বিমান ছিনতাইকারী র‌্যাবের অপরাধী তালিকার ‘পলাশ’

64

বিমান ছিনতাই করতে গিয়ে যে যুবক কমান্ডো অভিযানে নিহত হয়েছেন, তার আঙুলের ছাপ ক্রিমিনাল ডেটাবেইজে থাকা এক অপরাধীর সঙ্গে মিলে গেছে বলে জানিয়েছে র‌্যাব।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান সোমবার বলেন, তাদের ডেটাবেইজের তথ্য অনুযায়ী ওই যুবকের নাম মো. পলাশ আহমেদ। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের দুধঘাটা এলাকার পিয়ার জাহান সরদারের ছেলে তিনি।
গত রবিবার সন্ধ্যায় শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কমান্ডো অভিযানের পর সেনা ও বিমান বাহিনীর কর্মকর্তারা শুধু বলেছিলেন, নিহত ব্যক্তির নাম ‘মাহাদী’, তার বয়স ২৬/২৭ বছর।
তার বিস্তারিত পরিচয় বা তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোনো তথ্য সে সময় তারা জানাতে পারেননি। তার কাছে যে অস্ত্রটি পাওয়া গেছে সেটি একটি ‘খেলনা পিস্তল’ বলে চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ মাহবুবর রহমান রবিবার রাতে জানিয়েছিলেন।
বিমানের পেসেঞ্জার লিস্টের বরাত দিয়ে র‌্যাব বলছে, নিহত ওই যুবক ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে বিমানে চড়েন চট্টগ্রামে যাওয়ার জন্য। চট্টগ্রাম হয়ে দুবাই যাওয়ার কথা ছিল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বোয়িং-৭৩৭ উড়োজাহাজটির।
মুফতি মাহমুদ খান বলছেন, পেসেঞ্জার লিস্টে ওই যাত্রীর নাম ছিল অঐগঊউ/গউ চঙখঅঝঐ, সিট নম্বর ১৭অ।
তবে ঠিক কী ধরনের অপরাধের জন্য পলাশ আহমেদের নাম র‌্যাবের ক্রিমিনাল ডেটাবেইজে যুক্ত করা হয়েছিল, সে বিষয়ে কোনো তথ্য দেননি এ বাহিনীর আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক।
এদিকে কমান্ডো অভিযানে নিহত ওই যুবকের মরদেহ রবিবার গভীর রাতে ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ লাশ হিসেবে ময়নাতদন্তের জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। গতকাল সোমবার দুপুর পর্যন্ত লাশের দাবি নিয়ে স্বজনদের কেউ সেখানে যাননি।
র‌্যাব ওই যুবকের যে পরিচয় দিয়েছে, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের কর্ণফুলী জোনের সহকারী কমিশনার জাহিদুল ইসলাম বলেন, “আমরা এ বিষয়ে এখনো স্পষ্ট নই, খোঁজখবর নিচ্ছি।
পুলিশের প্রাথমিক সুরতহালে জানা গেছে, নিহত যুবকের নাভির ডান পাশে একটি গুলির চিহ্ন রয়েছে। সোমবার দুপুর পর্যন্ত ওই ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি থানায়।
পতেঙ্গা থানার ওসি উৎপল কান্তি বড়ুয়া বলেন, “সিভিল এভিয়েশনের পক্ষ থেকে এজাহার পাঠানো হচ্ছে। কপি আসার পর আইনি প্রক্রিয়া নেওয়া হবে।”
মাহাদীর আসল নাম পলাশ আহমেদ বলে তার বাবা পিয়ার জাহান সরদার জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ২০-২৫ দিন আগেও সর্বশেষ বাড়িতে আসেন পলাশ। তবে সে সময় তার আচরণে পরিবর্তন দেখা যায়।
গতকাল সোমবার বেলা ১২টার আগে র‌্যাবের পক্ষ থেকে এক বার্তায় ছিনতাইচেষ্টাকারীর নাম-পরিচয় জানানো হয়। এতে বলা হয়, নিহত সন্ত্রাসী র‌্যাবের অপরাধী ডাটাবেজের অন্তর্ভুক্ত। সে অনুসারে তার নাম মো. পলাশ আহমেদ। তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁও উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নের দুধঘাটার বাসিন্দা। তার বাবার নাম পিয়ার জাহান সরদার।
পরে দুধঘাটায় পিয়ার জাহান সরদারের বাড়িতে গিয়ে আলাপ করে পলাশের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়। নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক সাজ্জাদ রুমনও প্রাথমিকভাবে পলাশ সংক্রান্ত তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেন। তবে বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
তাদের বাড়িতে ১১টি ঘর। পলাশদের পাকা বাড়ি। মা রীনা বেগম ও বাবা পিয়ার জাহানের একমাত্র ছেলে পলাশ। তিন মেয়ের মধ্যে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন বাবা। বাড়িতে আছে চার বছরের মেয়ে জান্নাত।
