বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল শেখ হাসিনা

45

মো. খোরশেদ আলম

১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ঘর আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেছেন আজকের প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন জ্যেষ্ঠ। শেখ হাসিনা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকসহ সরকারি ইন্টারমিডিয়েট (ইডেন) গার্লস কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সদস্য ও রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনের কারণে তিনি কিছুদিন কারাবরণ করেন। ছাত্রজীবন থেকে পিতার মত শেখ হাসিনা আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে ব্যাপক ভ‚মিকা রাখেন। মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য বার বার তিনি মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েছেন। খ্যাতনামা পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া ১৯৬৭ সালে লন্ডনের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভের পর দেশে ফিরেন একই বছর ১৭ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সাথে তাঁর বিয়ে হয়। তাদের ওরসে জন্মগ্রহণ করেন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ও সজীব ওয়াজেদ জয়।
শেখ হাসিনার জন্মের বছর অর্থাৎ ’৪৭-এ দ্বিজাতি তত্তে¡র ভিত্তিতে বিভক্ত হল দেশ, ভারত-পাকিস্তান, আমরা পাকিস্তানের সাথে ছিলাম। কোন লাভ হয়নি, দীর্ঘ ২৪ বছর বৈষম্য আর জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ এ দেশের দামাল ছেলেরা রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা করার দাবীতে উত্তাল করে তুলল পূর্ব পাকিস্তানের জনপদ। ’৫২ সালে ভাষার জন্য আত্মাহুতি দিল সালাম, বরকত, রফিক, শফিক নাম না জানা হাজারো শহীদ। অবশেষে রাষ্ট্র ভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠিত হল। এখানে শেষ নয়, পশ্চিম পাকিস্তানিরা জুলুম-নির্যাতনের মাত্রা আরো বেশি বাড়িয়ে দিল। গর্জে উঠলো হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শুরু হল স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলন দীর্ঘ ৯মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত হল মহান স্বাধীনতা। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা স্বপরিবারে হত্যা করল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সেই সময় জননেত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা জার্মানে অবস্থান করছিলেন। যার কারণে প্রাণে বেঁচে যান। দীর্ঘ ৬ বছর ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় শেষে ১৯৮০ সালে ইংল্যান্ডে থেকে স্বৈরশাসক জিয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তুলেন। অবশেষে ১৯৮১ সালে ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ৩২নং ধানমন্ডি লাখো মানুষের ঢল যা দেখে স্বৈরশাসক জিয়া আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু হত্যার মাস্টার মাইন খুনি জিয়া ৩২নম্বরে নেত্রীকে পিতার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে বাঁধা দেয়। মাত্র ১৩ দিনের মাথায় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে কিছু সামরিক অফিসারের হাতে প্রাণ গেল জিয়ার। তারপর শুরু হয় গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা। ১৯৮১ সালে নেত্রীর অনুপস্থিতে সর্ব সম্মতিক্রমে তাঁকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। সেই সময় ছাত্রলীগের সেøাগান ছিল ‘চেতনার অগ্নিবিণা জননেত্রী শেখ হাসিনা’ গণতন্ত্র পুন উদ্ধারের সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার পর পর তিনি শাসক গোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন। বার বার তাকে কারা নির্যাতন ভোগ করতে হয়, হত্যার উদ্দেশ্যে কমপক্ষে ২১ বার স্বশস্ত্র হামলা করা হয়। ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারি সামরিক সরকার আটক করে ১৫ দিন কারাভ্যন্তরে রাখেন। ’৮৪ সালে ফেব্রæয়ারি ও নভেম্বর মাসে তাঁকে ২ বার বন্দী করা হয়। ১৯৮৪ সালে ২রা মার্চ আবারো আটক হয়ে প্রায় ৩ মাস গৃহবন্দী ছিলেন। ১৫ অক্টোবরে তিনি ১৫ দিনের জন্য গৃহবন্দী হন। ’৮৭ সালের ১১ নভেম্বর গ্রেফতার করে ১ মাস কারান্তরীণ রাখা হয়। ১৯৮৯ সালের ২৭ ফেব্রæয়ারী শেখ হাসিনা গ্রেফতার হয়ে পুনরায় গৃহবন্দী হন। ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বর তাকে বঙ্গবন্ধু ভবনে অন্তরীণ রাখা হয়। ২০০৭ সালে ১৬ জুলাই সামরিক বাহিনী সমর্থিত ও তত্ত¡াবধায়ক সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে সংসদ ভবন চত্বরে সাব-জেলে পাঠান। প্রায় এক বছর পর ২০০৮ সালে ১১ জুন তিনি মুক্তি লাভ করেন। হত্যার উদ্দেশ্যে উল্লেখযোগ্য হামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর সবিচালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন কালে তাকে লক্ষ্য করে পুলিশের গুলিবর্ষণ, এতে যুবলীগ নেতা নুর হোসেন, বাবুল ও ফাত্তাহ নিহত হন। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে নেত্রীসহ তার গাড়ী ক্রেন দিয়ে তুলে নেয়ার চেষ্টা করা হয়। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কোট বিল্ডিং এর নিচে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে এরশাদ সরকার লেলিয়ে দেয়া পুলিশ বাহিনী তৎকালীন পুলিশ কমিশনার মীর্জা রকিবুল হুদা নির্দেশে ঝড়ের মত গুলি বর্ষণ করলে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। সেই দিন আমরাও নেত্রীর সাথে ছিলাম। ১৯৯১ সালে বিএনপি চার দলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য বার বার হামলা করে। ১১ সেপ্টেম্বর উপ নির্বাচন চলাকালে আবারো তাকে লক্ষ করে গুলি করা হয়। ১৯৯৪ সালে ঈশ্বরদী রেল স্টেশনে তার কামরা লক্ষ্য করে অবিরাম গুলিবর্ষিত হয়। ২০০০ সালে কোটালিপাড়া হেলীপেডে এবং শেখ হাসিনা জনসভাস্থলে ৭৬ কেজি ও ৮৪ কেজি ওজনের দুইটি বোমা পুতে রাখে হুজির নেতা মুফতি হান্নান। নেত্রী পৌঁছার পূর্বে বোমা উদ্ধার হওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান। বিএনপি সরকারের আমলে সবচেয়ে বড় প্রাণঘাতি হামলা হয় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা। ঐ দিন বঙ্গবন্ধু এভিনিওতে জনসভায় বক্তব্য শেষ হওয়ার পরপর এজেষ্ট গ্রেনেড হামলা করা হয়। যে গ্রেনেডগুলো সরকারি অস্ত্রাগার ছাড়া কোথাও থাকার কথা নয়। বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমানসহ ২২জন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী নিহত। পাঁচশতরও বেশি নেতা-কর্মী আহত ও ১০০ নেতা-কর্মী পঙ্গুত্ব বরণ করেন। নেত্রী সে সময় কানে গুরুত্বর আঘাত প্রাপ্ত হন। শত বাধা বিপত্তি ও প্রতিকুলতা উপেক্ষা করে মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য অবিচল থেকেছেন। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষের অর্জন গণতন্ত্র ও বাক-স্বাধীনতা সহ বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের মর্যাদা পান। তার অপরিসীম আত্মত্যাগের ফলে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে স্বক্ষম হয়েছেন।
তার শাসন আমলে আত্মসামাজিক খাতে দেশ অভ‚তপূর্ব অগ্রগতি অর্জন করেছেন। ১৯৯৬ সালের ২১ জুন থেকে ২০০১ পর্যন্ত তিনি দেশের জন্য উল্লেখ্যযোগ্য সাফল্য এনেছেন। ভারতের সাথে ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গা নদীর পানি চুক্তি। পার্র্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি, যমুনা নদীর উপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ এবং খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন। এ ছাড়া কৃষকদের জন্য বিভিন্ন কল্যাণমূলক কর্মসূচি এবং ভূমিহীন দুঃস্থ মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা মুলক কর্মসূচি চালু করেন। বয়স্ক ভাতা, দুঃস্থ মহিলা ও বিধবাভাতা, প্রতিবন্ধি ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বয়স্কদের শান্তি নিবাস, আশ্রয়হীনদের জন্য আশ্রায়ন প্রকল্প, একটি বাড়ী একটি খামার প্রকল্প, ২০০৯ থেকে ২০১৩ মেয়াদে তিনি বিদ্যুতে উল্লেখযোগ্য ১৩ হাজার ২৬০ মেগা ওয়াটে উন্নিত করেন। গড়ে ৬% এর বেশী প্রবৃদ্ধি অর্জন। ৫ কোটি মানুষের মধ্যবৃত্তে উন্নিতকরণ। ভারত ও মায়ানমারের সঙ্গে সামুদ্রীক জলসীমা বিষয়ের নিষ্পত্তি। প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন, মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত সকল শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে বই বিতরণ, কৃষকদের জন্য কৃষিঋণ দশটাকা ব্যাংক হিসাব খোলা বিনা জামানতে বর্গা চাষিদের ঋণ প্রদান, চিকিৎসা ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন। দারিদ্রদের হার ২০০৬ সালে ৩৮.০৪ শতাংশ। ১৩ থেকে ১৪ বছরে ২৪.০৩ শতাংশে হ্রাস। জাতি সংঘ কর্তৃক শেখ হাসিনা শান্তির মডেল গ্রহণ করেন। ২০১৭ সালে পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র মিয়ানমারে রাখাইন রাজ্যে ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সেখান থেকে বিতাড়িত করলে এ দেশে তাদেরকে আশ্রয় দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে প্রশংসিত হয়েছেন তাঁকে মাদার অব হিউমিনিটি ভূষিত করা হয়। বিশ্ব ব্যাংক ও ও.গ.ঋ পদ্মা সেতুতে বিনিয়োগের আশ্বাস দিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কারণে তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে গেলও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদেশি সাহায্য ছাড়া দেশীয় অর্থায়নে ৩২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প পদ্মা সেতুর ৮০ শতাংশ কাজ শেষ করেছেন। স¤প্রতি বিশ্বে বৈশিক মহামারী করোনার প্রবাল ঘ্রাসে সকল ব্যবস্থা ধুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। সেই প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে, অথচ এমন ঘোর অমানিশার মাঝেও আশার বাতি জালিয়েছেন তিনি। দেশের রিজার্ভ ও রেমিটেন্স রেকর্ড গড়েছে, প্রায় এক লক্ষ কোটি টাকার প্রনোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন ব্যবসা বাণিজ্যের স্বার্থে। এ সকল সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণতার পরিচয়। তিনি জননেত্রী থেকে বিশ্বনেত্রীতে পরিণত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্ন দেখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মহান আল্লাহর নিকট এই দোয়া করি তিনি যেন পিতার স্বপ্ন পূরণ করে এই দেশটাকে ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরিত করতে পারেন। ৭৪তম জন্ম দিনে আমরা তাঁর সুন্দর সু-স্বাস্থ্য ও সুদীর্ঘ জীবন কামনা করি।
লেখক: শ্রম সম্পাদক, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