বিজয় আনন্দ

108

অনেকদিন যুদ্ধ করার পরে মুক্তিযোদ্ধারা স্বস্তি পায়। ওদের সাহস বাড়ে। যেখানে সেখানে অতর্কিতে হামলার প্রস্তুতি নিতে পারে। ওরা এখন অনেক পারদর্শি।
এবার মুক্তি মুক্তিযোদ্ধাদের চতুর্দিকে শক্তি বাড়ে। পাকসেনারা আগের মতো যুদ্ধে সুবিধা করতে পারছেনা। প্রতিটি ঘরে ঘরে বিজয় উল্লাস। সবার মনে একটি কথা, এই বুঝি দেশ স্বাধীন হলো।
তারপরও সবাই ভয়-আতংকে দিন কাটে। পাকসেনাদের সাথে রাজাকার, আলবদরের সারাক্ষণ উঠবসা, ছুটাছুটি। যে কোন সময় অঘটন ঘটতেই পারে। গ্রামের চেয়ারম্যান মুসলিম লীগের। সানাউল্যা চৌধুরী। অগাধ সম্পত্তির মালিক। শহরে ব্যবসা আছে। প্রতিদিন তার বাড়িতে অনেক রাজাকার, আলবদরা খায়। মুক্তিযোদ্ধার ভয়ে চেয়ারম্যানকে পাহাড়া দেয় ওরা। রাতে মুক্তিযোদ্ধার ভয়ে ঘুমুতে পারেনা। কতজনের বাড়ি পুড়েছে, অনেককে গ্রাম থেকে তাড়িয়েছে। হিন্দু মুসলিম বাদ নেই। যারা আওয়ামী লীগ, তাদের প্রতিদিন অত্যাচার করে। জমিনের ধান কেটে আনে। গরু, ছাগল নিয়ে আসে। একদিন পানজাবী আসবে খবরটা জেনে রুস্তমের দু’টি ছাগল, পাঁচটা মুরগি, তিনটা হাঁস নিয়ে আসে। পাকসেনাদের ভাত খাওয়াবে।
কারণ রুস্তমের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা। রুস্তম আওয়ামী লীগ করে। রুস্তমও বিত্তশালী। যথেষ্ট টাকাকড়ির মালিক। সানাউল্লার চেয়েও ধনী। বর্তমানে ক্ষমতা, শক্তি দু’টোই নেই।
দেশতো এখন পাকিস্তানীদের।
সানাউল্লা চেয়ারম্যান রুস্তমকে ভয় পায়। রুস্তম সাহসী, ন্যায়নীতি, সৎ মানুষ। গরীবদের ভালোবাসে। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য শত্রæতা বাড়ে দু’জনের। একজন প্রভাবশালী রাজাকার প্রিয়,অন্যজন মুক্তিযোদ্ধার প্রিয়। চেয়ারম্যানের ঘরে রাজাকারের খাওয়া দাওয়া। রুস্তমের ঘরে মুক্তিযোদ্ধার খাওয়া চলে। তবে গভীর রাতে।
চেয়ারম্যানের ইচ্ছে পাকিস্তান থাকুক দেশটা। কি সুখ এখন। আমাদের রাজত্ব। আওয়ামী লীগ মাথা তুলে কথা বলতে পারেনা। দেশ স্বাধীন হলে আমাদের ক্ষমতা থাকবে না। হবে নতুন বাংলাদেশ।
কি দুঃসাহস মুক্তিযোদ্ধার! বাংলাদেশ বানাবে দেশকে! এতই সহজ?
সেই রাতেই মুক্তিযোদ্ধারা ঘিরে রাখে চেয়ারম্যানের বাড়ি। রাজাকারদের ভারি অস্ত্র নেই তেমন। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিজনের হাতে আধুনিক ভারি অস্ত্র। মটর,

স্টেনগান, এস এ লার,গ্রেনেড, হাতবোমা আরো কত কি?
রুস্তমের ছেলে আবদুর রহিম মুক্তিযোদ্ধার কমান্ডার। মুখে খোঁচা দাড়ি। মাথায় গামছা বাঁধা। চোখে আগুন জ্বলছে যেন। বিশ জনের দলের কমান্ডার রহিম। রাজাকারদের হাত- পা বেঁধে চেয়ারম্যনকে খোঁজে। পায়নি, পালিয়েছে। ভীষণ চালাক সানাউল্লা। কিভাবে খবর পেলো কে জানে? রহিম কমান্ডারের অর্ডার প্রত্যেক রাজাকারকে গুলি করে হত্যা করা। ভোরের আগে মুক্তিযোদ্ধারা তাই করে। রক্তাক্ত শরীরে সবাই কাঁদছে। ভোরের সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধারা পাহাড়ে ছুটে যায়। রাজাকার হত্যার কারণে পানজাবীরা আসতে পারে।
আজ সারাদিন যুদ্ধ চলছে পানজাবির সাথে মুক্তিযোদ্ধার। ইতোমধ্যে ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। মুক্তিযোদ্ধার সাথে ভারতের মিত্রবাহিনী যোগ দেয়। মুক্তিযোদ্ধার শক্তি বাড়ে। পাকসেনাদের জলে, স্থলে,আকাশে চতুর্দিকে আক্রমণ করে।
পাকসেনা এবার পালায় কোথায়? চারিদিকে কাবু হয়ে সারেন্ডার করে পাকবাহিনী। সেদিন আকাশ কালো ধোঁয়ায় অন্ধকার ছিলো। বিকেলেই রাস্তায়, হাটে বাজারে, সব জায়গায় মানুষের ঢল নামে। মুখে হাসি,কন্ঠে যুদ্ধজয়ের গান।
সন্ধ্যার পরপর চারিদিকে গুলির শব্দ। তখনও আলোয় সব দেখা যায়। ব্যাপার কি কেউ বুঝতে পারেনা। আবার ও চারিদিকে থমথমে পরিবেশ।
সবাই ভয়- আতংকে দৌঁড়ে। সবার মুখে একটি কথা, আবার কি হলো। ঠিক তখনই একগাল হাসি মুখে ছুটে হাসে রুস্তম। সবাই রুস্তমকে ঘিরে প্রশ্ন করে,
-আবার কি হলো রুস্তম?
রুস্তমের ছোট মেয়ে নাসিমা বাবাকে জড়িয়ে ধরে। সেও ভয়ে কাঁপছে। নাসিমা ছোট গলায় বলে,
– বাবা পানজাবিরা আবার এসেছে?
রুস্তম মেয়ের উপর চোখ রেখে হাসে। অট্টহাসিতে ভেঙে পরে একসময়। নাসিমা অবাক। জিগ্যেস করে বাবাকে, -বাবা তুমি হাসছো? তখন আবার গুলির শব্দ। বাবাকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে নাসিমা।
এতক্ষণ পরে রুস্তম মুখ খোলে।
বলে, কোন ভয় নেই। এই গুলির শব্দ বিজয়ের। দেশ স্বাধীন হয়েছে। পাকসেনারা আত্মসমর্পন করেছে। জয়বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। নাসিমা আনন্দে বাবার গালে তুলতুলে ঠোঁট বসিয়ে বলে,- জয়বাংলা।বাবার মন ভরে যায় নাসিমার যুদ্ধজয় আনন্দে।