বিখ্যাতদের সত্য ঘটনা

153

শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক কে তো আমরা সবাই চিনি। তিনি হচ্ছেন আমাদের বাংলার বাঘ। রয়েল বেঙ্গল টাইগার। তিনি লন্ডন থেকে ডিগ্রি পাওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের গাউন পরে বৃটিশ শাসিত ভারত পার্লামেন্টে গিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের গাউন গুলো দেখতে ছিল প্রায় বোরকার মতো। এক শিখ তরুণ সংসদ সদস্য সবার সামনে শেরে বাংলাকে লজ্জায় ফেলার জন্য বললেন “আমরা ভেবেছিলাম ভাবী সাহেবাই বুঝি এসেছেন। আমাদের বাংলার বাঘও কম যায় না।” তিনিও মুচকি হেসে উচিত জবাব দিয়ে বললেন -“আপনাদের হতাশ করেছি বলে আামি দুঃখিত। আসলে আমার স্ত্রী কিছুতেই হিজড়াদের সামনে আসতে চাইলেন না”।
মা-বাবার টাকা চুরি করে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছেলে শিল্পী মূর্তজা বশীর পালিয়ে গিয়েছিলেন বাড়ী থেকে। কিন্তু বাইরে ক’দিন থাকার পরেই বাড়ির জন্য মন কেমন করতে লাগলো। ফিরে এলেন বাড়িতে। এসেই পড়লেন বাবা শহীদুল্লাহ সাহেবের সামনে। মূর্তজা বশীর তো ভয়ে অস্থির। এই বুঝি বকা শুনতে হয়। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় গিয়েছিলে? বশীর ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলেন “লক্ষেèৗ”। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ধীর গলায় উত্তর দিলেন, আরেকটু এগিয়ে আগ্রার তাজমহল টা দেখে এলেই পারতে।
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু একবার কয়েকজন বন্ধুসহ কলকাতার এক নামী হোটেলে খেতে গিয়েছিলেন। খাবারের সঙ্গে হোটেল বয় সবার জন্য একটি করে পরিস্কার ন্যাপকিন ও নিয়ে এলো। খাওয়া দাওয়া শেষে তারা বিলের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। হোটেল বয় বিল নিয়ে এলে দেখা গেলো, খাবারের বিলের সঙ্গে সেখানে ন্যাপকিনের বিলও যোগ করা হয়েছে। তিনি হোটেল বয়কে ডেকে বললেন, আমি ইউরোপের অনেক দামী হোটেলে খেয়েছি, কিন্তু কোথাও ন্যাপকিনের বিল করতে দেখিনি। এছাড়া আমরা কেউ ন্যাপকিনটি ব্যবহারও করি নি। সেক্ষেত্রে আমরা ন্যাপকিনের বিল পরিশোধ করবো কেনো? কিন্তু স্যার, আমাদের এ হোটেলে আমরা ন্যাপকিনের জন্য বিল করে থাকি। সুভাষ চন্দ্র বসু তখন রসিকতা করে বললেন বিল যেহেতু দিতেই হবে, তাহলে এর ব্যবহার টাও হোক, বলেই তিনি টেবিলের ওপর পা’ তুলে ন্যাপকিন দিয়ে তাঁর জুতো জোড়া পরিস্কার করে নিলেন।
অধ্যক্ষ বিদ্যাসাগর ঘুরছেন কলেজের বারান্দা দিয়ে। হঠাৎ দেখলেন, এক অধ্যাপকের টেবিলে বেত। ছাত্রদের মারা অদৌ পছন্দ করতেন না তিনি। ঢুকে পড়লেন ক্লাসে। বেত কেনো? জিজ্ঞাসা করলেন অধ্যক্ষ ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর। অধ্যাপক বললেন, ম্যাপ দেখাই স্যার। উত্তরের ভঙ্গিতে হেসে ফেললেন বিদ্যাসাগর। বললেন রথ দেখান ক্ষতি নেই, কলা বেচবেন না।
তখন ছাত্রাবস্তা। রাঁধতে হয় ঈশ্বর চন্দ্রকে। পরিবেশন করে খেতে শুরু করে দেখেন, ভাতের মধ্যে এক মস্ত তেলাপোকা। ফেললে সকলের খাওয়া নষ্ট হবে। ঈশ্বর চন্দ্র ভাতের মধ্যে দলা করে গিলে ফেললেন তেলাপোকা। সকলের খাওয়াও বাঁচলো।
