বিদায়রাগিণী

115

‘‘কমলাফুলি কমলাফুলি কমলালেবুর ফুল,
কমলাফুলির বিয়ে হবে কানে মোতির দুল।’’

প্রিয় কমলাফুলি,
দীর্ঘ দুই বছরের প্রেমের (প্রবঞ্চনার) পাঠ শেষ করেছ অতি নিপুণভাবে এবং এজন্য তুমি বিশেষ কৃতিত্বের দাবীদার। এই তো সেদিন ব্যাপক ধূমধাম ও জাঁকজমকের মধ্য দিয়ে বাগদান সম্পন্ন হয়ে গেল তোমার। আর আজ অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষায় আছ বিয়ের নরোম সোফায় আরাম করে বসে অমূল্য তোহফা গ্রহণ করবে বলে। প্রিয়তমা আমার, কতটা ডুবেছিলাম তোমাতে আমি তুমি জান। পিঁপড়ে যেমন রসগোল্লার ঝোলে বুঁদ হয়ে থাকে, মদাসক্ত ব্যক্তি যেমন মদ খেয়ে খেয়ে পাঁড় মাতাল হয় তার চাইতেও ঢের বেশি মজেছিলাম তোমার প্রেেেম। অবস্থা এমন ছিল, ওগো কোকিলা সুন্দরী, তোমায় না দেখিলে প্রাণে মরি। সেই তুমি এখন হয়েছ চামার। আমার হৃদয়কে ছুরি দিয়ে কুচি কুচি করে কেটে হোলি উৎসবে মেতেছ। তুমি হাসছ, আমি কাঁদছি। তুমি ভাসমান আনন্দের জোয়ারে, আর আমি গড়েছি বসত দুঃখ-বেদনার খোঁয়াড়ে। কী বৈপরীত্য দেখ! যা চাই না তাই হয়। বিশ্বাসের ক্ষয়। ছলনার জয়। প্রেমিক চেতনার বিলয়।

তোমরা হাজারপতি। আমি লাখপতি। তোমার বর কোটিপতি। লোভ সামলানো দায়ই বটে। যে পারে সে লাখে একজন, ওয়ান ইন মিলিয়ন। তুমিও লাখে একজন। তবে গুণে নয়, রূপে। রূপের টোপ ফেলে এবং ‘রাঙ্গা লেড়কির ভাঙ্গা ভাঙ্গা হাসিতে’ শিকার করেছ বিশাল এক টাকার বোয়াল। তাতে করে মজবুত হয়েছে চোয়াল। তাই তো তেজালো কথার জোরালো খই ফুটেছে তোমার মুখে। অন্যায্য অনেক কথা শুনিয়ে দিলে আমায়। তোমার শক্ত কথার অশক্ত জবাবও দিতে পারিনি আমি। অবাক বিস্ময়ে হা করে চেয়ে থেকেছি কেবল তোমার মুখের দিকে। এমনও কি হয়! এও কি সম্ভব! জানা ছিল না। এখন জানি। তোমার কল্যাণে জেনেছি। ধন্যবাদ তোমাকে। বুঝতে পারছি, মিষ্টি আমেই পোকা পড়ে বেশি। আর বলছি শোন, ‘এখন তোমার পড়েছে পাশা, গড়িয়ে নিও ঝুমকো খাসা’।

