‘বিপর্যস্ত’ পাইলট আবিদ পরিস্থিতিতে সাড়া দিতে ব্যর্থ হন

45

নেপালে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের ফ্লাইট বিএস-২১১ দুর্ঘটনায় পড়ার আগে ‘মানসিকভাবে বিপর্যস্ত’ অবস্থায় থাকায় পাইলট আবিদ সুলতান পরিস্থিতি অনুযায়ী ‘সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন’ বলে মনে করছে নেপাল সরকারের গঠিত তদন্ত কমিশন। গত রবিবার নেপালের পর্যটনমন্ত্রী রবীন্দ্র অধিকারীর কাছে জমা পড়া ৪৩ পৃষ্ঠার ওই চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তদন্ত কমিশন সুপারিশ করেছে, স্বাস্থ্য বা মানসিক অবসাদের কারণে কোনো পাইলটকে দায়িত্ব পালনে বিরত রাখার ইতিহাস থেকে থাকলে তার লাইসেন্স নবায়নের আগে অবশ্যই স্বাস্থ্য ও মানসিক অবস্থা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। খবর বিডিনিউজের
ঢাকা থেকে ৬৭ জন যাত্রী ও চারজন ক্রু নিয়ে গত বছর ১২ মার্চ দুপুরে কাঠমান্ডুতে নামার সময় দুর্ঘটনায় পড়ে ইউএস-বাংলার ফ্লাইট বিএস-২১১। আরোহীদের মধ্যে ৫১ জনের মৃত্যু হয়, যাদের ২৭ জন ছিলেন বাংলাদেশি। তদন্ত কমিশন বলছে, ককপিটের ভয়েস রেকর্ডার পরীক্ষা করার পর তাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে যে, ক্যাপ্টেন বড় ধরনের মানসিক চাপের মধ্যে ছিলেন। প্রায় এক ঘণ্টার ওই ভয়েস রেকর্ডে কো-পাইলট পৃথুলা রশিদের সঙ্গে কথোপকথনে পাইলট আবিদের ‘মানসিক অস্থিরতা এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে তার অসতর্কতার’ বেশ কিছু নমুনা পাওয়া গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই যাত্রায় পাইলট আবিদ এক নারী সহকর্মীকে নিয়ে কথা বলছিলেন, যিনি ইউএস-বাংলাতেই কো পাইলট হিসেবে কাজ করেন, তবে সেদিনের সেই ফ্লাইটে তিনি ছিলেন না। ওই নারী সহকর্মী ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে আবিদের সুনাম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। সে কারণে আবিদ মানসিক অস্থিরতায় ভুগছিলেন। ওই পরিস্থিতিতে অবতরণের আগের ওই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে উড়োজাহাজ চালনার বিধিবদ্ধ নিয়মগুলো অনুসরণ করতে ব্যর্থ হন ফ্লাইটের দু’জন ক্রু। পরিস্থিতি সম্পর্কে তারা যথেষ্ট সতর্ক ছিলেন না।
তদন্ত কমিশন বলছে, অসতর্কতার কারণে পাইলটরা বুঝতে পারেননি, তাদের ড্যাশ ৮-কিউ৪০০ উড়োজাহাজটি নির্ধারিত পথ থেকে কতটা সরে গেছে। এর অর্থ হলো, তারা ঠিকমত রানওয়ে দেখতে পাচ্ছিলেন না।
কমিশনের সদস্য বুদ্ধিসাগর লামিচানে রয়টার্সকে বলেছেন, ‘পাইলট ভেবেছিলেন, তিনি উড়োজাহাজটি নির্ধারিত পথে ফিরিয়ে এনে ঠিকমতই অবতরণ করতে পারবেন। কিন্তু তিনি তা পারেননি’।
তদন্ত কমিশন বলছে, রানওয়ে ‘মিস করার’ পর শ-৮ কিউ৪০০ মডেলের উড়োজাহাজটি উড়ছিল খুব নিচে, ত্রিভুবন বিমানবন্দরের উত্তরের পাহাড়ি এলাকার কাছ দিয়ে। শেষ পর্যন্ত পাইলটরা যখন রানওয়ে দেখতে পান, ততক্ষণে তারা অনেক নিচে নেমে এসেছেন, উড়োজাহাজও রানওয়ের মাঝ বরাবর ছিল না। পাইলটের উচিৎ ছিল তখন না নেমে আবার আকাশে উঠে যাওয়া এবং চক্কর দিয়ে নতুন করে নামা চেষ্টা করা’।
ভূমি স্পর্শ করার পর ফ্লাইট বিএস-২১১ দক্ষিণ পূর্ব দিকে এগিয়ে যায় এবং রানওয়ের বাইরের চলে যায়। এরপর সীমানা বেড়া ভেঙে ঢালু জমি পেরিয়ে অবতরণের স্থান থেকে ৪৪২ মিটার দূরে গিয়ে থামে। সেখানে বিমানটি অগ্নিকুন্ডে পরিণত হয়। নিহত ৫১ আরোহীর মধ্যে দুই পাইলটও ছিলেন ।