রবীন্দ্রনাথ এক গ্রামে গেলেন বেড়াতে। আপ্যায়নের মহা আয়োজন। খাওয়ার দাওয়াত পড়লো এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। বহু আইটেম দিয়ে গৃহস্বামী খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। কবি বসলেন খেতে, সঙ্গে আছেন ক্ষিতি মোহন সেন শাস্ত্রী। গৃহস্বামী নিজে পরিবেশন করছেন, শাস্ত্রী মশাই ডিম খেতে গিয়েই বুঝলেন ডিমটা পচা, কী করবেন আড় চোখে দেখছিলেন কবি কী করেন। কবি ও ডিম পচা বলে বুঝলেন। বুঝে তিনি ডিমটা ভাতের সঙ্গে মুখে দিয়ে দিলেন। শাস্ত্রী মশাই পড়লেন মহা বিপদে, পচা ডিম খাবেন কী করে ? ওদিকে গুরুদেব খেয়ে ফেলেছেন। তিনি আর না খেয়ে থাকেন কী করে। অগত্যা এই পচা ডিমটাই তাকে গিলতে হলো। কিন্তু পেটটা বুঝলো না তা! সে পচাটা এক মূহর্ত সহ্য করলো না, শাস্ত্রী মশাই সঙ্গে সঙ্গেই করলেন বমি। পরে সুযোগ পেয়ে কবিকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এই পচা ডিমটা হজম করলেন কী করে? আমিতো খেয়েই বমি। রবীন্দ্রনাথ হেসে বললেন, পচা ডিম তো খেলে কেনো? আমি তো খাইনি তাই বমিও করিনি। শাস্ত্রী মশাই অবাক হয়ে বললেন সে কী কথা, আমি স্বচক্ষে দেখলুম ডিমটা আপনি মুখে দিলেন। কবি বললেন, আমিও কি সেই ডিম খেয়েছি নাকি ? আমি আমার দাড়ির ভেতর দিয়ে সেই ডিম চাপ কানের মধ্যে চালান করে দিয়েছি। এখন মানে মানে বাড়ী ফিরতে পারলেই বাঁচি।
পাড়ার রাম ভাদুড়ী বয়স্ক রসিক। এক বিয়ে বাড়ী থেকে ফিরে আসবার পর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কি গো রজনীকান্ত, বিয়েতে গিয়ে কি দিলে, কি খেলে, পেলেই বা কি ? কবি রজনীকান্ত সেন একটু হেসে উত্তর দিলেন- দিলাম দৌড়, খেলাম আছাড়, পেলাম ব্যাথা।
কবি রজনী কান্ত সেনের স্ত্রী তাঁর শ্বাশুড়ীকে মা’বলে ডাকতে চাইতেন না, এ নিয়ে মায়ের মনে বড় দুঃখ। কিন্তু জোড় করে কাউকে দিয়ে কোন কাজ করতে চাইতেন না রজনীকান্ত। অতএব তিনি কৌশল করলেন। সেবার ছুটিতে মা এবং স্ত্রীকে নিয়ে রজনীকান্ত চলেছেন রাজশাহীতে। হঠাৎ নৌকা কাত হয়ে গেলো, রজনী কান্ত সেন পড়ে গেলেন নৌকা থেকে। মাঝিরা হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো গেলো গোলো। দু’জন মাঝি ঝাঁপিয়ে পড়লো জলে। বৌমা মা, মা, করে শ্বাশুড়ীকে জড়িয়ে ধরলেন। সঙ্গে সঙ্গে নৌকার পানি থেকে রজনী কান্তের মাথা ভেসে উঠলো। তিনি বললেন এই তো মুখে দিব্যি মা ডাক ফুটেছে। এবার থেকে এই ডাকই চলবে তো। তখন বোঝা গেলো সবটাই অভিনয়। মাঝিরাও যোগ দিয়েছিলেন অভিনয়ে। বৌ এর মাথা হে’ঠ। তখন শ্বাশুড়ী তাকে বুকে জড়িয়ে সান্তনা দেন।
সাহিত্যিক বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপোধ্যায়কে ও চাকরীর জন্য পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। সেটা ছিল ডেপুটি, ম্যাজিষ্ট্রেটের চাকরী। চাকরী পাওয়ার আগে তাঁকে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ইংরেজ সাহেবদের কাছে পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। বাংলা ভাষায় শব্দের বুৎপত্তির ওপর। সাহেবদের একজন তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপদ ও বিপদের মধ্যে পাথক্য কী ? বঙ্কিম চন্দ্র ঝটপট উত্তর দিলেন আজ পরীক্ষা দিতে আসার সময় দামোদর নদীতে নৌকায় ভীষণ ঝড় হয়েছিল যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটতো তবে তা বিপদ। আর আমি একজন বাঙালি হয়েও ইংরেজদের কাছে বাংলা শব্দের বুৎপত্তি নিয়ে পরীক্ষা দিতে হচ্ছে এটা হচ্ছে আপদ। বলাই বাহুল্য ইংরেজ সাহেবরা তাঁর এই উত্তর শুনে কিছুক্ষণ ‘থ’ মেরে ছিলেন। অবশ্য সেদিন তাঁর চাকরীটা হয়েছিল। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ভারতে বাঙালিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট। ”