গোলাপ আমার অতি প্রিয় ফুল। আর তুমি হলে রক্ত মাংসময় লাল গোলাপ। সুখের প্রলেপ দেওয়া সেই দিনগুলোতে তুমি যখন কাছে আসতে, চলনে-বলনে-গড়নে ছন্দ তুলে আমার বন্ধ দুয়ার খুলে দিতে, মনে হত, সুবাসিত হয়ে উঠেছে আমার আশ-পাশ চারপাশ। সুস্বাদু ব্যঞ্জন খাওয়ার মতন অসাধারণ ব্যঞ্জনায় মন আমার আনচান করত। তখন খুশির ঘোটকে সওয়ার হয়ে, তুমি জান, কবির ভাষা সুর করে কত কী বলতাম- তোমার চাঁচর কেশে পরিয়ে দেব ঝুমকো জবার ফুল, ঢুলঢুলে ওই চোখের চাহনি ভুলিয়ে দিল ঝিল্লিরই ধ্বনি। আরও কত কত প্রলাপ বকেছি আপন মনে এবং ধন্য হয়েছি। এই না দেখে পাহাড়ী ঝর্ণার মত কলকল রব করে তুমি হেসে উঠতে। এবং বলতে, পাগল! ঠিক তাই। তোমার প্রেমে ছিলাম বদ্ধ উন্মাদ। ফলতঃ তখন বকতাম প্রলাপ, আর এখন করি বিলাপ । সময়কালে বুঝিনি (এ কাজে মানুষ চিরকালই আনাড়ী), এখন বুঝতে পারছি, অতি পিরিতে বিষম জ্বালা, কম পিরিতেই থাকা ভালা।
হায়, সময়ে কী না হয়!

প্রথম যেদিন লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে বলেছিলে ভালবাসি সেদিন মনে হয়েছিল,“মাদল বাজিয়ে এল বাদলমেঘ, মাতলা হাওয়া এল বনে”। সেই আমার এখন চৈত্রের খরতাপে মরণদশা। তোমার প্রেমে যতন করে মগন হয়ে এখন আমি নিঃস্ব। আর এককালের সর্বহারা তোমার বর একালে এসে ক্ষুধা পেলে টাকা চিবিয়ে চিবিয়ে খায়। টাকা নাকি তোমার রাজনীতিক বরের হাতের ময়লা। হবেই তো, ওগুলো যে সব কালো টাকা। আর তোমার বর হলেন এদেশের নষ্ট রাজনীতির দৃশ্যমান প্রতিভূ।

সখী, বড় শখ করে অনেক আদর করে ভালবেসে কমলাফুলি নামের তুলিতে তোমার ছবি আঁকতাম প্রতিনিয়ত। তুমিও খুব সায় দিতে। আর এই নামের ব্যাপকতায় আড়াল পড়ে গেছে তোমার বাবা-মায়ের দেয়া নাম। ওটা খুব একটা মনেই পড়ে না এখন। বেশ কসরত করতে হয়। কারণ চর্চা নেই যে। এমনি করে তুমিও একদিন খরচা হয়ে যাবে আমার মন থেকে। এটাই স্বাভাবিক এবং এটাই সত্যি।
সময়ে কী না হয় বল!

আগে মানুষ উড়তে পারত না। এখন তার পাখা গজেছে। পাখির মত ডানা ঝাপটে চলে যেতে পারে দূর বহুদূর । পাড়ি দিতে পারে সাগর-পর্বত নদী- জনপদ। আমিও উড়াল দেব সখী বিদেশ বিভূঁইয়ে। সাত সমুদ্দুর তের নদী পাড়ি দিয়ে চলে যাব ভিনদেশে পৃথিবীর একেবারে শেষ প্রান্তে। এজন্য নয় যে, তুমি আমাকে ত্যাজ্য করেছ এবং আমি পরমহংস হব বলে ব্রত নিয়েছি। বরং আমি হারিয়েছি এই জনপদে বাস করার যোগ্যতা। তোমাকে পেয়েও জীবনে জড়াতে পারিনি। আর আশপাশের ছাই-পাঁশকে ‘না’ না বলে পারছি না। এ আমার ব্যর্থতা, একান্তই আমার। এখানে এখন ইচ্ছা বুঝে কিচ্ছা তৈরী করা হয়। জাতির বিবেক করে হাঁসের মত প্যাকপ্যাক। এ-কার দাবী করে সে আ-কার। তাই তো টানেলের শেষপ্রান্তে দৃষ্টিগোচর হয় না কোন আলোকরশ্মি। ওখানে আছে কেবল শক্ত জমাটবাঁধা অন্ধকার। কোথাও কোন আশা তো নেই নেই, ভালবাসাও নিঃশেষ । নির্মমতার চরমতা লক্ষণীয় সর্বত্র। আমরা সবাই যেন এখন উল্টো পথের পথিক।
আমি জানি, ওই দেশে আমার জন্য বরাদ্দ থাকবে তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকের অধিকার। খুশির কথা নয় জেনো। কিন্তু তাও কি মন্দের ভাল নয়? তখন তো আর স্বচক্ষে দেখতে হবে না বিষ ফরমালিন ভেজাল খেতে খেতে আমার প্রিয় স্বদেশের কান্না, বুড়িগঙ্গার প্রতিনিয়ত বুড়িয়ে যাওয়া। সেদিন ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটা দেয়াললিখন চোখে পড়েছিল। একটা খাদ্য কোম্পানীর বিজ্ঞাপন, বিশুদ্ধতার রাজ্যে আমরাই সেরা। আচ্ছা, তুমি কি আমাকে ধারণা দিতে পার, এদেশে কোন জিনিসটা ভেজালমুক্ত আছে? মাছ মাংস ফলমূল সব্জি প্রেম ক্ষমতা পুলিশ দুদক পরিহন প্রশাসন সব ক্ষেত্রই তো দেখি ভেজালে ভেজালে ছয়লাব।
সময়ে সত্যিই অনেক কিছু হয়, জান তো।
জার্মানীর রাইন নদী একসময় নাকি মৃত্যুক‚পে পতিত হয়েছিল, এখনকার ঢাকার বুড়িগঙ্গা যেমন। এখন সেই নদী যৌবনে টইটুম্বুর, তারুণ্যে ভরপুর। আমি যদি বেঁচে থাকি, বুড়িগঙ্গা যদি কখনও দখলমুক্ত হয় পুরোপুরি, দূষণ দূর হয়ে যদি ভূষণের সুর বাজে সত্যি সত্যি, আমার ইচ্ছা, আমি আবার ফিরে আসব এদেশে একেবারে তল্পি-তল্পা সহযোগে। মায়ের ভূমির আলো-হাওয়ায় শ্বাস নেব বুক ভরে, মাটিতে গড়াগড়ি খেয়ে মিটাব মনের আশ। তখন আমার চেয়ে সুখী বল আর কে হবে এই ভবেতে?

আর ততদিন পর্যন্ত যদি খাঁচার ভিতর ইতি-উতি করে তোমার অচিন পাখি, প্রাণবায়ু উড়ে না যায় ঊর্ধ্বমুখে সাত আসমান পাড়ি দিয়ে অনেক দূরে, আমার সর্বান্তকরণ পণ থাকবে তোমায় খুঁজে বের করার। আমি দেখতে চাইব তুমি কেমন থাকো। এ কথার আবার উল্টো অর্থ করো না যেন। রাজনীতির মানুষদের মত প্রতিহিংসায় আমার গরজ নেই। তোমার সুখই আমার সুখ। যশোদা কী ভাগ্যবতী, পরের পুতে পুত্রবতী- আমার হয়েছে সেই দশা। যাকগে, সহজ ও দরাজ গলায় প্রার্থনা করি, তোমার জীবন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠুক টক-ঝাল-মিষ্টি স্বাদে। সুখের হউক তোমার কান্না। সমস্যা হউক মধুর।

অনেক হা-পিত্যেশ করেছি সখী, অনেক কেঁদেছি। তাতে কোন লাভ হয় না দেখি। যা হওয়ার তাই হয়। মলয় অথবা প্রলয়। ভাল থেকো, অনেক অনেক ভাল। থানকুনি পাতার গুণে সমৃদ্ধ হও তুমি। তোমার মাতাল মন মগন হইক মাতনে। আমি অধম করি মাতম।
প্রীতিসহ ইতি চিরকালের জন্য।