পিয়ার জাহান জানান, পলাশ তার একমাত্র ছেলে। ১৯৯০ সালে তিনি কাজ করতে ইরাক চলে যান। সেখানে চার বছর থাকেন। দেশে ফিরে তিনি আবার সৌদি আরব যান এবং ২০১২ সালে তিনি আবার দেশে ফেরেন।
এর মধ্যে পলাশ তাহেরপুর ইসলামিয়া আলিম মাদ্রাসা থেকে ২০১২ সালে দাখিল পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেন। এরপর তিনি সোনারগাঁও ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হন। সেখানে পড়া অবস্থায় ঢাকায় চলে যান। তারপর থেকে তার আচরণে পরিবর্তন দেখতে পায় পরিবার।
পিয়ার জানান বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমার ছেলে অবাধ্য ছিল। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে প্রবাস থেকে আমার পাঠানো টাকা সে নানাপথে খরচ করেছে। ঢাকায় যাবার কিছুদিন পর পলাশ বাড়িতে জানায়, সে নাকি ঢাকায় চলচ্চিত্রে কাজ করার চেষ্টা করছে। তখন বাড়ির সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল না। মাঝে মাঝে বাড়িতে আসতো, তবে এলাকার মানুষের সঙ্গে মিশতো না, কথা বলতো না।
তিনি জানান, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের এক রাতে সিমলাকে নিয়ে বাড়িতে আসেন পলাশ। সিমলাকে চিত্রনায়িকা জানিয়ে নিজের প্রেমিকা বলে মা-বাবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।। এ নিয়ে বাবার সঙ্গে পলাশের ঝগড়া হয়। দুই ঘণ্টা ঝগড়াঝাটি হলেও পিয়ার জাহান এ সম্পর্ক মানেননি বলে পলাশ ফিরে যান সিমলাকে নিয়ে। আড়াই মাস পর ফের এনে পরিচয় করিয়ে দেন স্ত্রী হিসেবে। তখনো বাবার সঙ্গে পলাশের ঝগড়া হয়। এরপর ফের ঢাকায় চলে যান।
পিয়ার জাহান বলেন, ২০-২৫ দিন আগে সর্বশেষ পলাশ বাড়িতে আসে। বাড়িতে আসার পর তার আচরণে বিরাট পরিবর্তন দেখা দেয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া শুরু করে, মসজিদে গিয়ে আজানও দিয়েছে। সর্বশেষ শুক্রবার বাড়ি থেকে যাওয়ার আগে বলেছে, সে কাজের সন্ধানে দুবাই যাবে।
এরপর রবিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) চট্টগ্রামে দুবাইগামী প্লেন ছিনতাইচেষ্টার ঘটনায় পলাশের মৃত্যুর খবর ফেসবুকের মাধ্যমে জানতে পারেন পিয়ার জাহান।
সোনারগাঁও থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবুল কালাম আজাদ জানান, প্লেন ছিনতাইচেষ্টার ঘটনায় নিহত ব্যক্তির ছবি রবিবার দিনগত রাত ১টার দিকে পিয়ার জাহানের বাড়িতে এসে দেখালে তিনি পলাশের পরিচয় নিশ্চিত করেন।
রবিবার সন্ধ্যায় বিমানের চট্টগ্রাম থেকে দুবাইগামী বিজি-১৪৭ ফ্লাইটটি ছিনতাইয়ের চেষ্টা করলে পাইলট তা শাহ আমানত বিমানবন্দরে অবতরণ করান।
খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যায় ফায়ার সার্ভিসসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। আর রানওয়েতে অবস্থান করা প্লেনটি ঘিরে রাখে পুলিশ, র‌্যাব ও সেনা কমান্ডোর সদস্যরা। পরে কমান্ডো অভিযানে নিহত হয় ছিনতাইচেষ্টাকারী।
গতকাল সোমবার সকালে র‌্যাব জানায়, নিহত ব্যক্তি র‌্যাবের অপরাধী ডাটাবেজের অন্তর্ভুক্ত। সে তালিকা অনুযায়ী তার নাম মো. পলাশ আহমেদ।
সাত বছর আগে ২০ দিন কারাগারে ছিল মাহাদী : পলাশ ওরফে মাহাদীসাত বছর আগে ১৭ বছরের এক কিশোরীকে অপহরণের মামলায় ২০ দিন কারাগারে ছিল বিমান ছিনতাই চেষ্টাকারী পলাশ আহমেদ ওরফে মাহাদী। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন- র‌্যাবের সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, ২০১২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি দেলোয়ার নামে এক ব্যক্তি তার মেয়েকে অপহরণের অভিযোগে পলাশ ওরফে মাহাদীর নামে মামলাটি দায়ের করেন। মামলা নম্বর ৪৪। ওই বছরের ২৮ মার্চ র‌্যাব তাকে গ্রেফতারের পর অপহৃত কিশোরীকে উদ্ধার করে। এসময় নেমরা মারমা নামে পলাশের এক সহযোগীকেও গ্রেফতার করা হয়।
র‌্যাবের পরিচালক (লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া ) মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ‘আমরা তার প্রিভিয়াস ক্রিমিনাল রেকর্ড খতিয়ে দেখছি।’ র‌্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, অপহরণের ওই ঘটনায় পলাশ আট লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিল বলে ভিকটিমের পরিবার তখন অভিযোগ করে। পরে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় ভিকটিমকে উদ্ধার এবং এক সহযোগীসহ পলাশকে গ্রেফতার করা হয়।
