বিজন ভট্টাচার্য থিয়েটারের অমৃতপুত্র

336

‘আবেগ না হলে বোধহয় কবিতার জন্ম হয় না- অনুভূতি না থাকলে জীবনযন্ত্রণা না থাকলে কোনো সৃষ্টিই বোধহয় সম্ভব নয়।
কথাগুলো বলেছিলেন বাংলা নাটকের দিকপাল বিজন ভট্টাচার্য। এবং আমি এই কথাটি ধরে এগিয়ে গিয়েছি আমার থিয়েটারের ত্রিশ বছর। ত্রিশ বছর কি খুউব একটা বেশি সময়? না। আমি বলবো, না। আমি আরো এক জন্ম তপস্যা করবো শুধু থিয়েটারের জন্য।
লিখার জন্য লিখা নয় বরং মনের টানে আজ এমন একজন মানুষ সম্পর্কে কিছু বলবো, তার যোগ্যতা আমার কতটুকু আছে তা আমি জানি।
কি যোগত্যার বলে বলিয়ান আমি, যে থিয়েটারের বিজন ভট্টাচার্য সম্পর্কে বলবো?
আমার পড়া পঞ্চপান্ডবের একজন তিনি, অপর পান্ডবেরা হলেন,গীরিশ ঘোষ, শিশির ভাদুরী, উৎপল দত্ত,শম্ভু মিত্র। দায়িত্বের বলে তাই আমি লিখছি…
ইংরেজি ১৯১৫ সালের ১৭ জুলাই ফরিদপুরের খানখানাপুর গ্রামে জন্মগ্রহন ইতিহাসের এই ক্ষনজন্মা মানুষটি। পিতা ক্ষীরোদবিহারী আর মাতা সুবর্ণাপ্রভা। বিজন ভট্টাচার্য পাঁচ ভাই বোনের জ্যৈষ্ঠ। শৈশবের পাঠশালা খানখানাপুর সুরাজমোহনী ইনিস্টিটিউশান। সেই পাঠশালার প্রধান শিক্ষক তাঁর পিতা। পরবর্তীকালে বসিরহাট, সাতক্ষীরা হয়ে ১৯৩০ সালে কোলকাতায়। ভর্ত্তি হলেন আশুতোষ কলেজে। কিন্তু মহিষবাথনে লবণ-আইনভঙ্গে অংশগ্রহণ, অতএব বিএ পড়ার ছেদ। ১৯৩৮ আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগদান করেন এবং নাম লিখান পুরদস্তর সাংবাদিকতায়। ১৯৪০ সালে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আসক্ত হলেন এবং ১৯৪২ সালে তৎকালীন কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মুজফ্ফর আহমেদের স্নেহধন্য হয়ে হোলটাইমার হলেন পার্টির। ১৯৪২-এ ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ থেকে ফ্যাসি-বিরোধী জনযুদ্ধ ইত্যাদীতে ভারত উপমহাদেশ তখন উত্তাল। ওয়াই-সি-আই-এর সাংস্কৃতিক অভিযান শুরু হয়েছিল১৯৪০ সাল থেকে। ‘ফ্যাসি বিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ’ গঠিত হয় ১৯৪২ সালে। আর এখান থেকেই গড়ে উঠল ভারতীয় গণনাট্য।
১৯৪২-সালে প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সদস্য ছিলেন উপমহাদেশের এই প্রখ্যাত বাঙালি নাট্যব্যক্তিত্ব। যাঁর তুলনা শুধু তিনি। গণনাট্য আমাদের অনেক তুখোড় অভিনেতা দিয়েছেন- দিয়েছেন নাট্যকার কিম্বা নাট্যবোদ্ধা।
