বিপন্ন মানুষের সেবা ও বৈষম্যহীন সমাজ

488

আজ শুরু করছি উপমহাদেশ খ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ভূপেন হাজারীকার এক বিশেষ সঙ্গীত দিয়ে। ‘মানুষ মানুষের জন্য…., জীবন জীবনের জন্য…, একটু সহানুভূতি কি পেতে পারে না বন্ধু…?’ সমাজের নিগৃহীত মানুষের তরে এ এক অমর সঙ্গীত। আমরা অনেকেই আজ মহাভাগ্যবান। যারা সক্ষম এবং সামর্থ্যবান। যাদের সক্ষমতা শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক। দেশের অসহায় ও বিপন্ন মানুষের তরে তাদের আছে নৈতিক দায়বদ্ধতা। বিশ্বায়নের যুগে মানুষের মনে পুঁজিবাদী ধারণা ক্রমবিকাশ লাভ করছে। এ যুগে মানুষ আত্মসমৃদ্ধি অর্জনে তাড়িত। এর প্রভাবে মানবতা আজ বিপন্ন। ঘাত-প্রতিঘাতের শিকার হচ্ছে দেশের অসহায় মানুষ। যারা আজ দরিদ্রকবলিত, প্রতিবন্ধীতার শিকার, বার্ধক্যে উপনীত, এতিম-বিধবা, সামাজিক অপরাধী, সামাজিক অবক্ষয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। তাদের সেবায় এগিয়ে আসতে হবে সকলকে। মানব সেবার মাঝেই মানব মহত্ত্ব।
সমাজের অসহায় মানুষ এ সমাজের অংশ। আমাদের অতি আপনজন। মানবতার তরে মানব হৃদয় জাগ্রত করতে হবে। জনগণের মৌলিক অধিকার ও বৈষম্যহীন সমাজের দাবি নিয়ে এ দেশের স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ দেশের রাষ্ট্রীয় অঙ্গনে কল্যাণমুখী দর্শনের অগ্রদূত। ১৯৯৭ সালে তাঁর শাসন আমলে ‘বয়স্ক ভাতা কর্মসূচির’ মাধ্যমে শুরু হয় দেশে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিক নিরাপত্তামূলক কার্যক্রম। যা ছিল দেশের অসহায় মানুষের সেবায় যুগান্তকারী অধ্যায়। ১৯৯৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার শেরে বাংলা নগরে জাতীয় সমাজসেবা ভবন উদ্বোধনকালে প্রতি বছর ‘সমাজসেবা দিবস’ পালনের ঘোষণা প্রদান করেন। তাঁর এ ঘোষণার মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমের জাগরণ সৃষ্টি করা হয়। ২০১২ সালে ৪ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভায় প্রতি বছর ২ জানুয়ারি ‘জাতীয় সমাজসেবা দিবস’ রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফলে তৃণমূল পর্যায়ে সমাজসেবায় সমাজের সকল পক্ষকে সম্পৃক্ত করার যাত্রা শুরু হয়।
সমাজসেবা (Social Services) কি ? সেবা গ্রহীতা (Service Receiver) করা ? সমাজকর্মী (Social Worker) কে ? পাঠকের মনে প্রশ্ন হতে পারে। সমাজসেবা বলতে- সমাজের অক্ষম, অসুবিধাগ্রস্ত, দুঃস্থ ও অসহায় শ্রেণীর কল্যাণে যাবতীয় কার্যাবলীকে বুঝায়। আধুনিক যুগে সমাজসেবা হল- সমাজের অক্ষম মানুষকে সক্ষম করে তোলার একটি সংঘটিত সেবাদান ব্যবস্থা। বর্তমানে সমাজসেবা মানব মূলধন উন্নয়নের অন্যতম খাত হিসেবে চিহ্নিত। সমাজের অসহায়, অক্ষম, নিগৃহীত ও বিপন্ন সকল মানুষ হচ্ছে সেবা গ্রহীতা। সমাজসেবার মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়ন ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। সংঘটিত সরকারি-বেসরকারি সেবা প্রদান ব্যবস্থাপনায় সেবা প্রদানকারী সুনির্দিষ্ট। সমাজসেবা এক মহান পেশা। সমাজসোবায় নিয়োজিত সকলেই হল সমাজকর্মী। সমাজকর্মীর ক্ষেত্র সুনির্দিষ্ট নয়। বরং সকলের জন্য উন্মুক্ত।
সমাজসেবার অন্যতম দর্শন ধর্মীয় অনুপ্রেরণা। মানুষের ধর্মবিশ্বাস পরলৌকিক প্রশান্তি ও আত্মার মুক্তির অনন্য উপায়। সৃষ্টির সেবার মাধ্যমে স্রষ্টার সেবা সম্ভব। এ ধর্মীয় অনুভূতির কারণে মানুষ সমাজসেবায় অনুপ্রাণিত হয়েছে। তাছাড়া মানবতাবোধ, মানবপ্রেম, জনসেবা, সামাজিক দায়িত্ববোধ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবেলা প্রভৃতি দর্শনে মানুষ সমাজকর্মে এগিয়ে আসে। এখানেই মানব শ্রেষ্ঠত্বের প্রকাশ। সমাজকর্মে মানব আত্মা বিকশিত হয়। মানবকল্যাণের মাধ্যমে মানবপ্রেম জাগ্রত হয়। প্রাচীন ভারতে সমাজসেবা কার্যক্রমের ইতিহাস অতি প্রাচীন। বৈদিক যুগে ‘সভা‘ ও ‘সমিতি’ নামে দু‘টি পরিষদ রাজাকে জনহিতকর কার্যে সহায়তা করত। মৌর্য আমলে সম্রাট অশোক প্রজার কল্যাণকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। কলিঙ্গ লিপিতে তিনি উল্লেখ করেন ‘প্রজাই আমার সন্তান তাদের ইহলোক ও পরলৌকিক মঙ্গল সাধন আমার একমাত্র লক্ষ্য’। ৭ম শতকে সিন্দু বিজয়ের পর ভারতবর্ষে মুসলমান শাসন ব্যবস্থার সূচনা হয়। বর্ণ বৈষম্যের শিকার অগণিত মানুষ ইসলাম ধর্মের দীক্ষা গ্রহণ করে। এ সময় ফকির-দরবেশ, পীর-আউলিয়া এবং ইসলাম প্রচারকগণ ইসলাম ধর্মের সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও মানবতাবাদ প্রচার করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। দুঃস্থ ও অসহায় মানুষের নিরাপত্তায় শুরু হয় সেবামূলক কার্যক্রম। সুফী-দরবেশগণ সমাজের অসহায় মানুষের সেবায় চালু স্থাপন করে- খানকা, দরগা, মসজিদ, মাদ্রাসা, সরাইখানায়, এতিমখানা ইত্যাদি। ব্রিটিশ শাসতি ভারতে মানুষের কল্যাণে যেসব মনীষী এগিয়ে আসেন তাঁদের মধ্যে স্যার সৈয়দ আহাম্মদ, রাজা রামমোহন রায়, নওয়াব আব্দুল লতিফ, হাজী মোহাম্মদ মহসিন, বেগম রোকেয়া ও বেগম ফয়জুন্নেছা অন্যতম। তাছাড়া কিছু সমাজসেবাম‚লক আন্দোলন এদেশের মানুষের কল্যাণে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। যেমন- ফরায়েজী আন্দোলন, আলীগড় আন্দোলন, ব্রাহ্ম সমাজ, রামকৃষ্ণ মিশন, মোহামেডান সোসাইটি, আনজুমানে মফিদুল ইসলাম ও আনজুমানে খাদেমুল ইসলাম অন্যতম।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ব্রিটিশ সরকার সৃষ্ট আর্ত-সামাজিক সমস্যা মোকাবেলায় উদ্যোগ গ্রহণ করে। পার্লামেন্টের অনুমোদনক্রমে ১৯৪১ সালে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ স্যার উইলিয়াম হেনরী বিভারিজকে প্রধান করে ‘Inter departmental Committee on Social Insurance An Allied Services’ শিরোনামে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ইংল্যান্ডে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির প্রবর্তনে বিভারিজ রিপোর্ট ইতিহাসে অনন্য ঘটনা হিসেবে পরিচিত। বিশ্বের সকল কল্যাণকামী রাষ্ট্রের জন্য এ রিপোর্ট একটি আদর্শ মডেল। কিন্তু পাকিস্তান শাসন আমলে এদের অসহায় মানুষের কল্যাণে কোন সেবাম‚লক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। দীর্ঘ পরাধীনতার জালে এ দেশের মানুষ শোষিত হয়েছে বারবার। অধিকার বঞ্চিত হয়েছে প্রতিক্ষেত্রে। ১৯৭১ সালে জাতীর সর্বশ্রষ্ঠে অর্জন মহান স্বাধীনতা। স্বাধীন দেশের প্রণীত সংবিধানে নিশ্চয়তা প্রদান করা হয় সকল মানুষের মৌল-মানবিক অধিকারের। সংবিধানের ১৫ (ঘ) অনুচ্ছেদে উল্লেখ ‘সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, পিতা-মাতাহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আয়াত্তাতীত কারণে অভাবগ্রস্থতার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার আছে।’ সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে উল্লেখ-‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবে না।’ স্বাধীনতা পরবর্তী ৭৫’এর ১৫ আগস্ট জঘন্যতম হত্যাকান্ডের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়। থমকে যায় দেশের অসহায়, নিঃস্ব ও বিপন্ন মানুষের ভাগ্য বদলের স্বপ্নযাত্রা। শুরু হয় অবৈধ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের অপচর্চা। ১৯৯৬ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হলে ভাগ্যাহত মানুষ খুঁজে পায় আস্থার ঠিকানা। দেশের অক্ষম, অসহায়, ছিন্নমূল, প্রবীণ, প্রতিবন্ধী, বিধবা, গৃহহারা, বাস্তুহারা, বেদে-হরিজন-দলিত-হিজড়াসহ সকল অসহায় জনগোষ্ঠীর জন্য প্রবর্তন করা হয় বহুমুখী সেবা কার্যক্রম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে প্রবর্তন করা হয় ঃ বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিশেষ ভাতা, ভিজিডি, ভিজিএফ, আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ বিবিধ কার্যক্রম। তিনি দেশের বৃহত্তম সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচির প্রবর্তক। একমাত্র তাঁর নেতৃত্বেই সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি প্রতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। চলতি অর্থ বর্ষে সরকার লক্ষ্যমাত্রা ৮৬ লক্ষ ব্যক্তিকে বিবিধ সেবামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে সেবা প্রদান করা। এ খাতে সরকারের মোট ব্যয় ৬৪,৬৬৫ কোটি টাকা। যাহা মোট বাজেটের ১৩.৯২%।
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা। বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে স্বাধীন হয় এদেশ। এখনো দেশের প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে বাস করে। এ হিসেবে দেশের প্রায় ৩ (তিন) কোটির অধিক মানুষ দরিদ্র। তারা হলো দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। তথাঃ হত দরিদ্র, কৃষক , শ্রমিক, অসহায় প্রতিবন্ধী, দলিত, হরিজন, বেদে, ধোপা, মুচি, নাপিত, মেথর, ভাঙ্গন কবলিত বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। দেশের অসহায় প্রান্তীক জনগোষ্ঠী আজ বৈষম্যের শিকার। ব্যথিত হই তখন দেশে ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায় বহুগুণে। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ক্ষমতাধর অনেক দেশকে আমরা ছাড়িয়েছি। তাছাড়া বৈশ্বিক বৈষম্য হ্রাসে আমাদের অবস্থান সুদৃঢ় নয়। সম্প্রতি দাতব্য সংস্থা অক্সফার্ম ‘Commitment to Redacting Inequality Index’ প্রকাশ করে। এ সূচকে বিশ্বের ১৫৭ দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান ১৪৮তম। আবার পরিসখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে দেশের মোট আয়ের ৩৮ শতাংশ আয় করে শীর্ষে অবস্থানকারী ১০ শতাংশ ধনী মানুষ। মোট আয়ের মাত্র ১শতাংশ আয় করে নিম্নক্রমে অবস্থানকারী ১০ শতাংশ দরিদ্র মানুষ। ধনীক শ্রেণীর লোভের তাড়নায় ক্রমেই লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে দেশের দরিদ্রশ্রেণীর অসহায় মানুষ। সমাজে বৃদ্ধি পাচ্ছে নানান বৈষম্য।
বর্তমান সরকার সমাজকল্যাণ বান্ধব সরকার। সমাজের অসহায়, বিপন্ন ও নিগৃহীত মানুষের কল্যাণে বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টা প্রশসংনীয়। সমাজসেবায় হিতৈষী মানুষের অনন্য অবদান আমাদের গৌরবময় ঐতিহ্য। সরকারের পাশাপাশি সমাজের সামর্থ্যবান মানুষকে সমাজসেবায় এগিয়ে আসতে হবে। সমাজকল্যাণ কোন একক প্রচেষ্টা নয়। প্রয়োজন সর্ব মহলের সক্রিয় অংশগ্রহণ। সমাজের ভাগ্যাহত মানুষের জীবনপ্রদীপ নিভে যায় অকালে। ক্ষণস্থায়ী এ জীবনে আশাহীন, নিঃস্ব ও অক্ষম মানুষের কান্নার আওয়াজ শুনতে পাবে তাঁরা, যারা মহাকাল মুক্তির প্রত্যাশা করে। সমাজসেবার মাঝেই মানব উৎকর্ষতা। অসহায় মানুষের প্রতি একটু সহানুভূতিই হবে, মহাপ্রলয়ের দিনের শ্রেষ্ঠ অবলম্বন।

­লেখক : প্রাবন্ধিক