বিচারের রায় কার্যকর করার দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে

16

গতকাল শোক ও শ্রদ্ধায় পালিত হয়েছে জেলহত্যা দিবস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ৩ মাস পর সেই খুনি দোসর দ্বারা পরিচালিত সেনাবাহিনীর কয়েকজন বিপদগামী সদস্য ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ঢুকে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম চার নেতার উপর যে নৃশংস হত্যাকাÐ ঘটিয়েছিল, সভ্য দুনিয়ায় এ ধরনের ঘটনার নজির নেই। সেদিন নিষ্ঠুর হত্যাকান্ডের শিকার হন মুক্তিযুদ্ধকালীন অস্থায়ী সরকারের অন্যতম প্রধান নেতৃত্ব জাতীয় চার নেতা-সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামান। বঙ্গবন্ধুর দৈহিক অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান ছিল অমূল্য। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন তারা।
বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের প্রতিবাদমুখর এ চার জাতীয় নেতা কুখ্যাত খন্দকার মোস্তাক ও তার লালিত ঘাতক বাহিনীর ইচ্ছায় গঠিত মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে রাজি হননি। এটা আজ স্পষ্ট, এ কারণেই বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক আহমেদের শাসনামলে তাদের গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় এবং একপর্যায়ে তাদের হত্যার জন্য সেখানে পাঠানো হয় ঘাতকদের। কারারক্ষীরা বাধা দিলে খোদ মোশতাকের পক্ষ থেকে নির্দেশ আসে ঘাতকদের কাজে সহায়তা করার জন্য। তারা ভেতরে গিয়ে বেছে বেছে চার নেতাকে একত্র করে এবং গুলি চালিয়ে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।
বলার অবকাশ নেই যে, এ হত্যাকান্ড একটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডেরই ধারাবাহিকতা। ১৫ আগস্টের খুনিচক্রই জেলহত্যাকান্ড ঘটায়। তারা খবর পেয়েছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীরই একটি অংশ পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। এ অবস্থায় কিছুটা জিঘাংসা থেকেও ঘাতকরা জেলহত্যার ঘটনা ঘটায় বলে ধারণা। এমনও মনে করা হয়, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক শক্তিকে নিঃশেষ করার হীন পরিকল্পনা ছিল, তার পুনরুত্থানে নেতৃত্বদানে সক্ষম নেতাদের শেষ করে দেয়াই ছিল উদ্দেশ্য। জেলহত্যার মতো ঘটনা ঘটিয়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ঘাতকরা বিদেশে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় বিমানবন্দর দিয়ে।
কীভাবে সেটা সম্ভব হয়েছিল, তা আজও এক রহস্য। জানা যায়, জেলহত্যার ঘটনা তদন্তে একটি বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠিত হলেও সেটি স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারেনি। সংশ্লিষ্ট থানায় একটি মামলাও দায়ের হয়েছিল। এর সবকিছুই কার্যত বাতিল বা বন্ধ হয়ে যায় একই বছরের ৭ নভেম্বর আরেকটি সেনা অভ্যুত্থানের ওপর ভর করে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর। তিনি বঙ্গবন্ধু ও চার নেতা হত্যার ঘটনার তদন্ত ও বিচারের কোনো উদ্যোগ নেননি বরং এ সময় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করা হয়। চার নেতা হত্যার বিচারে কোনো আইনগত বাধা না থাকলেও সে প্রক্রিয়াও বন্ধ ছিল দীর্ঘ ২১ বছর। দুর্ভাগ্যজনক বলতে হবে, বিরুদ্ধপক্ষের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন থাকাটাই ছিল এর কারণ। এটা ছিল আইনের শাসনের এক চরম লঙ্ঘন। জেলহত্যার বিচারের যে প্রক্রিয়া আমরা লক্ষ করেছি, তাও হতাশাব্যঞ্জক বলা চলে। এ মামলায় যথাযথ তদন্ত হয়নি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট অনেকে। ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর নিম্ন আদালত এ মামলার রায়ে তিনজনকে মৃত্যুদন্ড ও ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডাদেশ দিলেও ২০০৮ সালের ২৮ আগস্ট হাইকোর্টের রায়ে মৃত্যুদন্ডাদেশপ্রাপ্ত দুই পলাতক আসামিকে বেকসুর খালাস এবং যাবজ্জীবন কারাদন্ডাদেশ পাওয়া চারজনকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
আসামিদের খালাস করে দেয়া হাইকোর্টের দেয়া রায় বাতিল এবং বিচারিক আদালতের দেয়া সাজা বহাল রাখার আর্জি জানিয়ে সুপ্রিমকোর্টে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। এ পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ ২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল দুই আসামির মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে রায় দেন। তবে এ দুই আসামি দেশের বাইরে পলাতক রয়েছেন। তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে দন্ডাদেশ কার্যকর করা প্রয়োজন। জেলহত্যার বিচার ও রায় কার্যকর করার ভেতর দিয়ে ইতিহাসের আরেক কলঙ্ক থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হবে। আমরা মনে করি, দেশে আইনের শাসন নিশ্চিত করতেও এ মামলার আসামিদের দন্ড কার্যকর করার কোনো বিকল্প নেই। ইতিহাসের এই কলঙ্কমোচনের দায় শুধু সরকারই নয়, পুরো জাতিকেই নিতে হবে।