বিপর্যস্ত মধ্যবিত্ত জীবন

73

ডা. বরুণ কুমার আচার্য

আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ একসময় বিভিন্ন কারণে বিশ্বজোড়া সুখ্যাতি লাভ করেছিল। কিন্তু সেদিনের সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলায় ভরপুর বাংলাদেশ আজ শ্রীহীন হয়ে পড়ছে। অধিকাংশ মানুষের ভেতরেই অসৎ উপায়ে স্বল্প সময়ে ধনী হওয়ার প্রবণতা বর্তমানে অধিক হারে দেখা যাচ্ছে। সবুজ ঘাসের গালিচায় মোড়ানো যে গ্রাম-বাংলা সোনালি রোদ্দুরের হাসিতে মুখর হয়ে থাকত, সেসব এখন গ্রাম-গঞ্জের নর-নারীকে যথারীতি আনন্দ দান করতে পারছে না। অভাব আর দারিদ্রের কশাঘাতে আজকের জনজীবন দুঃখ ও হাহাকারে পূর্ণ। মানুষের ওপর চেপে বসেছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির ঘোটক। জীবন ধারণের উপযোগী প্রতিটি জিনিসের অগ্নিমূল্য। চাল, ডাল, মাছ, মাংস, তেল, তরিতরকারি, ফলমূল, চিনি, লবণ, গম, আটা, রুটি, বিস্কুট ইত্যাদি দ্রব্যের মূল্য আগের তুলনায় কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। অতিরিক্ত মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের জন্যই সাধারণ মানুষকে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এমনিতে করোনার মধ্যেই জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় অসহায় হয়ে পড়েছেন নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পেশাজীবী মানুষ। কোভিড-১৯ এর কারণে এমনিতেই আয় কমে গেছে; কারো কারো রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে প্রতিটি নিত্যপণ্য ছাড়াও ওষুধ, পরিবহন ব্যয়, বাড়িভাড়া, গ্যাস-বিদ্যুৎ বিল বেড়ে গেছে। ফলে বেড়ে গেছে মানুষের জীবন যাত্রার ব্যয়। অথচ আয় বাড়েনি। এ অবস্থায় নি¤œ আয়ের বিপুল সংখ্যক মানুষকে তিন বেলা পেটপুরে খাদ্য সংগ্রহে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে। আর মধ্যবিত্তদের আয়ের সঙ্গে ভারসাম্য রাখতে গিয়ে প্রতিদিনের বাজার তালিকা কাটছাঁট করতে হচ্ছে। এছাড়াও কেউ কেউ নিরুপায় হয়ে জমানো পুঁজি ভাঙ্গিয়ে খরচ করছেন। কেননা মানুষের এখন আয়-রোজগার আগের মত নেই। যারা আয় করছেন তাদের রোজগারও কমে গেছে। এর উপর ‘পণ্যমূল্য বৃদ্ধি’ মরার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। অসহায় হয়ে পড়েছেন পেশাজীবী নিম্নণবিত্ত, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ। যাপিত জীবন নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাদের অসহায়ত্বের কথা জানা যায়। কারন দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে অসহায় হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। প্রতিনিয়ত একটার পর একটা পণ্যের মূল্য বাড়ছে। কেননা সুযোগ নিয়ে অসৎ ব্যবসায়ী ও সিন্ডিকেটধারীরা দাম বাড়াতে বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছেন। ইচ্ছা মতো পণ্য মজুত করছেন, আর দাম বাড়াচ্ছেন। এতে জীবন যাত্রায় ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় কথাবার্তায় মানুষের মধ্যে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে। নিত্যব্যয় মেটাতে দিশেহারা সাধারণ মানুষ বর্তমানে জীবনের নুন্যতম চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। বেসরকারী এক সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১৮ সালে এই বৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৬ শতাংশ এবং ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ। অন্যদিকে ২০১৭ সালে ছিল ৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ এবং ৭ দশমিক ১৭ শতাংশ। চলতি বছর এই ব্যয় বেড়েছে ৮.