বিজয় সমাগত!

55

১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর দিনটি ছিল শনিবার। এইদিন বাংলাদেশের সকল রণক্ষেত্রে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকায় হানাদার বাহিনী সর্বত্র পিছু হটছিল। পাকিস্তানি বিমানবাহিনী ক্রমশঃ পঙ্গু হয়ে পড়ছিল। সীমান্ত শহর দর্শনা সম্মিলিত বাহিনীর দখলে চলে আসে। এদিকে ভারতীয় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী বাংলাদেশে দখলদার বাহিনীর ওপর প্রচন্ড আক্রমণ চালায়। চতুর্দিক থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এগিয়ে আসে। ঢাকা চট্টগ্রাম করাচি-শত্রূর ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে চলে বোমাবর্ষণ। ঢাকা ও চট্টগ্রামের আকাশে চলে জোর বিমান যুদ্ধ। সর্বাত্নক যুদ্ধের এইদিনে পশ্চিম সেক্টর থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর সবকটি কলাম পূর্বে এগিয়ে যায়। কোথাও তারা সোজাসুজি পাকঘাঁটিগুলোর দিকে এগোয় না। মূল বাহিনী সর্বদাই ঘাঁটিগুলোকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। সেই সঙ্গে পাকবাহিনীকে বিভ্রান্ত করার জন্য প্রত্যেক ঘাঁটিতে অবিরাম গোলাবর্ষণ চালাতে থাকে। ভারতীয় বিমান এবং বিমানবাহিনীর জঙ্গী বিমানগুলো বারবার ঢাকা, চট্টগ্রাম চালনা প্রভৃতি এলাকায় সামরিক ঘাঁটিগুলোর ওপর আক্রমণ চালায়। ঢাকার বিমান যুদ্ধ মারাত্নক আকার ধারন করে । ঢাকা ছিল পাক বিমানবাহিনীর প্রধান ঘাঁটি। এই ঘাঁটিতেই ছিল তাদের জঙ্গী বিমানগুলো। পাক বিমানবাহিনীতে ছিল দুই স্কোয়াড্রন (২৮টি) জঙ্গীবিমান। এক স্কোয়াড্রন চীনা মিগ-১৯ আর এক স্কোয়াড্রন মার্কিন স্যাবর জেট। প্রথম রাতের আক্রমণেই পাকিস্তানের বিমান-বহরের প্রায় অর্ধেক বিমান ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনীর মিলিত প্রত্যাঘাত, ভারতীয় বিমানবাহিনীর আক্রমণ ও নৌবাহিনীর অবরোধের মাধ্যমে পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধের চরিত্র এভাবে আমূল পরিবতির্ত হয়। ভারত গেরিলা বেষ্টিত ঢাকায় ফাইটার দিয়ে সব দিক থেকে আক্রমণ শুরু করে। প্রায় ৮০০০ গেরিলা সারা শহর সক্রিয় ছিল। গুল টেক্সটাইল মিলসে মুক্তিফৌজের গেরিলারা শত্রূদের বাংকারে হামলা চালিয়ে ২৭ সৈন্যকে হত্যা করলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সেই এলাকা থেকে পিছু হটে। ১১ দিন অবরুদ্ধ থাকার পর এইদিন বিকাল ৩ টার সময় হানাদার বাহিনীর কামালপুর ঘাটির সেনারা মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। নিয়মিত বাহিনীর ২২০ জন সদস্য বিপুল অস্ত্র শস্ত্রসহ বন্দী হয়। এই অবরোধ চলাকালে তারা ৭ দিন বাইরে আসার চেষ্টা করলে বিপুল বাধার সম্মুখীন হয়ে অপুরনীয় ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিল। তিনদিন ধরে কামালপুর থেকে মুক্তিবাহিনীর অবরোধ ভেঙ্গে পাকবাহিনী বের হয়ে যাবার চেষ্টা করলে অনেক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। কামালপুরের পতন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকবাহিনী ময়মনসিংহের মেঘালয় সীমান্তের সব এলাকাতে মনোবল হারিয়ে ফেলে এবং দ্রুত পশ্চাদপসারণ করে। জামালপুর,ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনায় মুক্তিবাহিনীর অভিযান করার জন্য সমবেত হয়। ভালুকা থানার চাপড়াবাড়ী এলাকায় রাজাকারদের উপর আক্রমণ চালিয়ে ৩ জন রাজাকার হত্যা করা হয়। একই দিন কোম্পানী কমান্ডার মোছলেহ উদ্দিন আহমেদ ও প্লাটুন কমান্ডার গিয়াসউদ্দিন আহমেদ একদল মুক্তিসেনা নিয়ে কাঠালী ও বাশিল এলাকায় পাক বাহিনীর উপর আক্রমণ করলে ৭ জন পাকসেনা ও ১০ জন রাজাকার নিহত ও কয়েকজন আহত হয় । ৪ নম্বর সেক্টর কমান্ডার লে.কর্নেল সি আর দত্ত এবং জেড ফোর্সের মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সিলেটের কানাইঘাট দখলের পর এলাকায় শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করেন। ৩ নং সেক্টরের মুক্তিবাহিনী শমশের নগর বিমান বন্দর এবং আখাউড়া রেল স্টেশন দখল করে। ৮ নং সেক্টরের মুক্তিবাহিনী মেহেরপুর দখল করে যশোরের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। পাকবাহিনী দিনাজপুরের ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশন দখলে রাখার সর্বাত্মক পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পাকিস্তান নৌ-বাহিনীর সাবমেরিন পিএনএস গাজী বিশাখাপত্তম বন্দরের কাছে আক্রান্ত হয়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। আন্তর্জাতিক রাজনীতি অঙ্গনে বাংলাদেশের জন্য এইদিনটি ছিল অস্থির আর উদ্বেগের। পাকিস্তানের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি সিনিয়র জর্জ বুশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করেন। যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে দাবি করে যে, ‘এ মুহূর্তে ভারত ও পাকিস্তান নিজ নিজ সীমান্তের ভেতর সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে হবে।’ এই যখন উৎকণ্ঠাময় অব¯’া তখন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ লিখিত পত্রে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের আহব্বান জানান। যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাস করানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র তখন বৈঠকের পর বৈঠক করছে। সবাই যখন চরম উদ্বেগ আর চিন্তার মধ্যে ছিলেন তখন এলো খুশির সংবাদ। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো প্রদানের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে ভেস্তে যায়। পোল্যান্ডও এ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। তবে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের এ যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত থাকা। প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র যখন হেরে গিয়েছিল তখন পক্ষান্তরে পাকিস্তানের পরাজয় সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। চরম মুহূর্তেও পাকিস্তানীদের দোসর স্বাধীনতা বিরোধীরা হাল ছাড়েনি। জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা আবুল আলা মওদুদী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, প্রতিটি দেশপ্রেমিক মুসলমান প্রেসিডেন্টের পেছনে রয়েছে। এক বিবৃতিতে ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা করলেন : Todaz, the war in Bangladesh has become a war on India…. We have no other option but to put our countrz on a war footing .প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দুপুরে জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে ভারতের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা করে বলেন, আমরা অনেক সহ্য করেছি। এখন শত্রূর প্রতি চরম ধ্বংসাত্মক প্রত্যাঘাত হানার সময় এসেছে। আমাদের সেনাবাহিনী শত্রূকে কেবল আমাদের ভূখন্ড থেকেই বিতাড়িত করবে না, শত্রূর ভূখন্ডে গিয়ে তাদের নির্মূল করবে। তিনি সেনাবাহিনীর প্রতি প্রতিপক্ষকে চরম আঘাত হানা এবং সীমান্ত অতিক্রম করার নির্দেশ দেন। এইদিন দুপুরে ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে ভারতের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা করে বলেন, আমরা অনেক সহ্য করেছি। এখন শত্রূর প্রতি চরম ধ্বংসাত্মক প্রত্যাঘাত হানার সময় এসেছে। রাওয়ালপিন্ডিতে একজন সরকারি মুখপাত্র বলেন, পাকিস্তানের উভয় অংশে যুদ্ধ চলছে। পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় চাপ মোকাবিলা করা হচ্ছে। মুখপাত্র বলেন, পাকিস্তানের প্রতি দৃঢ় সমর্থন দেবে বলে চীন ওয়াদা করেছে। চীনের অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী চি পেং ফেই এ দিনে পাকিস্তানের ওপর ভারতীয় হামলার নিন্দা করে ইসলামাবাদকে দৃঢ় সমর্থন দেয়ার অঙ্গীকার করেন। মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে বাংলাদেশের প্রতিটি জায়গা থেকে পালানোর পথ খুঁজতে থাকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এইদিন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রিরা গান্ধিকে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক চিঠিতে বলেন-মাননীয়া, ৩ ডিসেম্বর আপনাদের দেশে পাকিস্তান সামরিক জান্তার অতর্কিত আক্রমনের কথা শুনে আমরা গভীর ভাবে শোকাহত। সা¤প্রতিককালে ইয়াহিয়া খানের আন্তর্জাতিক চুক্তির বেপরোয়া লঙ্ঘন এটাই চ‚ড়ান্তভাবে প্রমান করে যে তিনি এই উপমহাদেশের দেশগুলোতে অশান্তি, ধ্বংস এবং আর্থ-সামাজিক অস্থিরতার পরিস্থিতি তৈরি করতে চান । পশিচম পাকিস্তান সরকারের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে বাঙালিরা তাদের বিরুদ্ধে ৯ মাস সংগ্রাম চালায়। ১৫ অক্টোবর ও ২৩ নভেম্বর আমরা বার্তা পাঠিয়েছিলাম যে সামরিক জান্তা কে পুরোপুরি পরাস্ত না করা পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব। ইয়াহিয়া ও তার জেনারেলদের মাধ্যমে আপনার দেশে যে ধ্বংস সঙ্ঘটিত হয়েছ এখন আমাদের উচিত এই আগ্রাসন দমন করতে কাঁধে কাধ মিলিয়ে এর প্রতিবাদ করা ও স্বাধীনতা লাভের জন্য একজোট হওয়া । মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমরা জানাতে চাই ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আপনাদের দেশে যে আগ্রাসী হামলা চালিয়েছে, মুক্তিবাহিনী তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রস্তুত। তাই আমি অনুরোধ করতে চাই, আমরা যদি ক‚টনৈতিক ভাবে একজোট হই তাহলে সহজেই আমাদের কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা লাভ করতে পারব । আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই যে বাংলাদেশের মানুষ ও বাংলাদেশ সরকার এই দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে যেকোনো বিপদেই দুই দেশের পাশে সমানভাবে দাঁড়াবে। আমরা আশাবাদী যে আমাদের এই একতা ইয়াহিয়া বাহিনীর ঘৃণ্য চক্রান্তকে প্রতিহত করবে ও আমাদের কে একটি আশাব্যাঞ্জক ফলাফল দিবে। আমরা যেকোন বিপদেই আপনাদের পাশে দাঁড়াব ও পূর্ণ সহযোগিতা করব।