বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের মেগা প্রকল্প সংকটে

16

নববর্ষের ছুটি কাটাতে চীনে গিয়ে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের ভয়ে আটকেপড়া চীনা শ্রমিকদের কেউ কেউ ফিরে এলেও অন্যদের কাছ থেকে তাদের আলাদা রাখতে হচ্ছে। তবে, বেশিরভাগ শ্রমিকই কর্মস্থলে ফিরে আসতে পারেননি। এর ফলে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের মেগা প্রকল্পগুলোর কাজের মেয়াদ বাড়াতে হচ্ছে। কাজের মেয়াদ বাড়লে প্রকল্প ব্যয়ও বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশের মেগা প্রকল্পগুলোর একটি পায়রার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রটির দুই ইউনিটে কাজ করছিলেন প্রায় তিন হাজার শ্রমিক। এরমধ্যে প্রায় অর্ধেক শ্রমিক নববর্ষের ছুটিতে যান। এরপর করোনা ভাইরাসের কারণে আটকা পড়েন তারা। এ কারণে এখনই বাংলাদেশে ফিরতে পারছেন না তারা। এরমধ্যে কেউ কেউ ফিরে এলেও তারা কাজ করতে পারছেন না। তাদের রাখা হচ্ছে আলাদা সেলে। ফলে চলতি মাসে প্রথম ইউনিট পূর্ণ উৎপাদন ক্ষমতায় চালু হওয়ার কথা থাকলেও এখন তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক শাহ আব্দুল মাওলা বলেন, ‘চীন থেকে কিছু শ্রমিক আগে চলে এসেছিলেন। তাদের আলাদা সেলে রেখেছি। বাকিদের মধ্যে বেশিরভাগই চীন থেকে আসতে পারছেন না। কনস্ট্রাকশন কাজে এক ধরনের শ্রমিক আবার অপারেশনে অন্য ধরনের শ্রমিক কাজ করেন। ফলে তারা আসতে দেরি করলে কাজের গতি কমে যাবেই।’ তিনি বলেন, ‘সব মিলিয়ে এখন ১ হাজার ১০০ শ্রমিক কাজ করছেন এই কেন্দ্রে। কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের কাজ শেষ। সে হিসেবে প্রথম ইউনিট চালু করা যাবে কিন্তু পরিচালনা করা যাবে না। কারণ, পরিচালনার কাজ এখনও চীনাদের হাতেই, আর এই কাজের জন্য প্রয়োজন আরও ৩০০ চীনা শ্রমিক। অন্যদিকে দ্বিতীয় ইউনিটের কাজের জন্যও দরকার আরও ৩০০ চীনা শ্রমিক। আগামী ১৫/২০ দিনের মধ্যে যদি তারা ফিরে আসেন, তাহলে পরিস্থিতি সামলে ওঠা যাবে। কিন্তু যদি আরও মাসখানেক সময় লাগে, তাহলে বিপাকে পড়বো আমরা।’ খবর বাংলা ট্রিবিউনের
এদিকে নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি সিরাজগঞ্জে একটি ৭ দশমিক ৬ মেগাওয়াটের সোলার বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছে। কেন্দ্রটিতে ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে চীনের ‘পাওয়ার চায়না’। কিন্তু নববর্ষের ছুটি কাটাতে গিয়ে আটকে গেছেন এই কেন্দ্রের প্রকৌশলী ও শ্রমিকরা। ‘পাওয়ার চায়না’র পক্ষ থেকে জানিয়েছে, শিগগিরই তাদের শ্রমিকরা বাংলাদেশে আসবেন।
একই অবস্থা কুতুবদিয়ার জ্বালানি তেল খালাসের জন্য সাগরের নিচে করা পাইপলাইনের কাজেরও। সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং প্রকল্পের কাজও গতি হারিয়েছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে হলে এখনই দরকার ৬০০ চীনা শ্রমিক। কিন্তু এখন আছে অর্ধেক। অর্থাৎ ৩০০ জন শ্রমিক। এ নিয়ে কাজ করা কঠিন।
এদিকে ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ডিপিডিসি) মাটির নিচে বিদ্যুতের তার ও সাবস্টেশন স্থাপনের জন্য চুক্তি করে চীনের উহানে অবস্থিত টেবিয়ান ইলেকট্রিক অ্যাপারটাস (টিবিইএ) কোম্পানির সঙ্গে। পাইলট প্রকল্প হিসেবে ধানমন্ডি এলাকার সব বিদ্যুতের তার মাটির নিচে নেওয়ার কথা।
জানা গেছে, ২৫০ কোটি টাকার প্রকল্পটি শেষ করতে হলে প্রয়োজন ৩০০ চীনা শ্রমিক। কিন্তু এখন আছে মাত্র ৩৫ জন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিকাশ দেওয়ান বলেন, ‘উহানের কোম্পানিটির যারা নববর্ষের ছুটিতে গিয়েছিলেন তারা কেউই আসতে পারছেন না। ফলে প্রকল্পটি প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে না আসতে পারলে কাজ করানো কঠিন হবে।’
এদিকে, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা উন্নত করতে ১৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সঞ্চালন লাইন উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। আগামী তিন বছরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। এজন্য প্রকল্প শুরু করার সব কাজ শেষ করা হলেও করোনা ভাইরাসের কারণে চীন থেকে কেউ আসতে না পারায় চীনের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করতে পারছে না পিজিসিবি। যদিও পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘আমরা ইমেইলে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছি। চূড়ান্ত চুক্তির সময় এলে তাদের ডাকা হবে। এরমধ্যে করোনা ভাইরাসের কী হবে, তা এখন তো বলা সম্ভব নয়।’
বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব প্রকল্পে অর্থায়ন করছে চীন। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী জনবল, যন্ত্রপাতি, ঠিকাদার সবই নিতে হয়েছে চীনেরই। শুধু জনবল নয়, যন্ত্রপাতিও আমদানিতে সমস্যা হচ্ছে।
বিদ্যুতের তুলনায় জ্বালানি খাতের চীনা শ্রমিকদের অবস্থান ভালো। কাজের গতিও প্রায় আগের মতোই আছে বলে দাবি করেছে কর্তৃপক্ষ। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চীনা শ্রমিক কম থাকায় কাজের গতি কমে গেছে কিছুটা।
জানা যায়, দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনি ও বড়পুকুরিয়া কয়লা চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে কাজ করছেন প্রায় ৪০০ চীনা শ্রমিক। এরমধ্যে কয়লাখনিতে সাড়ে ৩০০-এর মতো চীনা শ্রমিক কাজ করছিলেন। কিছু শ্রমিক নববর্ষের ছুটিতে বাড়ি যান। এরমধ্যে আবার ৫ জন ফিরে আসেন গত ২২ জানুয়ারি। তাদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন সেলে রাখার পর আবার কাজে যোগ দিয়েছেন। কর্তৃপক্ষ জানায়, কয়লা উত্তোলনে কোনও সমস্যা হচ্ছে না। তবে প্রতিদিন প্রায় ৪ হাজার মেট্রিক টন কয়লা উত্তোলন করা হচ্ছে। অন্যদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রে কাজ করেন ৬০-৭০ জনের মতো চীনা শ্রমিক। বেশিরভাগ শ্রমিক দেশের হওয়ায় এই কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কোনও সমস্যা হচ্ছে না। বর্তমানে এই কেন্দ্রের দুটি ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। আসন্ন বোরো মৌসুমে বাড়তি বিদ্যুতের চাহিদার কথা চিন্তা করে তৃতীয় ইউনিট চালুর উদ্যোগ নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ।