বিপ্লবসহ ৩ জন কারাগারে মামলায় আসামি ৫ হাজার

27

ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায় এক যুবকের ‘হ্যাক হওয়া’ ফেসবুক আইডি থেকে মহানবীকে (সা.) নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও স্থানীয়দের সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা হয়েছে। মামলায় অজ্ঞাত পাঁচ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। গত রবিবার রাতে বোরহানউদ্দিন থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবিদ হোসেন বাদী হয়ে মামলাটি করেন।
অন্যদিকে যার ফেইসবুক হ্যাক হওয়ার পর মেসেঞ্জারে নবীকে নিয়ে কথিত কট‚ক্তির স্ক্রিনশট ছড়িয়ে ভোলার বোরহানউদ্দিনে সহিংসতা ঘটানো হয়েছে, সেই বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য শুভসহ তিনজনকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত।
গতকাল সোমবার ভোলার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে হাজির করা হলে বিচারক ফরিদ আলম তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। শুভ ছাড়া অন্য দুজন হলেন, বোরহানউদ্দিনের কাচিয়া ইউনিয়নের মো. ইমন ও রাফসান ইসলাম শরীফ ওরফে শাকিল। খবর বিডিনিউজের
তাদের মধ্যে শাকিলকে রবিবার পটুয়াখালীর গলচিপা এবং ইমনকে কাচিয়া থেকে গ্রেপ্তারের কথা জানিয়েছে পুলিশ। আর শুভ তার ফেইসবুক হ্যাকারের কবলে পড়ার কথা জানিয়ে জিডি করার পরও স্থানীয় ‘আলেমদের’ দাবির মুখে তাকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ।
অন্য ৭-৮জন অজ্ঞাতনামা আসামির সঙ্গে ‘পরস্পর যোগসাজশে’ ফেইসবুক মেসেঞ্জারে ইসলাম ধর্ম ও মহানবীকে নিয়ে ‘কট‚ক্তি’ এবং তা ডিজিটাল মাধ্যমে ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। বোরহানউদ্দিন থানায় উপপরিদর্শক দেলোয়ার হোসেন রবিবার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ মামলা দায়ের করেন।
আদালতের একজন কর্মকর্তা জানান, বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য ও শাকিলের মেসেঞ্জারে ‘ধর্মীয় অবমাননাকর’ বার্তাগুলো পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে মামলার এজাহারে।
আসামিদের মধ্যে শুভ বোরহানউদ্দিন উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের খারাকান্দি গ্রামের চন্দ্র মোহনের ছেলে। ইমনের বাড়ি উপজেলার উদয়পুর এলাকায়। আর পটুয়াখালীর কলাপাড়া তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্টোরকিপার শাকিল উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের নূরে আলমের ছেলে।
ভোলার ঘটনা নিয়ে ‘বিভ্রান্তি এড়াতে’ পুলিশ সদরদপ্তর রবিবার পুরো ঘটনাপ্রবাহের একটি বিবরণ তুলে ধরে এক বিবৃতিতে। সেখানে বলা হয়, ১৮ অক্টোবর রাতে বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য নামের ২৫ বছর বয়সী এক যুবক বোরহান উদ্দিন থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। তিনি জানান, তার ফেইসবুক আইডি ‘বিপ্লব চন্দ্র শুভ’ হ্যাক করা হয়েছে।
জিডি করার সময় থানায় থাকাকালেই তার মোবাইলে একটি ফোন আসে এবং তার কাছে চাঁদা দাবি করা হয়। বিষয়টি তিনি ওসিকে জানান এবং ওসি জানান ভোলার পুলিশ সুপারকে।
প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে সেদিন রাতের মধ্যেই বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্যর ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাককারী ও তার মোবাইলে কলকারী শরীফ এবং ইমন নামে দুই যুবককে যথাক্রমে পটুয়াখালী এবং বোরহানউদ্দিন থেকে আটক করে পুলিশ। আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদেরকে বোরহান উদ্দিন থানায় নেওয়া হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, শুভর ফেইসবুক মেসেঞ্জার থেকে কথিত মন্তব্যের জেরে এলাকার মুসলমানদের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হতে থাকে। মন্তব্যকারীর ফাঁসি দাবি করেন স্থানীয় আলেম সমাজ। রবিবার বেলা ১১টায় বোরহানউদ্দিন ঈদগাহ ময়দানে তারা প্রতিবাদ সভা করার ঘোষণা দেন।
কিন্তু জেলা প্রশাসক, ইউএনও, থানার ওসি ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ আলেম সমাজের প্রতিনিধিগণের উপস্থিতিতে ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরে শনিবার সন্ধ্যায় বোরহান উদ্দিন থানায় দীর্ঘ সময় আলোচনা হয়। আলেম সমাজের অভিযোগের ভিত্তিতে বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্যকে আটক দেখানো হয়। এ বিষয়ে উপযুক্ত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের নিশ্চয়তা পেয়ে প্রতিনিধিত্বকারী আলেম সমাজ তাদের পূর্বঘোষিত প্রতিবাদ কর্মসূচি বাতিল ঘোষণা করেন।