মূলত বিজন ভট্টাচার্যের নাট্যজীবনের শুরু হয় ১৯৪০-এ। বিজন ভট্টাচার্য ছিলেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘের প্রথম সারির নাট্যকর্মী। ১৯৪৮ সালে গণনাট্য থেকে বেরিয়ে এলেন। ১৯৫০ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ক্যালকাটা থিয়েটার’। নবান্ন’র বিজন ভট্টাচার্য গণনাট্যের কাছে যে শপথ নিয়েছিলেন, শোষিত জনগণের আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার- সেই বক্তব্যকেই বুকে লালন করে এগিয়ে গেলেন এক মহীরূপে। কিন্তু ‘ক্যালকাটা থিয়েটার’র সংগে বিশ বছরের সংসার জীবন ক্ষান্ত করে আবার নতুন করে শুরু করলেন এবং আমৃত্যুই থেকেছেন নতুন সাজানো ‘কবচ-কুন্ডল’-এ। ‘কবচ-কুন্ডল’ তাঁর শেষ সংসার।
বিজন ভট্টাচার্যই বোধ হয় এই উপমহাদেশে একমাত্র নাট্যকার, যিনি জীবনে কোন অরাজনৈতিক নাটক লেখেননি। কেননা কোনো সাহিত্য কীর্তিই অরাজনৈতিক নয়। অর্থ্যাৎ লেখকের মননে যে আর্দশ লুকিয়ে থাকে তারই উন্মেষ ঘটে তার প্রতিটি সাহিত্যকর্মে।
বিজন ভট্টাচার্য রাজনীতি চেতনার ভিত্তি গ্রাম-বাংলার অন্তরঙ্গ অভিজ্ঞতা ও মার্ক্সীয় ইতিহাস দর্শন? একটা কথা ভুললে হবে না, যে দেশে গ্রামই প্রধান, সে দেশে গ্রাম থেকেই আমাদের সমাজ পরিবর্তন আরম্ভ হওয়া উচিত, এই বিশ্বাস তাঁর সুদৃঢ় ছিলো বলেই তিনি একজন বিজন ভট্টাচার্য হতে পেরেছেন? আর আমরা নৈবচ।
বিজন ভট্টাচার্য তাঁর সূদৃঢ় চেতনার লাঙ্গল ফলায় জেনেছেন সংস্কারের জগদ্দল পাথরকে। যেমন জেনেছেন গ্রামীণ চেতনাকে অবরুদ্ধ করে রেখে, কোনো রাজনৈতিক ফয়সালা কিংবা অর্থনৈতিক ভাবে শহুরে মসনদ আলোকিত হয়নি -হবেনা। তাই গ্রামীণ বিশ্বাসকে নাড়া দিতে হবে? এর কোন বিকল্প নেই।
বিজন ভট্টাচার্যের নাটকে আমরা দেখতে পাই গ্রামের মুক্তি মানেই রাজনৈতিক মুক্তির পথ। এমন কি সেদিনের নকশালবাদীরা পর্যন্ত বিজন ভট্টাচার্যের দেখানো পথেই ওদের নির্দেশনা স্থির করেন। আর সেদিনের ক্ষমতাবানরা নকশালবাদীদের অস্বীকার করতে গিয়ে গ্রামের রাজনৈতিক রূপান্তরের গুরুত্বও কমিয়ে দেখেছিলেন। একধরনের ফ্যসিবাদী চিন্তার মননের কাছে আমরা বারবার নিগৃহীত হচ্ছি। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিজন ভট্টাচার্যের নাটকগুলির গুরুত্ব আজও অপরিসীম বলে আমার মনে হয়।
জনগণই তাঁর নায়ক-শৈশব থেকে যে দর্শন লালিত ছিল মননে সেই মানবদর্শন হতে পিছু হটেননি বিজন ভট্টাচার্য। আপোষহীন ভাবে ছুটে গিয়েছিলেন মানুষের কাছে। মানুষের কাছ থেকে পাঠ নিয়েছেন। সারা বঙ্গদেশের মানুষের জীবন দেখে চিনেছেন এবং চিনতে শিখিয়েছেন। অগণিত ভুখা মানুষের মিছিলে পথ হেঁটে খুঁজে বেরিয়েছেন মানবিক মুখ। সেই অন্তহীন খোঁজার মধ্য দিয়ে জীবনের পথ চলা। অন্ধকার থেকে আলোয়- অতীত থেকে কালাকাল পার হয়ে জনচিত্তে বেঁচে থাকা, বেঁচে ওঠা, প্রতিরোধ, প্রতিবাদ, গণ অভ্যুত্থান। রিয়ালিজম্ থেকে অ্যাবস্ট্রাকশনের অভিমুখী যাত্রা।
