারাতে নারাজ। সামান্য সুই সুতো থেকে শুরু করে এমন কোন পণ্য নেই যা চীন তৈরি করেন। বর্তমানে সমরাস্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে চীন বিশ্ব বাণিজ্যে স্বীয় স্থান করে নিতে সক্ষমতা অর্জণ করেছে। বাংলাদেশের বিরাট বিরাট ম্যাগা প্রকল্পে চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার চীন বাংলাদেশকে ঋণ সহায়তা দিয়ে আসছে। আর্থিক সক্ষমতার কারণে চীন আন্তর্জাতিকভাবে বিবিধ ক্ষেত্রে আধিপত্য অর্জনে সক্ষমতা অর্জন করেছে। ২২ আগস্ট ৩ হাজার ৪৫০ জনে রোহিঙ্গা ফেরত পাঠানোর দিনক্ষণ ঠিক করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে চীনের মূখ্য ভূমিকা ছিলো।
আমাদের দীর্ঘমেয়াদী পুঁজি প্রাপ্তির স্থান পুঁজি বাজার আজ মৃত প্রায়। ব্যাংক সমূহের মধ্যে তারল্য সংকট। খেলাপী ঋণ গ্রহিতারা ২ লক্ষ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে টাকা পরিশোধ করচ্ছেনা। সরকার ২% ডাউন পেমেন্ট টাকা পরিশোধের সময়সীমা বেঁধে দিলে ও ঋণ খেলাপীরা টাকা পরিশোধ করচ্ছে না। সরকার সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণ প্রদানের কথা বললেও ব্যাংকগুলো তা আমলে নিচ্ছে না। সুদের হার অনেক শুভঙ্করের ফাঁক। ৬২টি ব্যাংক মালিকদের হাতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো জিম্মি।
সরকারী খাতের ব্যাংক সমূহ সিঙ্গেল ডিজিটে ঋণ প্রদানে সরকারী নির্দেশনা মেনে চলছে। ধরতে গেলে ঋণ ও রক্ষিত আমাদের সুদ প্রায় কাছা কাছি। দেশের বড় বড় কর্পোরেট সমূহ কমসুদের স্থানীয় ঋণের সুবিধা গ্রহণ করে যা পুনরায় অন্য ব্যাংকে ( যাদের তারল্য দুর্বলতা আছে) উচ্চ সুদে আমানত আকারে সংরক্ষিত রাখে। বাংকিং খাতে গোপনীয় মধ্যস্ততার মাধ্যমে সম্পদ স্থানান্তর হওয়া সরকারের উন্নয়নের পদকে বাধাগ্রস্ত করছে। আবার এমন বিষয় সম্পর্কে অবগত হওয়া গেছে কর্পোরেটসমূহ আন্তর্জাতিক বাজার হতে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণপূর্বক মেয়াদপূর্তির পূর্বেই তুলনামূলক বেশী সুদের স্থানীয় ঋণসমূহ পরিশোধ করে দিচ্ছে। এরপর স্থানীয় ব্যাংকসমূহ ঐ সমস্ত গ্রাহকদের অনুকুলে ঋণের পোর্টফোলিও সম্প্রসারণ করছে এবং বৃদ্ধি পাচ্ছে ঋণের ঝুঁকি। যা পরবর্তীতে কু-ঋণে রূপান্তরিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আস্তার ইনভয়েস এবং ওভার ইনভয়েসের আমদানী রপ্তানী বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা প্রাচার হয়ে আসছে যা আমাদের অর্থনীতিকে দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কোন রপ্তানী পণ্যের আসলমূল্য ধরি ২০০ কোটি ডলার অথচ আন্ডার ইনভয়েসে প্রদর্শিত হয়েছে ১০০ কোটি ডলার বাকই ১০০ কোটি ডলার দেশে না এসে সুইচ ব্যাংক জমা হয়ে গেলো। অর্থাৎ দুধ কলা পরিবেশন করে যে সব রপ্তানী কারকদেরকে দেশ এতো সহযোগিতা দিচ্ছে তারই মারাত্মক ক্ষতি করে আসছে অর্থ পাচারের ঘৃণ্যতম কর্মের মধ্যে দিয়ে । বিশ্ব রাজনীতিতে তাল রেখে আমাদের করনীয় স্থির করতে হবে এই প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে উন্নয়নের গতি ধরে রাখার স্বার্থে।

লেখক : কলামিস্ট