বাড়ছে অগ্নি-দুর্ঘটনা

34

করোনা ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি আর সিটি নির্বাচনের ডামাডোলের মধ্যেই নগরী ও জেলায় অনেকটা নিয়মিতভাবেই যেন অগ্নি-দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও অগ্নিকান্ডে ক্ষয়ক্ষতির খবর মিলছে। কেবল চলতি মার্চ মাসের গত ২০ দিনেই নগরী ও জেলায় এক ডজনেরও বেশি অগ্নি-দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে দু’জনের প্রাণহানিসহ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের সম্পদহানি হয়েছে। অগ্নি-দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে সচেতনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠছে না বলে বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, অসাবধানতাই অগ্নিকান্ডের প্রধান কারণ। আমরা অভ্যাসগত কারণেই অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি তৈরি করে রাখি। এছাড়া, ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিধিমালা অনুসরণ করা হয় না। যে কারণে অগ্নিকান্ড সংঘটিত হলেও তা নির্বাপণে ফায়ার কর্মীদের বেগ পেতে হয়। ফায়ার সনদ নিলেও নির্দেশনা অনুসরণে অভ্যস্ত হচ্ছে না। একইভাবে অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম সংরক্ষণ করলেও প্রয়োজনীয় মুহূর্তে তা ব্যবহার করা হয় না। ভবন নির্মাণে ত্রূটি থাকায় কোনো কোনো সময় প্রাণহানি বেশি ঘটে। বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ও ভবনের ভেতরে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাও ত্রূটিমুক্ত নয়। খরচ কমাতে ভবনে নিম্নমানের বিদ্যুৎ সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়। আবার একবার স্থাপন করার পর অকেজোঁ না হওয়া পর্যন্ত আর বদলানোর অভ্যাস নেই। যে কারণে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট অগ্নিকান্ডের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে পাওয়া যায়। অপরদিকে, নগরে নির্বিচারে জলাশয় ভরাটের কারণে পানির উৎস কমে যাওয়ায় অগ্নি নির্বাপণে পানি সংকটে ভুগতে হয়।
তিনি বলেন, অগ্নিকান্ড প্রতিরোধ করা প্রতিকারের চেয়ে উত্তম। একটু সচেতন হলেই আমরা এড়িয়ে যেতে পাড়ি মারাত্মক এসব দুর্ঘটনা। কারখানায় পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপক সরঞ্জাম রাখা, ফায়ার ডোর ব্যবহার করা, বৈদ্যুতিক লাইন নিয়মিত পরীক্ষা করা, প্রতিবছর নিয়মিত ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের মাধ্যমে অগ্নি নির্বাপন যন্ত্র পরীক্ষা করিয়ে রাখা এবং ছোট অবস্থাতেই আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে বড় ক্ষতি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব।
ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান ও পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, চলতি মাসের একেবারে শুরুতেই গত পয়লা মার্চ দিবাগত রাতে হালিশহরের বড়পোল এলাকায় একটি ব্যাচেলর কলোনিতে সংঘটিত অগ্নিকান্ডে কুমিল্লার চান্দিনা এলাকার মোহন (৩৫) ও চাঁদপুরের কচুয়া এলাকার জাকির হোসেন (৩৫) নামে দুই যুবক অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান। এ ঘটনায় দগ্ধ হয়েছেন কবির হোসেন নামে আরও একজন। ওই রাতে সেখানকার হাজি জহিরুল ইসলামের সেমিপাকা কলোনিতে