ওই তদন্ত দলে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে থাকা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) ফ্লাইট অপারেশন কনসালটেন্ট সালাউদ্দিন এম রহমতউল্লাহ গতকাল সোমবার ঢাকায় এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘নেপালের তদন্ত কমিটির রিপোর্টে মিথ্যাচার নেই। তবে রিপোর্টে এটিসি (বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ) সম্পর্কে কিছু তথ্য এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এজন্য আমরা কিছু প্রস্তাব তাদের দেব। সেগুলো রিপোর্টে যুক্ত না করা হলে আমরা আইকাওকে (ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন) অভিযোগ করব’।
ত্রিভুবন বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সেদিন আরও উদ্যোগী ভূমিকা নিলে হয়ত এ দুর্ঘটনা এড়ানো যেত বলে ব্রিফিংয়ে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এম নাঈম হাসান।
শতাধিকবার ত্রিভুবন বিমানবন্দরে অবতরণের অভিজ্ঞতা যার রয়েছে, সেই আবিদ সুলতানের পরিচালনায় ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজটি কিভাবে বিধ্বস্ত হলো, সে প্রশ্ন উঠেছিল আগেই। ওই দুর্ঘটনার এক মাসের মাথায় নেপালি তদন্ত কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হওয়ার আগে পাইলটের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ কক্ষের (এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল) যোগাযোগ ‘স্বাভাবিক ছিল না’।
সেদিন সকাল থেকে অভ্যন্তরীণ রুটে একাধিক ফ্লাইট পরিচালনা করার পর আবিদ সুলতান যখন দুপুরে নেপালে গেলেন, তখন তিনি ক্লান্ত বা অবসাদগ্রস্ত ছিলেন কি না- সে প্রশ্ন নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সে সময় আলোচনা হয়।
আবিদ অন্য চাকরি পেয়ে ইউএস-বাংলা থেকে অব্যাহতি চেয়েছিলেন এবং কাঠমান্ডুতে যেতে না চাইলেও তাকে মতের বিরুদ্ধে পাঠানো হয়েছিল- এমন কথাও সে সময় আসে। তবে বেসরকারি বিমান পরিবহন সংস্থা ইউএস-বাংলার পক্ষ থেকে সে সময় দাবি করা হয়, পাইলট আবিদ সুলতান ‘অবসাদগ্রস্ত’ ছিলেন না। তিনি চাকরি থেকে অব্যাহতি চাননি এবং মতের বিরুদ্ধেও তাকে পাঠানো হয়নি। বরং দুর্ঘটনার আগে নেপালের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল থেকে পাইলটকে ‘বিভ্রান্তিকর নির্দেশ’ দেওয়া হয়েছিল বলেও অভিযোগ করেছিলেন ইউএস বাংলার কর্মকর্তার।
ঢাকার রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র আবিদ এক সময় বাংলাদেশ এয়ারফোর্সের ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ছিলেন। তার সাড়ে ৫ হাজার ঘণ্টা ফ্লাইট চালানোর অভিজ্ঞতা ছিল এবং তিনি ড্যাশ ৮-কিউ৪০০ চালিয়েছেন ১৭০০ ঘণ্টার বেশি।
তদন্ত কমিশনের খসড়া প্রতিবেদনে ভিত্তিতে কাঠমান্ডু পোস্ট গত আগস্টে পাইলট আবিদের মানসিক বিপর্যস্ততার বিষয় সামনে নিয়ে এলে ইউএস বাংলার মার্কেটিং সাপোর্ঁ অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের জিএম মো. কামরুল ইসলাম সেসব ‘মনগড়া তথ্য’ বলে উড়িয়ে দেন।
ইউএস বাংলার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান আসিফ রয়টার্সকে বলেছেন, তদন্ত কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে সোমবার আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেবেন তারা।