১৩ শতাংশ। হঠাৎ করে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকার মিলগেটসহ পাইকারি ও খুচরা বাজারে নিত্যপণ্যটির দাম ঠিক করে দিয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা সরকারের নির্দেশ মানেননি। অসৎ ও প্রভাবশালী সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা নিজেদের মতো করে পণ্যগুলোর বাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন। এতে বিপন্নবোধ করছেন ভোক্তারা। গত ৩০ দিনের টিসিবি‘র মূল্য তালিকা পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, নিত্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যে দাম ৫ থেকে ১৫ টাকা বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে যে চাল ৪৩ টাকা থেকে ৫৮ টাকা দরে বিক্রি হতো বর্তমানে তা ৫২ থেকে ৬৮ টাকা ধরে বিক্রি হচ্ছে। যদিও চালের বাজারে গত কয়েকদিনে সামান্য পরিবর্তন এসেছে। সয়াবিন তেল ৫ টাকা থেকে ১০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ রকম প্রতিটি পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়। এ ছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণায় দেখা যায় করোনার মধ্যেও নি¤œ ও মধ্যবিত্তের বাড়িভাড়া বেড়েছে গড়ে ৮ দশমিক ১৮ শতাংশ। বস্তির ঘরভাড়া ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ ও মেসের ভাড়া বেড়েছে ৭ দশমিক ৯১ শতাংশ। আমাদের বাংলাদেশ ওষুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশ বিশে^র ১৪২টি দেশে ওষুধ রফতানি করে। এর মধ্যেও দেশে ব্যাপকভাবে নকল, ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ ও নি¤œমানের ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। কোভিড-১৯ এর সময় ওষুধের দাম বেড়েছে লাগামহীনভাবে। ওষুধ কোম্পানীগুলো যে যেভাবে পারছেন ওষুদের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। এমনকি কোনো কোনো ওধুষের দাম দ্বিগুন করা হয়েছে। দেখার যেন কেউ নেই। ওষুধের উচ্চমূল্য দরিদ্র রোগী এবং মধ্যবৃত্তের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। তাছাড়াও গ্যাস ও পানির দাম বেড়েছে দফায় দফায়। অথচ মানুষের আয় বাড়েনি, কমেছে। বাসাবাড়িতে বার্নার গ্যাসের চুলার ব্যয় বেড়েছে ২১ দশমিক ৮৮ শতাংশ। এমনিতেই করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে অর্থ সংকটে পড়েছে সাধারণ মানুষ। বেশির ভাগ ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা খারাপ। অনেকে হয়ে পড়েছেন বেকার। আবার কারো কাজ আছে কিন্তু বেতন পাচ্ছেন না। অনেকের বেতন কমে গেছে। ফলে সংসারের খরচ মেটাতেই এখন হিমশিম খাচ্ছেন নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা। এমন অবস্থায় সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় কার্যত নিম্নবৃত্ত-মধ্যবৃত্ত শ্রেণীর মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। স্বাধীন দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের বলগাছাড়া অবস্থা দরিদ্র ব্যক্তিদের পক্ষে বজ্রাঘাততুল্য। বিভিন্ন শ্রেণীর ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি করছেন। সরকারকে কঠোর হাতে অতিলোভী অসাধু এসব ব্যবসায়ীকে দমন করতে হবে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যতালিকা টাঙানো এবং নির্ধারিত মূল্যে পণ্য বিক্রয় করা হচ্ছে কি না, সেটি পর্যবেক্ষণের জন্য সব বাজারে দ্রব্যমূল্য মনিটরিং কমিটি গঠনের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার ও ব্যবসায়ীদের সদিচ্ছাই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করে দেশের সাধারণ মানুষের আরও একটু সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা প্রদানে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে সক্ষম।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও মরমী গবেষক