এক চলমান ট্র্যাজেডির নায়ক বিজন ভট্টাচার্য। তাই তিনি প্রায় বলতেন গণনাট্য তখনই সম্ভব হইবে যখন গণেরা নাট্যে অনুষ্ঠান করিবে।’
আজকের সভ্য ইতিহাস হয়তো আলো আঁধারের তাপস বিজন ভট্টাচার্যকে ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’ উপাধিতে ভুষিত করতে পারবেনা, কিম্বা মঞ্চ সম্রাটের মুকুট হয়তো তাঁকে পরাবে না। তবুও সব পার্থিব উপকরণে একটু চেষ্টা করি থিয়েটারের তাঁকে অমৃতপূরুষ বলতে।
কারো বলাবলিতে তাঁর কোনো আসক্তি ছিল না।
কিন্তু ইতিহাস? আমরা যারা আজ পথের কথা বলি কিম্বা গণমুখী নাট্য আন্দোলন করি তাঁকে একলা পাগল’ হিসাবে অনেকদিন মনে রাখবো। মনে রাখতেই হবে, কেননা থিয়েটার থেকে তিনি যতোটুকু পেয়েছেন তার চেয়ে অনেক বেশি এই থিয়েটারকে তিনি দিয়ে গেছেন।
জানি, আমার বিশ্বাস আছে সংস্কৃতিই একদিন না একদিন সংস্কৃতিকে বাঁচাবে। আমাদের মহাদুঃখের দিনে, দুর্লঙ্ঘ্য বাঁধাবিপত্তির মাঝখানে, মুক্তির গান প্রাণে সাহস দিয়েছিল। আর সেই শুভ সংকল্প নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে দুর্বার হয়ে উঠেছিল আমার অগ্রজ। তখন কোনো অপসংস্কৃতির কথা ওঠেনি।
সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিল। স্বাধীনতা ও স্বাধীনতার উত্তরপর্বে এগিয়ে যাবার ব্যাপারটা যখন আমার অগ্রজদের অবধারিত, তখনই অবক্ষয়ের পথ ধরে আজকের আকাশ সংস্কৃতি কিম্বা অপসংস্কৃতি কথাটা উঠছে বারংবার। আমাদের অনেক দুঃখের দিন ছিল। আমাদের স্মৃতিতে আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে, অনেক আগুন জ্বালাবার দিন ছিল পথে প্রান্তরে। মুক্তির সংগ্রামের ভেতর দিয়ে সে দিন আমরা পরিশুদ্ধ হয়েছিলাম। কিন্তু আত্মাহুতির সেই ‘মুক্তির গান’র ভেতর অনেকটাই ছিল উচ্ছ্বাস, অনেকটাই আত্মপ্রবঞ্চণা, যে-কারণে আবাহনেই ছায়াপাত হয়েছিল বিসর্জনের। সবটাই ঘোলাটে, সবটাই অস্পষ্ট— কুহেলী সকাল। এমন কি অপরাহ্নের সেই লাল আকাশ। জানি সংস্কৃতির বিকৃতিতেই অপসংস্কৃতি। সংস্কৃতির সংকট হলে আমাদের প্রাণনীতি স্তব্ধ হয়ে যায়, এমন কি আমাদের সমাজনীতি, রাজনীতি— সব কিছুই বিপন্ন হয়। কোন নীতিরই এমন কোন মৌল উপাদান নেই যে সংস্কৃতিকে রক্ষা করে- করবে। সংস্কৃতিই সংস্কৃতির রক্ষক, ধারক ও বাহক। যদিও ইতিমধ্যের সংকট এমনও কিছু প্রচ্ছন্ন নয়। তবুও মন ও মনন যদি দৈবাৎ উদরস্থ হয়ে থাকে, তবে খড়কুটোর সংসারে ধুলোবালির বার্তাই তাকে আবার সমহিমায় অধিষ্ঠিত করবে। তাই না?
আমরা যারা থিয়েটার করি আমরা সবাই বুকে হাত দিয়ে বলবো- কিছু পাওয়ার আশায় আমরা আশান্বিত নই। আমরা যেটুকু জানি, সেটাই দিতে ব্যস্ত। বিজন ভট্টাচার্যও ব্যতিক্রম নন তাই জনসংযোগের ব্যাপারটা একেবার তাঁর ধাতে ছিল না? তার উপর তাঁর আবেগপ্রবণতা? যেন এক অন্য কালের মানুষ?নিজের আবেগপ্রবণতায় এবং জনসংযোগের অভাবে উনি পিছিয়ে পড়লেন? ভীষণ অভিমানী মানুষ তো! যে সাহায্য তাঁকে দেওয়া হয়েছিল তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন? বলেছিলেন ‘আমি নেব না? সাহায্য কীসের এমনিই মানুষ এগিয়ে আসবে?’ হয়তো যুগটা যে তিনি পেরিয়ে গিয়েছেন, সেটা মেনে নিতে পারতেন না?
চারণ কবি বিজন ভট্টাচার্য বাস্তববাদী হয়েও স্বপ্ন দেখতে ভালোবেসেছেন? তিনি দেখেছেন এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন? তাঁর শিল্পকর্ম, ভাবনাদেশ নিয়ে কথা? গণতান্ত্রিক নাট্য আন্দোলনে বিজন ভট্টাচার্যের গৌরবদীপ্ত ভূমিকা পরিব্যাপ্ত হয়েছে জন-জীবনের চরিত্র রূপায়ণে? তাঁর নাট্যকর্মে জনচরিত্র সৃষ্টি এবং জনগণের ভাষা রূপায়ণের বৈচিত্রের দক্ষতা দেখিয়েছেন? প্রধান সমাদ্দার, পবন বৈরাগী, হরেন মাস্টার বা প্রভঞ্জন হালদার ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির? চরিত্র চিত্রণে একের সঙ্গে অন্যের মিল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর? চরিত্র সৃষ্টিতে এমন কারুকার্য দেখে অবাক হতে হয়? বিজন ভট্টাচার্য একজন নাট্যকার? শুধুই নাট্যকার হলে জন্মের শতবর্ষ পরে তাকে জানবার বা বোঝবার কৌতূহল আমাদের সকলের মধ্যে এত প্রবল হত না? তিনি একজন অভিনেতা, একজন নাট্যকার, একজন পরিচালক, একজন সঙ্গীতজ্ঞ এবং একজন দক্ষ সুরকারও ছিলেন? সর্বোপরি তিনি ছিলেন একজন দার্শনিক? যাঁর দর্শন আমাকে আলোড়িত করে। জীবনশিল্পী তিনি? নিজের সহজাত সরল বুদ্ধিমত্তা থেকেই গ্রামগঞ্জের মেলা, গান, বাজনা, কথকতা প্রভৃতি দেখে তাদের কর্ম অনুসরণ করার চেষ্টা করেছেন? মানুষের জীবনের সঙ্গে এ সবের সাদৃশ্য এবং নাটকেই মানুষের জীবন প্রতিফলিত, লক্ষ্য করেই তিনি আকৃষ্ট হয়েছেন নাটকের প্রতি? জীবন থেকে নাটকে পথ চলা তাঁর? এখানে একটা কথা জানানো আবশ্যক বিজন ভট্টাচার্য কোন দিন নাটক লিখবেন, নাট্যকার হবেন এ ভাবনা তাঁর সাংবাদিক জীবনে ছিল না? ছিল শুধু অনুসন্ধিত্সু দৃষ্টি? সেই ভাবেই তিনি লক্ষ করেছেন এক একজন মানুষের এক এক রকম ভাবগত দিক?
প্রথম থেকেই তাঁর মানুষের প্রতি বিশ্বাস ছিল অটুট? তাই নাটকের নায়ককে আবিষ্কার করতে চেয়েছিলেন আমজনতা মধ্যে? এমনকি গ্রিক নায়কের মতোই শক্তিশালী? তিনি ক্ষেতে-খামারে যাকে দেখেছেন, পদ্মার পাড়ে যাকে দেখেছেন, কলে কারখানায় যাকে দেখেছেন সেই সবের মধ্যে তিনি খুঁজেছেন নুয়ে পড়া পথ হাঁটা মানুষ? ক্ষয়ে যাওয়া, বিধ্বস্ত অত্যাচারিতদের মধ্যে প্রতিরোধকারী, প্রতিবাদী নায়ক? বিজন ভট্টাচার্য পরবর্তী জীবনে যখন সোশিও পলিটিকাল ফোকাসের মধ্যে পড়েছিলেন, তখনও সেই সব নায়কদের খুঁজে বেরিয়েছেন? তাদের খুঁজেছেন সর্বত্র, কিন্তু খুঁজে পাননি? তিনি লক্ষ্য করেছেন সেই সোশিও পলিটিকাল ফোকাসটাই ছিল স্বার্থান্বেষী চক্রের আড্ডা? তার রিং ভেদ করে সেই সমস্ত নায়ক আর উঠে আসতে পারেনি? পারেনি তাদের সরব এবং সুস্থ জীবনের সঙ্কল্প ঘোষণা করতে? আর তিনি সারা জীবন ধরে তাদেরই টেনে তোলার চেষ্টা করেছেন?
তাঁর দার্শনিক দৃষ্টিতে উদ্ভাসিত হয়েছে সেদিনের সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের এক অনিবার্য অভিশাপ, যেখানে ধুরন্ধর ধন্বন্তরীদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে শেষ পর্যন্ত গোটা দেশটাকে কী ভাবে ভাসানো হল ভেলায়। আমাদের সকল আশা ভরসার জলাঞ্জলি দিয়েছে দুঃখ নিরাশার অথৈ পাথারে? আর উথালপাতাল সেই বিশাল পরিধির তটপ্রান্তে মানবিক দৃষ্টি মেলে দেখেছেন দুখিনী জননী মা সনকাকে? শতচ্ছিন্ন বসনে অধীর আগ্রহে সেই ভাসানো ভেলার প্রতীক্ষায় অপেক্ষা করছেন? কিন্তু মান্দাসের সেই ভেলা আর ফিরে আসেনি? কি নির্মম সত্য কাহন! এই ভাবে চারণ বিজন ভট্টাচার্য চরম বাস্তববাদী হয়েও স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতেন- ভালোবেসেছেন? তিনি দেখেছেন এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন? আর তাই বলিষ্ঠ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিল্পীর দায়ভার আজ দেশের মানুষের জীবন জিজ্ঞাসা? রাজনীতিক দেখবেন এক চোখে, কেননা দু’চোখ খুলে দেখবার ব্যাপারটা তাঁর ধর্মে বারণ আছে? কিন্তু শিল্পী দেখবেন তাঁর খোলা দু’চোখে? সাধারণ মানুষের জান-এর লড়াই এর সঙ্গে প্রাণের লড়াইও তাঁকে চালিয়ে যেতে হবে?’