মফস্বল শহরে ডাক বিভাগ পরিদর্শনের কাজে দীনবন্ধু মিত্রকে হরদম ঘুরতে হতো। একবার কাজ সেরে স্টেশনে এসে গাড়ী ফেল করলেন তিনি। কি করবেন? স্থির করলেন স্টেশনের ডাক বিভাগে বিশ্রাম করা যাক। এই ভেবে এসে ঢুকলেন তার ডাক ঘরে। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশতঃ যে বাবুটি ডিউটিতে ছিলেন তিনি দীববন্ধুকে চিনতেন না। তিনি হঠাৎ এক ব্যক্তিকে ঢুকতে দেখে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন কি চাই? অনুমতি না নিয়ে এখানে ঢুকলে কেনো? দীনবন্ধু মিত্র বললেন- এখানে ঢুকতে কারো অনুমতি লাগে না। কী- বললে ? তেড়ে উঠলেন কেরানীটি। ছুটে কাছে এলেন। বললেন নিকালো, নিকালো হিঁয়াসে। দীনবন্ধু হাসলেন। হাসতে হাসতে গিয়ে বসে পড়লেন বাবুটির ছেড়ে আসা চেয়ারে। বসে বললেন, বাপু হে, মেজাজ ঠান্ডা করো। আমার নাম শুনলে তখন তোয়াজ করতে ক‚ল পাবেনা। এমন কথা শুনলে কার না রাগ হয়। কেরানী টি আরও জ্বলে উঠে চাপরাশিকে বললে নিকাল দেও বাবুকো। দীনবন্ধু মিত্র বললেন- “বাপু হে, ওর কন্মো নয়। তোমার মতো বাপে তাড়ানো মায় খেদানো ছেলেরাই আমাদের ডাক বিভাগের দুর্নাম করছে। আমি মানুষটা কে জানো? আমি নাট্যকার দীন বন্ধু মিত্র। কেরানীটির চোখ কপালে সে ঝপ করে পায়ে পড়লো। বললো আপনি ইন্সপেক্টর বাবু? তা’ আগে নামটা বললেন না কেনো? দীনবন্ধু মিত্রের মায়া হলো- তিনি বললেন নাও পা’ছাড়ো। আমার জন্য তামাক সেজে আনো। দেখো কল্কে ভাল করে ফুঁ দিয়ে ধরিও।
মহাত্মা গান্ধীজি জীবনের কিছু সময় কাটিয়েছেন ট্রেনে চড়ে। সমগ্র ভারত বর্ষ ঘুরে। বিলেত থেকে ফিরে পুরো দেশটা ঘুরে দেখার জন্য ট্রেন বেছে নিয়েছিলেন। একবার ট্রেনে ওঠার সময় তাঁর পায়ের একটা স্যান্ডেল রেল লাইনে পড়ে যায়। ততক্ষণে ট্রেনও ছেড়ে দিয়েছে। গান্ধীজি তখন তাঁর পায়ের স্যান্ডেলটিও খুলে ছুড়ে ফেলেন দিলেন। তাঁর এই কাজে ট্রেনের অন্য যাত্রীরা কিছুটা হতবাক। সবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন “যে গরীব লোকটা ওটা কুড়িয়ে পাবে সে একটা স্যান্ডেল কোনো কাজে লাগাতে পারবে না। জোাড়া স্যান্ডেল একসাথে পাওয়াতে এখন সে ব্যবহার করতে পারবে।”
ঢাকায় এসেছেন মাইকেল মধূসুদন দত্ত। ঢাকার যুবকরা সভা করে অভিনন্দন দেন তাকে। একজন বললেন, আপনার বিদ্যা, বুদ্ধি ক্ষমতা সবই আমাদের গৌরাবন্বিত করে, কিন্তু আপনি সাহেব হয়েছেন শুনে আমরা দুঃখিত হই। তবে আপনার সঙ্গে ব্যবহারে আমাদের সে ভ্রম দূর হলো। উত্তর দিতে উঠলেন মধূসুদন দত্ত। বললেন আমি সাহেব হয়েছি এমন ভ্রম হওয়া অন্যায়। আমার সাহেব হওয়ার বিধাতাই বাদ বেধে রেখেছেন। আমার এই কৃষ্ণবর্ণ। আমার ঘরে আমি আয়না টাঙ্গিয়ে রেখেছি। যখনই আমার মনের সাহেব হওয়ার ইচ্ছে হয়, তখনই আমি আয়নার সামনে এসে দাঁড়াই। আর সবচেয়ে বড় কথা আমি শুধু বাঙালি নই- আমি বাঙাল, আমার বাড়ি যশোরে।
বার্নডশ’র বাড়িতে বেড়াতে এসে এক মহিলা অবাক হয়ে বললেন মিস্টার’শ আপনার ঘরে দেখছি একটাও ফুলদানি নেই। আমি ভেবেছিলাম আপনি এত বড় একজন লেখক, আপনি নিশ্চই ফুল ভালবাসেন, তাই আপনার বাসায় ফুলদানিতে বাগানের তাজা সুন্দর ফুল শোভাপাবে। প্রত্যুত্তরে ‘শ’ সঙ্গে সঙ্গেই বললেন- “ম্যাডাম আমি বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের কেও ভালোবাসি, তার অর্থ এই নয় যে, আমি তাদের মাথা কেটে নিয়ে এসে ঘরে সাজিয়ে রাখবো।”