সমাবেশ বাতিলের ঘোষণার পরও রবিবার সকাল থেকে কিছু লোক ঈদগাহ ময়দানে সমবেত হতে থাকে। ময়দানের বিভিন্ন পয়েন্টে বসানোর জন্য ১৭টি মাইক আনা হয়। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। তারা সমবেতদের সরিয়ে নিতে বললে স্থানীয় আলেমরা প্রতিশ্রæতি দেন, কোনো রকম বিশৃঙ্খলা সেখানে হবে না।
ইতোমধ্যে পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় এবং যে কোনো অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এড়াতে স্থানীয় পুলিশকে সহায়তা দিতে সকালেই বরিশাল থেকে রেঞ্জ পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি ভোলায় আসেন। অতিরিক্ত ডিআইজি ও ইউএনওকে নিয়ে পুলিশ সুপার ঘটনাস্থলে উপস্থিত জনগণের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন।
ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা করে প্রয়োজনীয় সকল আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিষয়ে তাদেরকে বার বার আশ্বস্ত করেন। তাদের কথায় আশ্বস্ত হয়ে সমবেত লোকজন ঈদগাহ্ ময়দান ত্যাগ করেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের বিবৃতিতে বলা হয়, বক্তব্য শেষে পুলিশ সুপার ও অতিরিক্ত ডিআইজিসহ পুলিশ কর্মকর্তারা ঈদগাহ সংলগ্ন মসজিদ-মাদ্রাসার একটি কক্ষে অবস্থান নেন। এরই মধ্যে ‘অন্য একটি গ্রæপ’ ঈদগাহ ময়দানে ঢুকে সাধারণ মানুষকে ‘উত্তেজিত করতে থাকে’।
তারপর একদল লোক বিনা উসকানিতে মাদ্রাসার অফিস কক্ষে অবস্থানরত কর্মকর্তাদের ওপর আক্রমণ করে। আক্রমণকারীদের একদল আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পুলিশ ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। আক্রমণকারীদের গুলিতে পুলিশের একজন মারাত্মক জখম হয়। মারাত্মক আহত হন পুলিশের আরেক সদস্য। বরিশাল রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজিও আহত হন।
এই পরিস্থিতিতে ইউএনও ও নিবার্হী ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে পুলিশ উত্তেজিত লোকজনকে নিবৃত্ত করতে প্রথমে টিয়ার শেল এবং পরে শটগানের গুলি ছোড়ে জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, পরিস্থিতির ভয়াবহতায় ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে এক পর্যায়ে পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়।
প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে সংঘর্ষে চারজন নিহত হন, তাদের মধ্যে দুজনের মাথা ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে থেঁতলানো ছিল বলে চিকিৎসকের বরাতে জানিয়েছে পুলিশ সদরদপ্তর। হামলা-সংঘর্ষের মধ্যে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়, এতে এক পুলিশ সদস্য গুরুতর আহত হন।
সংঘর্ষের ওই ঘটনায় বোরহানউদ্দিন থানায় আলাদা একটি মামলা করেছে পুলিশ। পুলিশের ওপর হামলা, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও হত্যার অভিযোগে অজ্ঞাতপরিচয় পাঁচ হাজার লোককে আসামি করা হয়েছে সেখানে।
বোরহানউদ্দিন থানার ওসি এনামুল হক বলেন, পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় এ মামলা করা হয়েছে। পরিস্থিতি বর্তমানে শান্ত রয়েছে।
ভোলার সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) শেখ সাব্বির হোসেন জানান, সংঘর্ষের ঘটনায় ৩০ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১০ জন চিকিৎসাধীন। পুলিশ এখন পর্যন্ত ১৫ জনকে আটক করেছে। সমাবেশস্থলসহ গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
সংঘর্ষে আহত ৪১ জনকে ভোলা সদর হাসপাতাল এবং ৩০ জনকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং বাকিদের বোরহানউদ্দিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। আহতদের বেশিরভাগই গুলিবিদ্ধ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চার প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। বিজিবি, পুলিশ ও র‌্যাবের টহল জোরদার করার পর বিকাল থেকেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসতে শুরু করে।
এ ঘটনায় ভোলা জেলা প্রশাসক স্থানীয় সরকার উপপরিচালক মামুদুর রহমানকে প্রধান করে ওই দিনই (রবিবার) তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (আইটি অ্যান্ড এডুকেশন) আতাহার মিয়া ও ভোলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সদর সার্কেল মহসিন আল ফারুক।