তিনি মনে করতেন, রাজনীতি বিবর্জিত শিল্পের কথা, অন্তত গণনাট্যের পরিপ্রেক্ষিতে ভাবা যায় না? আর এ কথাও বলতে হয়েছে তাঁকে যে, নিছক রাজনীতি প্রভাবিত কোনও শিল্পকর্মই কিন্তু শিল্পের পর্যায়ে উতরোবে না? ইমোশন ও ভাবরাজ্যে যার আনাগোনা সেখানে সব সময় লাঠিবাজি চলে না? তিনি আরও বলতেন, শিল্পীর সজ্ঞান বোধ চাই, সেই বোধের কোনও ‘শর্ট’, ‘কাট’ নেই? আসলেই এসব সাতপাঁচ ভাবতে গেলে গোলক ধাঁধায় পড়ি, এ কেমন ভাবনা যাঁর প্রতিটি পরতে পরতে দর্শন! একটা কথা না বললে নয় যে, প্রগতিশীল শিল্পকর্মে ‘টপ রোপ ওয়াকিং’-এর প্রয়োজন? আর সেই প্রয়োজনেই একজন শিল্পীকে জনসাধারণের সুখ-দুঃখের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে হয়। জড়িয়ে সেই প্রয়োজনগুলো আয়ত্ত করতে হয়? একজন অভিনেতা কিম্বা একজন রাজনৈতিক কর্মী জনসাধারণের মধ্যে থেকে তাদের পর্যবেক্ষণ করা, হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করা সকলটাই হচ্ছে তার কর্তব্য।
এক গভীর সচেতন মানসিকতা না থাকলে কোনও কিছু সৃষ্টি সম্ভব নয়? নিজেকে এক জনমুখী প্রজ্ঞার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এই ভাবে? না হলে তাঁর সমস্ত আবেগ পাগলামি, উন্মত্ততার কোনও মূল্য থাকত না? তাঁর সমস্ত শিল্পকর্মে এই আবেগ এবং আন্তরিকতা ধরা পড়েছে? বিশেষত একাঙ্কিকা গুলোর বক্তব্য এতই স্বচ্ছ এবং মানবিক যা অন্যত্র তা দুর্লভ? ‘জবানবন্দী’,’কলঙ্ক’, ‘ছায়াপথ’, ‘চুল�ী’ ‘স্বর্ণকুম্ভ’ ইত্যাদিতে অনিবার্য ভাবে উঠে এসেছে এক মর্মর পাতার বেদনা।
বিজন ভট্টাচর্যের লিখা প্রথম নাটক ‘আগুন’। ‘আগুন’-এ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যে চিরন্তন সত্য উদ্ভাসিত হয়েছে তা হলো, যে কোন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বাঁচতে হলে মিলেমিশে বাঁচতে হবে, জনগণকে সাথে নিয়ে বাঁচতে হবে, এ ছাড়া কোনও উপায় নেই? দ্বিতীয় নাটক ‘জবানবন্দী’র বৃদ্ধ পরাণ মন্ডল একদিন দুর্ভিক্ষের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে সপরিবারে শহরের রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে? কিন্তু শহরে প্রাণ বাঁচানোর মতো খাবার না পেয়ে ক্রমশ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেছে? তবু তার দু’চোখে সোনালী ধানের স্বপ্ন- পরাণ মন্ডলের সেই ঐতিহাসিক সংলাপ যা ভুলবার মতো নয়। ‘মাঠে মাঠে কত ধান, কত ধান হয়েছে… সব কেটে কেটে তুলতিছি – কত-কত… আমার সেই মরচে পড়া নাওল ক’খানা আবার শক্ত করে, শক্ত করে চেপে ধরগে মাটিতে… ফিরে যা – ফিরে যা…’
