বিলুপ্তির পথে সাড়ে তিনশ বছরের পুরোনো ঐতিহ্য

133

কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন জাতির পদচারণায় সমৃদ্ধ হয়েছে আমাদের প্রিয় চট্টগ্রাম। এখানে এসেছে আফগান, মোগল, পাঠান, ইংরেজ, পর্তুগিজসহ আরও অনেক জাতি। কালের সাক্ষী হয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে তাদের তৈরি অসংখ্য স্থাপনা।
তবে এসব স্থাপনা যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। এরকম একটি বিলুপ্তপ্রায় স্থাপনা ‘দারুল আদালত’ বা পর্তুগিজ ভবন। চট্টগ্রামের হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ ক্যাম্পাসে অবস্থিত পর্তুগিজ আমলে নির্মিত প্রায় সাড়ে তিনশ বছরের পুরোনো এই স্থাপনা। কলেজের মূল গেইট দিয়ে প্রবেশ করে সিঁড়ি বেয়ে দক্ষিণ দিকে পাহাড়ের চূড়ায় উঠলেই দেখা মিলবে জীর্ণশীর্ণ ও ভগ্নপ্রায় এই ভবনের। অভিনব স্থাপত্যশৈলীর এই ভবনে নেই কোনো লোহার পিলার। প্রায় ১০ ইঞ্চি প্রস্থের দেয়ালের উপর দাঁড়িয়ে আছে ভবনটি। ভবনটির উত্তর পাশে কলেজ মসজিদ ও বিএনসিসি অফিস। একসময় এই ভবনে প্রচুর লোক সমাগম ছিল। বিভিন্ন সময়ে আদালত, মাদ্রাসা ও লাইব্রেরি হিসেবে ব্যবহার হয়ে থাকলেও ১৯৮৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডির পর ভবনটি সরকারিভাবে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়।
সরেজমিনে পরিদর্শন করে জানা যায়, স্থাপনাটি সংরক্ষণের জন্য কয়েক দফা উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিভিন্ন কারণে আলোর মুখ দেখেনি সংরক্ষণের এসব প্রচেষ্টা। এ বিষয়ে সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের অধ্যক্ষ অঞ্জন কুমার নন্দী জানান,‘স্থাপনাটি সংরক্ষণের জন্য প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরে যোগাযোগ করা হলে তারা পর্যবেক্ষণ করার পর ভবনের জমিটি তাদের নামে লিখে দিতে বলে। আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে জমি লিখে দিতে অসম্মতি জানাই।
তিনি আরও জানান, ‘আমাদের কাছে যথেষ্ট অর্থ নেই। যদি সমাজের কোনো বিত্তবান ব্যক্তি আর্থিক সহায়তা করে তাহলে আমরা কলেজের উদ্যোগে প্রাচীন এই স্থাপনাটি সংরক্ষণের চেষ্টা করব।’
ইতিহাসবিদ ড. আব্দুল করিম তাঁর ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস’ গ্রন্থে, ১৫৩৭ সালে সর্বপ্রথম পর্তুগিজদের চট্টগ্রামে আগমনের কথা উল্লেখ করেন। স্থানীয়ভাবে পর্তুগিজদের ফিরিঙ্গি নামে ডাকা হতো। ষোড়শ শতকের শেষের দিকে তারা এই ভবনটি নির্মাণ করে। পর্তুগিজরা মূলত ভবনটিকে দুর্গ হিসেবে ব্যবহার করত। উক্ত ভবনের পর্যবেক্ষণ টাওয়ার হতে তারা কর্ণফুলী নদীতে নজরদারি করত। জনশ্রুতি আছে, ভবনের নিচ দিয়ে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত একটি সুড়ঙ্গপথ আছে। এই সুড়ঙ্গপথ দিয়ে তারা কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে জাহাজ ডাকাতি করে আবার এই দুর্গে ফিরে আসত। অবশ্য তারা চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় সুড়ঙ্গপথটি সিলগালা করে দিয়ে যায়। ইংরেজরা চট্টগ্রাম দখল করার পর পর্তুগিজদের চট্টগ্রাম থেকে বিতাড়িত করা হয়। ১৭৬১ সালে ইংরেজরা উক্ত ভবনে ‘দারুল আদালত’ নির্মাণ করেন এবং ১৮৭৪ সালে আদালত ভবন বর্তমান পরীর পাহাড়ে (বর্তমান আদালত ভবন) স্থানান্তর করা হলে ভবনসহ পাহাড়টি কিনে নেয় মহসিন ফান্ড। মহসিন ফান্ড উক্ত ভবনে একটি মাদ্রাসা চালু করে। পরবর্তীতে ১৯২৭ সালে মহসিন কলেজ প্রতিষ্ঠা হলে ভবনটির দ্বিতীয় তলায় লাইব্রেরি স্থাপন করা হয়। কিছুদিন ছাত্রাবাস হিসেবেও ভবনটি ব্যবহার করা হয়। অবশেষে ১৯৮৫ সালে ভবনটি সরকারিভাবে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়।
যথাযথ সংরক্ষণ না করার কারণে স্থাপনাটির প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারছে না তরুণ প্রজন্ম। কলেজের কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীর সাথে কথা বলে জানা যায়, অধিকাংশ শিক্ষার্থী প্রাচীন এই স্থাপত্য নিদর্শন সম্পর্কে তেমন অবগত নয়। এ বিষয়ে সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আবুল হোসাইন জানান,‘আমরা মাঝে মাঝে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভবনটি পরিষ্কার করি। তবে সম্প্রতি ভবনটি বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় আমরা যেতে পারছি না। যদি ভবনটি যথাযথ সংরক্ষণ করা না হয় ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে অজানা থাকবে স্থাপনাটির প্রকৃত ইতিহাস এবং পাশাপাশি যেকোনো সময় ঘটতে পারে দুর্ঘটনা।’