বিশেষায়িত ইউনিট ছাড়াই চলছে কাজ

43

প্রযুক্তি সুবিধার অপব্যবহারের মাধ্যমে গতানুগতিক অপরাধের বদলে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাইবার ক্রাইম। প্রলোভনে ফেলে কিংবা ফাঁদ পেতে রাষ্ট্র থেকে শুরু করে ব্যক্তি পর্যায়ে এ ধরনের অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। অপরাধে জড়ানোর প্রবণতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সাইবার অপরাধীরা ধরণ বা কৌশল বদলাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
এ ধরনের অপরাধ বাড়লেও নগর পুলিশে সাইবার অপরাধ দসনে বিশেষায়িত পৃথক কোনও ইউনিট নেই। গোয়েন্দা শাখায় কর্মরত বিভিন্ন পর্যায়ের কয়েকজন সদস্যই এ সংক্রান্ত অভিযোগগুলো দেখভাল করছেন। পাশাপাশি ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সাথে সমন্বয় করে মামলাগুলো তদন্তের দায়িত্ব পালন করছেন।
নগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে গড়ে প্রতি মাসে ১০ থেকে ১৫টি সাইবার ক্রাইম সংক্রান্ত মামলা আসে। এসব অপরাধের বেশিরভাগই ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও মোবাইল ব্যাংকিং সংক্রান্ত। বিশেষ করে ফেসবুক থেকে মেয়েদের ছবি নিয়ে তা আপত্তিকরভাবে এডিট করে অনলাইনে ছাড়ার হুমকি প্রদান, প্রেমের সম্পর্কচ্ছেদের জেরে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি বা ভিডিও ভাইরাল করা, সিম কার্ড ক্লোনিং করে বিকাশ কিংবা রকেটসহ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের বিভিন্ন একাউন্ট থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগই সবচেয়ে বেশি। তবে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন না বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (বন্দর) এসএম মোস্তাইন হোসাইন বলেন, ‘বর্তমানে সাইবার ক্রাইম বেড়েছে তা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। এ ধরনের অপরাধ দমনে বিশেষায়িত ইউনিট প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম এখনও প্রক্রিয়াধীন। বর্তমানে গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি) বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মরত কয়েকজন সদস্য ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিটের সাথে সমন্বয় করে এ সংক্রান্ত অভিযোগ দেখভাল ও মামলা তদন্তের দায়িত্ব পালন করছেন।
তবে, দেশের প্রতিটি বিভাগে সাইবার ক্রাইম দমনে পুলিশের আলাদা ইউনিট চালুর প্রক্রিয়া অনেকখানি এগিয়েছে। স্বতন্ত্র ইউনিট প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত হয়তো এভাবেই আমাদের কাজ চালিয়ে যেতে হবে।’
তবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সুবিধা কাজে লাগিয়ে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় সংঘটিত চাঞ্চল্যকর অপরাধের রহস্য উদঘাটন ও অপরাধী শনাক্তে ইতিমধ্যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা পিবিআই। এমনকি, সূত্রবিহীন বেশ কয়েকটি হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচন ও জড়িতদের গ্রেপ্তারের মাধ্যমে জনমনে মামলা তদন্তে ‘সক্ষমতার নতুন ধারণা’ সৃষ্টি করেছে সংস্থাটি।
বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত চাঞ্চল্যকর হত্যাকাÐসহ নানা অপরাধের ঘটনায় থানায় দায়ের হওয়া মামলার রহস্য উদ্ঘাটনে ধীরে ধীরে ভরসাস্থল হয়ে উঠছে পুলিশের বিশেষায়িত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা পিবিআই। চট্টগ্রামে কার্যক্রম শুরুর পর প্রথম এক বছরেই আট শতাধিক মামলার তদন্ত সম্পন্ন করেছে সংস্থাটি। সাম্প্রতিক কয়েকটি সূত্রবিহীন ও আলোচিত হত্যা-ধর্ষণ মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারেও সফলতা দেখিয়েছে পিবিআই। ফলে, আদালত থেকেও চাঞ্চল্যকর বিভিন্ন মামলার তদন্ত কিংবা অধিকতর তদন্তের নির্দেশনার তালিকায় সিআইডির পাশাপাশি পিবিআই-এর নামও উঠে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে সদ্য প্রশিক্ষণ নিয়ে ফেরা পিবিআই চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা পূর্বদেশকে বলেন, ‘উন্নত বিশ্বে সাইবার অপরাধের ধরণ পাল্টাচ্ছে। নিত্যনতুন কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে অপরাধী চক্র। আসলে সাইবার অপরাধ দমনে প্রযুক্তি সুবিধার সর্বোচ্চ ব্যবহারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বুদ্ধিমত্তা এবং পেশাগত দক্ষতাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাজের পেছনে শুধুই লেগে থাকা নয়, বরং প্রতিনিয়ত আপডেট থাকতে হয়। নইলে সাফল্য পাওয়া মুশকিল। আর সবেেচয়ে বেশি দরকার প্রযুক্তি সুবিধা ব্যবহারকারীর সচেতনতা। কেননা, এ ধরনের অপরাধের স্তরে স্তরে প্রলোভনের ফাঁদ পাতা থাকে। তাতে পা দিলেই বিপদ। আর না দিলে আপনি অবশ্যই নিরাপদ।’
প্রযুক্তিভিত্তিক অপরাধ সম্পর্কিত সচেতনতা তৈরিতে নিয়োজিত বেসরকারি সংস্থা সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন (সিসিএএফ)এর সর্বশেষ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ৬০ দশমিক ৯০ শতাংশ ব্যবহার করে থাকেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, যা দেশের মোট জনসংখ্যার দুই দশমিক ১৫ শতাংশ। এই ব্যবহারকারীদের বিশাল অংশ তরুণ যাদের বয়স ১৮-২৪ বছর। এর মধ্যে আবার ৭৮ শতাংশ পুরুষ ও ২৪ শতাংশ নারী। তবে অসচেতনতার কারণে স¤প্রতি এই মাধ্যমটি ব্যবহারকারীদের জন্য সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ হয়ে উঠছে।
ফলে এদের একটি বড় অংশ সহজেই দেশের ভেতর ও বাইরে থেকে সাইবার হামলার শিকার হচ্ছেন। এতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী নারীরা। ভুক্তভোগীদের মধ্যে ১৮ বছরের কম বয়সী ১০ দশমিক ৫২ শতাংশ, ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ৭৩ দশমিক ৭১ শতাংশ, ৩০ থেকে ৪৫ বছর বয়সী ১২ দশমিক ৭৭ শতাংশ এবং ৪৫ বছরের বে?ি বয়সী রয়েছেন তিন শতাংশ।
ভুয়া একাউন্ট তৈরি কিংবা একাউন্ট হ্যাক করে তথ্য চুরির মাধ্যমে অনলাইনে সবচেয়ে বেশি অনিরাপদ পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন দেশের নারীরা। অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া একাউন্টে অপপ্রচারের শিকার হন গড়ে ১৪ দশমিক ২৯ শতাংশ নারী।
একই ধরনের অপরাধের শিকার হন ১২ দশমিক ৭৮ শতাংশ পুরুষ। গবেষণা জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ২১ শতাংশের মধ্যে ৭ শতাংশ ভুক্তভোগী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে নালিশ করে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। আর ২৩ শতাংশ আইনি ব্যবস্থা নিতে গিয়ে উল্টো হয়রানির ভয়ে পুরো বিষয়টিই চেপে যান।
অন্যদিকে সামাজিক মর্যাদা রক্ষায় পুরো বিষয়টি গোপন রাখেন ১৭ শতাংশ এবং প্রভাবশালীদের ভয়ে নিশ্চুপ থাকেন পাঁচ শতাংশ ভুক্তভোগী। অপরদিকে, অভিযোগ করেও আশানুরূপ ফল পাননি ৫৪ শতাংশ ভুক্তভোগী। অবশ্য ৭ শতাংশ ভুক্তভোগী ফল পেলেও ৩৯ শতাংশই এ বিষয়ে নীরবতা পালন করেছেন। আর ৩৭ দশমিক ৬১ শতাংশ ভুক্তভোগী প্রতিকারের ব্যবস্থা সম্পর্কে জানেনই না।
তথ্য ও প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান পূর্বদেশকে বলেন, সাইবার ক্রাইম ও তাতে জড়িতদের শনাক্ত করার জন্য আমাদের প্রযুক্তিগত কাঠামো এখনও আশানুরূপ উন্নত হয়নি। আমাদের এখন পর্যন্ত সাইবার ট্রাইব্যুনাল রয়েছে মাত্র একটি। ৬৪টি জেলায় ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব নেই। কিন্তু সারাদেশে সবার হাতে ডিজিটাল প্রযুক্তি। সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমও ব্যাপকভিত্তিতে চালু করা যায়নি। সর্বশেষ ‘সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো’ প্রতিষ্ঠার তৎপরতার কথা শোনা যাচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ এবং শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে সেটি কাজ করতে পারলে সাইবার ক্রাইম নিয়ন্ত্রণে আনা হয়তো অনেকটা সহজ হবে।’