বিজন ভট্টাচার্য একজন ইতিহাস। যে ইতিহাসের আলোয় একজন মানুষ আমাদের নাট্যশিল্পকে, নাট্যাঙ্গিগকে উজ্জ্বল করেছেন? তা বলার অবকাশ রাখেনা। তবে শিল্পীর শিল্পের সাময়িক মূল্য আর চিরন্তন মূল্যের কোনও তফাৎ দেখেননি তিনি? তাঁর কাছে জীবন মূল্যের গুরুত্ব থেকেছে চিরকালীন? সেখানে রাজনীতি কিম্বা সমাজনীতির কোন ভেদাভেদ নেই? যেমন ‘নবান্ন’ নাটকের শেষে যে মানবপ্রীতি তথা জীবননীতির জাগরণ ঘটেছে তা বলার ভাষা থাকেনা। তাই বিজন ভট্টাচার্যের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলাতে সাহাস করি, বলি- আবার যদি মন্বন্তর আসে, আপদ আসে তখন চাই ‘জোর প্রতিরোধ’? সত্যি কথা বলতে কি, এ এক আত্মবোধের জাগরণ? এখানে তাঁর শিল্পী সত্তা, জীর্ণ বস্ত্র শীর্ণকায় মানুষগুলোর সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে। আমরা মানবতা বোধ প্রকাশের যোগ্যতম দর্শনের ক্ষেত্র খুঁজে পাই।
‘জীয়নকন্যা’ নাটকে শুরু হয়েছে এস্থেটিকস্ ভাবনা দিয়ে? ১৯৪৫-এর প্রেক্ষাপটে ‘ক্যালাস দেশনেতা ও ক্যালাস সরকারের’ বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ? তথাপি এই নাটকে প্রত্যক্ষ ভাবে কোনও রাজনীতির কথা আসেনি? এসেছে বেদেকন্যা উলুপীকে সর্পদংশনের মাধ্যমে সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি বিনষ্টির বাতাবরণ? গণপতি, রঘুপতি বদরআলি তার সহচর সহচরীদের যৌথ প্রচেষ্টায় উলুপীর বিষমুক্তি হয়? উলুপী হলো আমাদের দেশমাতৃকার প্রতীক, সর্প হল প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি আর সাপের বিষ সা¤প্রদায়িক হালহকিকত? ইংরেজের ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ পলিসির জন্যই তো এই সমস্যা? তার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার মন্ত্র সমগ্র হিন্দু মুসলমানের একত্রীকরণ ও একই বৃন্তে দুই কুসুমের উপলব্ধি সঞ্জাত হয়েছে? নতুন গরিমায় উঠে দাঁড়িয়েছে উলুপী, সেই গৌরবদীন্ত পটভূমির সামনে আমার বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে।
ঠিক এই ভাবে পরবর্তী সমস্ত নাট্যকর্মে বিজন ভট্টাচার্যের দার্শনিক মননের পরিচয় পরিস্ফুট হয়েছে? মাঝে মাঝে আমার মনে হয় বিজন ভট্টাচার্য যেন এক অখন্ড চৈতন্যসত্তা, যেটা মুখ্যত বস্তুসত্তাকে আশ্রয় করেই গড়ে উঠেছে যার সীমানা প্রাচীর? তাঁর ‘হাঁসখালির হাঁস’, ‘গর্ভবতী জননী’, ‘চলো সাগরে’, ‘ছায়াপথ’ ইত্যাদিতে যে বিচ্ছিন্নতা প্রতিভাত হয়, এই বিচ্ছিন্নতার বিষয়েও তিনি সচেতন ছিলেন? তাই বিচ্ছিন্নতা নিয়ে তাঁর কথনের মধ্যে উঠে আসে বেদপুরাণ উপনিষদের কথা? যেমন-’ন্যায়ামাত্মা প্রবচনেন লভ্যো…,ন মেধয়া ন বহু ন শ্রীতেন?’ এই কথাটির ভাবার্থ দাঁড়ায়; মানুষ সম্বন্ধে তাঁর যে আত্মবোধ বহু বেদাধ্যয়নের দ্বারা সম্ভব হয়নি? মেধা অর্থাৎ ইন্টেলেক্ট-এর দ্বারাও তা জ্ঞেয় নয়? যে সাধক সেই শুধু আত্মার আত্মীয় হতে বাসনা করেন? তাই হয়তো বিজন ভট্টাচার্য সেই আত্মাকে আত্মবোধের মধ্যে সমাহিত করতে পেরেছেন? এটা ক’জন মানুষের দ্বারা সম্ভব তাই আজ আমাদের ভাববার বিষয়। যেমন ‘গোত্রান্তর’ নাটকের ছিন্নমূল সেই শিক্ষকের উক্তি। আমার মনে হয় এই বুঝি বিজন ভট্টাচার্যের নিজস্ব মনন থেকে উঠে আসা নির্মম সত্য। সেই কথামৃত ভুলবার নয়- যাহা অমৃত নয়, তাহা বর্জনান্তে, যাহা অমৃত তাহাই গ্রহণের সচেতন জীবনচর্যা?