রাত দেড়টার দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের দু’টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। রাত আড়াইটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস। কলোনিতে বেশকিছু ব্যাচেলর বাসা ও সামনে দোকানপাট ছিল। যাতায়াতের একটি মাত্র পথটি সরু ও সংকীর্ণ হওয়ায় কলোনির প্রবেশ মুখে লাগা আগুন তারা পেরিয়ে আসতে পারেনি। ভেতরে আটকা পড়েই অগ্নিদগ্ধ হয়ে তারা মারা যান। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় তারা বের হয়ে আসতে পারেননি। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর মোহন ও জাকিরের মরদেহ উদ্ধার করে মর্গে পাঠানো হয়। আগুনে দগ্ধ কবির হোসেন নামে একজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে’।
সর্বশেষ গত ১৮ মার্চ দিবাগত রাত তিনটার দিকে নগরীর আকবরশাহ থানাধীন সিটি গেট এলাকায় অগ্নিকান্ডে অন্তত ১১টি আসবাবপত্রের দোকানসহ কারখানা পুড়ে গেছে। রাত পৌনে চারটার দিকে সিটি গেট এলাকায় আগুন লাগার খবর পেয়ে আগ্রাবাদ ও বন্দর ফায়ার স্টেশনের ১০টি অগ্নিনির্বাপক গাড়ি গিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। সেখানে ১১টি আসবাবপত্রের দোকান ও কারখানা আগুনে ভষ্মিভূত হয়। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। এতে কয়েক লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। একইদিন ভোরে কালুরঘাটের কাপ্তাই রাস্তার মাথা এলাকায় বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে সৃষ্ট আগুনে পাঁচটি দোকান ও ১২টি গুদাম পুড়ে গেছে। ভোরে আগুন লাগার খবর পেয়ে বায়েজিদ ও কালুরঘাট ফায়ার স্টেশন থেকে পাঁচটি গাড়ি ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুনে পুড়ে যাওয়া ১২টি গুদামে বিভিন্ন মালামাল মজুদ ছিল। এতে পাঁচ লক্ষাধিক টাকার ক্ষতি হয়েছে। এর একদিন আগে গত ১৭ মার্চ সন্ধ্যা সাতটায় নগরীর এমএ আজিজ স্টেডিয়াম মার্কেটের একটি রেস্টুরেন্টে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। আগুন লাগার পর খবর পেয়ে তাদের দু’টি ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ওয়ার্ল্ড কুজিন নামে ওই রেস্টুরেন্টে আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি।
অপরদিকে, জেলায়ও ঘটছে একের পর এক অগ্নিকান্ড। গত ১৩ মার্চ দিবাগত রাত একটার দিকে উপজেলার পশ্চিম শাকপুরা গোলক মুন্সিরহাট এলাকায় অগ্নিকান্ডের খবর পেয়ে বোয়ালখালী ফায়ার স্টেশনের দু’টি গাড়ি ঘটনাস্থলে যায়। প্রায় দেড় ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। বৈদ্যুতিক শট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এতে প্রায় ৩ লাখ টাকার মালামাল পুড়ে গেছে। এর আগে গত ৭ মার্চ রাত সাড়ে ১২ টার দিকে হাটহাজারীর ফতেপুর আলাওল পাড়ায় স্থানীয় ফজল করিমের ছেলে মো. রফিকের মুদি দোকানে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। মুহুর্তে আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পুড়ে ছাই হয়ে যায় রফিক ও জহিরের মুদির দোকান। এছাড়া, জেবল মুল্লুকের ছেলে মো. ইয়াকুব আলির ডেকোরেশনের গুদাম, নুরুল আলম ও সায়মনের দু’টি টিনসেড কক্ষ মো. হোসাইনের একটি প্রভোক্স ব্র্যান্ডের প্রাইভেট কার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় হোসাইনের সহোদর আবু তৈয়বের প্রাইভেটকারটিও। গত ৪ মার্চ বিকেল আনুমানিক পৌনে তিনটার দিকে সীতাকুন্ডের বাড়বকুন্ডের অনন্তপুর গ্রামের বাসিন্দা জহরলাল বড়ুয়ার ভাড়া ঘরের রান্নার চুলা থেকে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত ঘটে। মুহূর্তেই চারপাশে তা ছড়িয়ে পড়লে একে একে তাদের ২০টি ভাড়া ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। একই সময়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে পার্শ্ববর্তী আরও তিনটি বাড়িতে। সবমিলিয়ে ২৩ টি বসতঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এতে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকারসহ কয়েক লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।