এদিকে, পলাশের বাবা পিয়ার জাহান সরদার বলেন, ‘এক মেয়ের সঙ্গে পলাশের ভালোবাসা ছিল। ওই মেয়ের বাবা মামলা করেছিল। সেই মামলায় পলাশ ২০ দিন কারাগারে ছিল। পরে জামিন করাই।’ পলাশের বাবা বলেন, ‘আমার একটাই ছেলে। আমরা ওই মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি ছিলাম। কিন্তু মেয়ের বাবা রাজি হয় নাই। পরে আপসের মাধ্যমে তারা মামলাটা তুলে নিছে।’
প্রসঙ্গত, রবিবার বিকাল ৫টা ৫ মিনিটে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিজি-১৪৭ ফ্লাইট ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ছেড়ে চট্টগ্রাম হয়ে দুবাই যাওয়ার কথা ছিল। বলা হয়, ঢাকা থেকে উড্ডয়নের পরই বিমানটি ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে। পরে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিকাল ৫টা ৪০ মিনিটের দিকে ওই ফ্লাইটটি জরুরি অবতরণ করে। ফ্লাইটে ১৩৪ জন যাত্রী ও ১৪ জন ক্রু ছিলেন। পরে কমান্ডো অভিযানে সন্দেহভাজন বিমান ‘ছিনতাইকারী’ মাহাদী নিহত হয়। বিমানে থাকা যাত্রীরা অভিযানের আগেই নিরাপদে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন।
অভিযানের পর চট্টগ্রাম সেনানিবাসের জিওসি মেজর জেনারেল মতিউর রহমান জানান, ছিনতাইকারীর বয়স ২৫-২৬ বছর। ক্রু’কে সে তার নাম ‘মাহাদী’ বলে জানিয়েছে। তবে সোমবার সকালে র‌্যাব জানায়, নিহত ব্যক্তি র‌্যাবের অপরাধী ডাটাবেজের অন্তর্ভুক্ত। সে তালিকা অনুযায়ী তার নাম মো. পলাশ আহমেদ। খবর বিডিনিউজ/বাংলানিউজ/বাংলা ট্রিবিউন

বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টা পলাশসহ অজ্ঞাত ব্যক্তির নামে মামলা
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি উড়োজাহাজ ছিনতাই করতে গিয়ে কমান্ডো অভিযানে নিহত ব্যক্তির বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও বিমান নিরাপত্তা বিরোধী অপরাধ দমন আইনে মামলা দায়ের হয়েছে। গতকাল সোমবার রাতে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সিভিল এভিয়েশন বিভাগের প্রযুক্তি সহকারি দেবব্রত সরকার বাদি হয়ে নগরীর পতেঙ্গা থানায় মামলাটি দায়ের করেছেন। মামলা নম্বর-১৫।
পতেঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উৎপল বড়ুয়া বলেন, মামলার এজাহারে আসামির তালিকায় নিহত ব্যক্তির নাম পলাশ আহমেদ উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া মামলায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০১২ এর ৬ ধারা এবং বিমান নিরাপত্তা বিরোধী অপরাধ দমন আইন, ১৯৯৭ এর ১১ (২) ও ১৩ (২) ধারায় মামলাটি দায়ের হয়েছে বলেও জানিয়েছেন ওসি।
রবিবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ বিমানের একটি উড়োজাহাজ (বোয়িং-৭৩৭) ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে দুবাই যাবার কথা ছিল। বিকেলে ঢাকা থেকে উড্ডয়নের পর উড়োজাহাজটি ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে। এসময় দু’জন কেবিন ক্রুকে জিম্মি করে রাখার কথাও বলা হয়।
বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বিমানটি শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। তখন পাইলট-যাত্রীদের নিরাপদে নামিয়ে নেওয়া হয়। শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনার মধ্যে সন্ধ্যার দিকে মাত্র আট মিনিটের কমান্ডো অভিযানে ছিনতাই কান্ডের অবসান ঘটে। সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল এস এম মতিউর রহমান সংবাদ সম্মেলন করে জানান, অভিযানে ছিনতাইকারী নিহত হয়েছে। নিহত ব্যক্তির সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত শেষে তার মরদেহ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে- লাশের নাভির উপরে ডানপাশে গুলিবিদ্ধ হওয়ার চিহ্ন আছে। এছাড়া শরীরে আর কোথাও আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই।