বাহাদুর ভূমিমন্ত্রী নাসিরুদ্দিন চৌধুরী

127

ভূমিমন্ত্রীর বাহাদুরির তারিফ করতে হয়। তিনি যেভাবে শত শত বছর ধরে কর্ণফুলীর পাড় দখল করে বিরাজিত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে চলেছেন, তাঁতে তাঁকে চট্টগ্রামবাসীর পক্ষ থেকে একটা সাধুবাদ দেয়া অবশ্যই প্রয়োজন ছিলো। কেননা কর্ণফুলী পাড়ের অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা সহজ কথা নয়। অতীতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজন চেষ্টা করেছেন কর্ণফুলীর পাড় অবৈধ দখলমুক্ত করতে। ঢাকঢোল পিটিয়ে অভিযান শুরু করেছেন সত্য, কিন্তু কিছু কাজ করতে না করতেইু বাধার সম্মুখীন হয়ে মাঝপথে অভিযানের ইতি ঘটিয়ে মানে মানে সরে পড়েছেন। ম্যাজিস্ট্রেট মুনীর চৌধুরীর কথা এখনো সকলের মনে থাকার কথা।
তিনি উচ্ছেদ অভিযানে কিঞ্চিৎ সাফল্যও অর্জন করেছিলেন। কিন্তু তারপর যা’ ঘটলো তার জন্য তিনি বোধ হয় প্রস্তুত ছিলেন না। ভূমিদস্যুরা কত শক্তিশালী হতে পারে এবং তাদের শিকড় কত গভীরে প্রোথিত থাকতে পারে, তা’ মুনীর চৌধুরীর দুরধিগম্য ছিলো। তারা তাদের অর্থ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে মুনীর চৌধুরীকেই চট্টগ্রাম থেকে বদলি করে দিলেন। এরপর বন্দরের উচ্ছেদ কার্যক্রমের যে সেখানেই ইতি ঘটেছিলো, সেটা বোধ করি না বললেও চলে।
অতএব, আমি যে বলেছি বন্দরে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা সহজ কাজ নয়, মুনীর চৌধুরীর উদাহরণ থেকে তা’ সপ্রমাণিত হলো।
বন্দর পাড় দখলমুক্ত করা মূলত বন্দরেরই কাজ। কারণ সম্পত্তিতো বন্দরেরই। পরলোকগত ইঞ্জিনিয়ার মাহমুদ উল ইসলাম একবার একটা হিসাব কষে আমাকে বুঝিয়েছিলেন যে, নদীর জলভাগ থেকে স্থলভাগের কত ভাগ পর্যন্ত এলাকা পোর্ট লিমিটের অন্তর্গত; কিন্তু হিসাবটা আমি ভুলে গেছি। তবে বন্দর পাড়ে যে স্থাপনাগুলি দৃশ্যমান, সেগুলি যে পোর্ট পেরিফেরির মধ্যেই রয়েছে, তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বন্দর এমন এক প্রজাবৎসল জমিদার যে, তার বিশাল জমিদারির কে কোথায় খেয়ে ফেলছে, সেটা না দেখলেও জমিদারি শান শওকতের সঙ্গে নির্বাহ হয়।
কেউ যা পারেনি, সেটা ভূমিমন্ত্রী জনাব সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ পারলেন, সেজন্য আমি তাঁকে ‘বাহাদুর’ বললাম। তাঁর বাহাদুরির প্রমাণ চট্টগ্রামবাসী তথা দেশবাসী আগেই পেয়েছিলেন। তিনি যখন চিটাগাং চেম্বারের সভাপতি ছিলেন, তখন মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন চৌধুরী সে সময় ব্যবসায়ীদের পানের দোকানদার, জুতার দোকানী ইত্যাদি তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে মন্তব্য করলে ব্যবসায়ীদের নেতা হিসেবে চেম্বার সভাপতি জাভেদ সাহেব যোগ্য প্রত্যুত্তর দিতে এগিয়ে আসেন। তিনি জোর গলায় মেয়রের বক্তব্যের প্রতিবাদ করেন। সমগ্র চট্টগ্রামের ছোট-বড় সমস্ত ব্যবসায়ীকে সংগঠিত করে মানববন্ধন, প্রতিবাদ সভা, বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করে তুমুল প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তোলেন।
ব্যবসায়ীদেরও যে নেতা বা অভিভাবক আছে এবং নেতার নির্দেশে তারাও যে প্রতিবাদমুখর হতে পারেন, সেবার চট্টগ্রামে তার প্রমাণ পাওয়া গেল।
মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে পাল্লা দেয়া সোজা কথা নয়। মহিউদ্দিন চৌধুরী অনেক শক্ত ধাতুতে গড়া মানুষ ছিলেন। সরকারও তাঁকে সমীহ করত। এমনকি আমেরিকা সরকারকে পর্যন্ত তিনি নাকানি-চুবানি খাইয়ে দিয়েছেন। সেই মহিউদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে জাভেদ সাহেবকে লড়াইয়ে নামতে দেখে তাঁর মঙ্গল আকাক্সক্ষায় অনেকে আঁতকে উঠেছিলেন। কারণ মহিউদ্দিন চৌধুরী অনেক পোড়খাওয়া, সংগ্রামী মানুষ, সে তুলনায় জাভেদ সাহেব ভদ্র-নরম মানুষ, তিনি কী টিকে থাকতে পারবেন লড়াইয়ে ? কিন্তু না, বাস্তবে দেখা গেল জাভেদ সাহেব ওপরে নরম হলেও ভিতরে বেশ শক্তপোক্ত। তিনিও সমান দক্ষ। অতএব সেয়ানে সেয়ানে লড়াইয়ে ‘‘কেহ কারে নাহি জিনে সমানে সমানে।”
জনাব সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ শিল্পপতি, রাজনীতিক, সাংসদ, মুক্তিযোদ্ধা-ব্যবসায়ী নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরীর জ্যেষ্ঠপুত্র এটা সর্বজনপরিজ্ঞাত। নেতৃত্বের গুণ তাঁর চরিত্রের মধ্যে নিহিত ছিলো, উত্তরাধিকার সূত্রে তা’ তিনি লাভ করেছিলেন। সাহসের উৎসও তাঁর পরিবার। তাঁর পরিবারের একজন সদস্য তাঁর চাচা বশরুজ্জামান চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সূচনাতেই পাকিস্তানি কমান্ডোদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। তাঁর জেঠা বশরুজ্জামান চৌধুরী এবং পিতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ভয়-ভীতি তুচ্ছ করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে যোগ দেন, যা’ শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে পর্যবসিত হয় এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।
শেখ হাসিনার গত মেয়াদে ভ‚মি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে নিয়োজিত হওয়ার পরও জাভেদ সাহেব উদাহরণসৃষ্টিকারী নতুন নতুন নানা কর্মপন্থা গ্রহণ করে আলোচনায় এসেছিলেন। তিনিই সম্ভবত একমাত্র মন্ত্রী যিনি সরকারি বাড়িতে ছিলেন না এবং বেতন-ভাতাও নেননি। এবারও তিনি সরকারি বাড়িতে থাকবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন এবং বেতন-ভাতাও নেবেন না। মন্ত্রিসভায় জাভেদ সাহেবের মতো বিত্তবান আরো অনেকে আছেন; এমনকি তাঁর চেয়ে বেশি ধনী ব্যক্তিও আছেন। কিন্তু তাঁরা কেউ এমন ঘোষণা দেননি।
শুধু সরকারি বাড়িতে না থাকা বা বেতন-ভাতা না নেয়া নয়, গত মেয়াদে জাভেদ সাহেব বিভিন্ন ভ‚মি অফিসে গিয়ে ঘুষ আদান-প্রদানের ঘটনা হাতেনাতে ধরে ফেলেন। শুধু তাই নয়, তিনি সেখানে অবস্থান করে অফিসের কাজকর্মও প্রত্যক্ষ করেন।
ভ‚মি প্রতিমন্ত্রী পদে তাঁর কার্যক্রমে সন্তুষ্ট হয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাইফুজ্জামান চৌধুরীকে পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রী পদে নিয়োগ দান করেছেন। এই পদোন্নতি নিঃসন্দেহে তাঁর সততা, দক্ষতা ও কর্তব্যনিষ্ঠার পুরস্কার। এবার মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ লাভের পর জনাব সাইফুজ্জামান যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যার একদিকে রয়েছে নদীর অবৈধ দখল উচ্ছেদ। অন্যদিকে জমির নামজারি পদ্ধতি সহজীকরণের উদ্যোগ। গ্রাহকদের হয়রানি কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সেবার সময়ও কমিয়ে আনছেন।
যে পরিবর্তন তিনি আনছেন, তাতে সাতচল্লিশ দিনের পরিবর্তে আটাশ দিনের মধ্যে নামজারি সম্পন্ন করবেন সহকারী কমিশনার ভ‚মি (এসি ল্যান্ড), দলিল নিবন্ধনের সঙ্গে জমির নামজারি ফি জমা দেয়া হবে। একই সঙ্গে দলিল গ্রহীতা দলিলের তিনটি কপি সাবরেজিস্ট্রি অফিসে জমা দেবেন। তিন কপি দলিলের এক কপি থাকবে সাবরেজিস্ট্রি অফিসে। আরেক কপি পাবেন দলিল গ্রহীতা, অপর কপিটি যাবে এসি ল্যান্ডের কাছে। এসি ল্যান্ডের কাছে পাঠানো কপির সঙ্গে ভ‚মি রেজিস্ট্রেশনের সময় নামজারি বাবদ যে টাকা জমা দেয়া হয়েছে তার রশিদ জুড়ে দেয়া হবে। একই সঙ্গে ল্যান্ড ট্রান্সফার নোটিশ (এলটি) জেলা প্রশাসকরা এসিল্যান্ডের কাছ থেকে সংগ্রহ করে তা প্রতি মাসে প্রতিবেদন আকারে ভ‚মি মন্ত্রণালয়ে পাঠাবেন। মাঠ পর্যায়ে সেবা সহজ করার জন্য এসব ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে ভ‚মি মন্ত্রণালয়।
বাবু ভাইয়ের ছেলেরা সবাই বাইরে মানুষ-তাদের লেখাপড়া, আদব-কায়দা সব বাইরে থেকে শেখা। আর সবাই ভদ্র, অসম্ভব পরিশীলিত, সফিসটিকেটেড, মার্জিত ও অভিজাত রুচির মানুষ। পিতার রাজনৈতিক জীবন তাঁরা দূর থেকে নিরীক্ষণ করেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও, রাজনৈতিক পরিমন্ডলে বড় হয়ে ওঠেও কাছে গিয়ে রাজনীতির পাঠ গ্রহণের সুযোগ তাঁরা তেমন পাননি। তবে রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য হওয়ার কারণে রাজনীতির যে আঁচ তাদের গায়ে লেগেছে, সেখান থেকেই তাঁরা রাজনীতির পাঠ নেন, দেশ ও জনসেবার ব্রত গ্রহণ করেন, স্বদেশানুরাগ জন্ম নেয় তাদের চরিত্রে। ছেলেদের হাতে তাঁর বিশাল ব্যবসায়িক সা¤্রাজ্যের দায়িত্ব ভার তুলে দিয়ে বাবু ভাই চেয়েছিলেন নিজে রাজনীতি করতে। কিন্তু দুরারোগ্য ব্যাধি তাঁর জীবনের গতি থামিয়ে দিলে জ্যেষ্ঠপুত্র জাভেদের কাঁধে পিতার রাজনীতি এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব পড়ে। যদিও বাবু ভাই চাননি পরিবারতন্ত্র, উত্তরাধিকারের রাজনীতি প্রবর্তন করতে, কিন্তু পরিস্থিতি বাধ্য করেছিলো তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রকে রাজনীতিতে প্রবৃত্ত হতে। বাবু ভাই মৃত্যুকালে সংসদ সদস্য ছিলেন, আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের সদস্য এবং দক্ষিণ তথা চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের অভিভাবকস্বরূপ ছিলেন। তাঁর অকাল ও আকস্মিক মৃত্যুতে দলের অগণিত নেতা-কর্মী ও জনগণের প্রত্যাশা জাভেদ ভাইকে রাজনীতির আবর্তে টেনে নিয়ে আসে। রাজনীতিতে এসে জাভেদ ভাই’র ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়েছে। তিনি একের পর এক পিতার শিল্প সা¤্রাজ্যকে বিস্তৃত করে চলেছিলেন, জামান গ্রুপের হৃতমর্যাদা পুনরুদ্ধার করে দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পথে যখন অগ্রসর হচ্ছিলেন, দেশের আরো বিভিন্ন খ্যাতনামা শিল্পগোষ্ঠীর উত্তরাধিকারী যাঁদের মধ্যে তাঁর বন্ধু ও সমসাময়িক রয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে তাঁর একটি অঘোষিত প্রতিযোগিতা নীরবে চলছিলো, তখনই রাজনীতিতে জড়িত হয়ে পড়ায় তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি শ্লথ হয়ে পড়ে।
অনেক ব্যবসায়ী আছেন, যারা মন্ত্রী, এমপি হতে পারলে এই পদগুলি কাজে লাগিয়ে তাঁদের ব্যবসাকে আরো উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যায়। কিন্তু সাইফুজ্জামান চৌধুরী সে ধরনের ব্যবসায়ীও নন, সে ধরনের রাজনীতিবিদও নন। তিনি একজন ব্যতিক্রমী মানুষ। রাজনীতি করে তাঁর ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়েছে বটে কিন্তু দেশ তো লাভবান হয়েছে। দেশ একজন নিবেদিতপ্রাণ ও দেশপ্রেমিক রাজনীতিককে পেয়েছে, সরকার একজন সৎ ও ত্যাগী মন্ত্রীকে পেয়েছে।
জাভেদ ভাই’র সাহসের কথা আমি বলেছি। এই সাহসই তাঁকে কিভাবে প্রথম রাজনীতিতে টেনে নিয়ে আসে সেকথা লিখছি। বাবু ভাই একটা মিথ্যা মামলার শিকার হয়ে ফেরার হয়ে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন। এ সময় তাঁর পরিবারের ওপর চরম দুর্যোগ নেমে আসে। রাজনৈতিক সহকর্মী, বিপুল নেতাকর্মী, ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত বন্ধুরা একে একে তাঁকে পরিত্যাগ করে। ভলকার্ট হাউসে অবস্থিত তাঁর বাসভবনটি এক সময় মানুষের ভিড়ে সরগরম এবং দিনরাত মানুষের আনাগোনায় মুখর থাকতো, বাবু ভাই ষড়যন্ত্রমূলক মামলার শিকার হয়ে আত্মগোপন করলে ভলকার্ট হাউস জনশূন্য হয়ে পড়ে। তবে বৈরী পরিস্থিতিতে সুখের পায়রারা পালিয়ে গেলেও তাঁর মুষ্টিমেয় ক’জন অকৃত্রিম শুভাকাক্সক্ষী, নিঃস্বার্থ ও দরদী মানুষ বাবু ভাই’র বাসায় যাতায়াত অব্যাহত রাখেন। এরা হচ্ছেন আবু ছালেহ, মোছলেম উদ্দিন আহমদ, মোখতার ভাই, সৈয়দ জামাল আহমদ, নাসিরুদ্দিন চৌধুরী (আমি), বাবু ভাইয়ের বন্ধু ও আত্মীয় আবুল হোসেন চৌধুরী, বন্ধু মুসা খান, দুই ভাগিনা আবদুল্লাহ কবির লিটন ও মোছলেহ উদ্দিন মনসুর, বাঁশখালী থানা আওয়ামী লীগ সম্পাদক খোরশেদ আলম ও যুবলীগের তৌহিদুল আনোয়ার।
বাবু ভাইয়ের পক্ষে কথা বলার জন্য কেউ নেই। এই সময় জাভেদ সাহেব শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদ নামে একটি সংগঠনের ব্যানারে তাঁর পিতার মামলা প্রত্যাহার ও মুক্তির দাবিতে তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলেন। প্রায় প্রতিদিনই তিনি পশ্চিম পটিয়া ও আনোয়ারায় সভা-মিছিল করতেন। আর আমি পূর্বকোণে সেসব নিউজ প্রকাশ করতাম। এভাবে জাভেদ ভাই’র সাহসিকতায় তাঁর পিতার মুক্তির দাবিতে তীব্র ও জনপ্রিয় আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন।


পাদটীকা : ভূমিমন্ত্রী নদীপাড়ের অবৈধ দখল উচ্ছেদের জন্য যে অভিযানে নেমেছেন, সেটি একটি কঠিন অভিযান হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে তাঁর জন্য। শুধু কর্ণফুলী নয়, বুড়িগঙ্গা ও তুরাগেও অভিযান শুরু করেছেন তিনি। খুবই ভালো এবং প্রশংসনীয় একটি কাজ, এখন কথা হচ্ছে ভালয় ভালয় অভিযান শেষ করা। কর্ণফুলীর পাড় যারা দখল করে আছে তারা খুবই শক্তিশালী মানুষ। তাদের হাত অনেক লম্বা। জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানেন না এবং ভ‚মিমন্ত্রীর জানা থাকা দরকার যে, শত শত বছর ধরে, কর্ণফুলীর পাড়ে যে বাণিজ্যিক কর্মকান্ড বিস্তৃত হয়েছে তার উদ্বৃত্ত থেকেই চট্টগ্রামে ব্যবসায়িক পুঁজির প্রাথমিক সঞ্চয়ন ঘটেছে। আদিতে চট্টগ্রাম ছিলো একটি ফিশিং ভিলেজ। মানুষ গাছের ফলমূল খেয়ে এবং পরে প্রাণী শিকার করে অনেককাল জীবনধারণ করেছে। তারপর মানুষ যখন মৎস্য শিকার শিখলেন, তখন সেই শিকার দিয়েই কিছুকাল বাঁচল। এরপর মাছ ধরার নৌকা নিয়ে দূর দূরান্তে চলে যেতে লাগলো এবং তখনই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পণ্য আনা নেয়া অর্থাৎ বাণিজ্য তাদের অধিগত হলো। এখন তাদের পেশা হলো বণিক বৃত্তি। তারপর ছোট নৌকা থেকে পাল খাটানো বড় বড় সরের জাহাজ তৈরি হলো এবং সেটাই হয়ে উঠলো চট্টগ্রামের মানুষের প্রধান জীবিকা এবং এই সময় থেকেই কর্ণফুলীর পাড়ে স্থাপনা তৈরি হতে থাকল। চট্টগ্রামের প্রাচীন সব ধনীই ছিলো সরের জাহাজের মালিক। জাহাজে কাজ করতো মালম, মুকানী, খালাসি ইত্যাদি পেশাজীবীরা। এই সময় কর্ণফুলীর পাড়ে বিভিন্ন ঘাট তৈরি হতে লাগল। তারপর লবণ ব্যবসা, তুলা, তেল ইত্যাদির ব্যবসা। কাজেই উচ্ছেদ কর্ম যতই এগিয়ে যাবে বহু বছর-বহু যুগব্যাপী প্রতিষ্ঠিত ব্যবসাসমূহের গোড়া ধরে যখন টান পড়বে, তখন অনেক প্রভাবশালী, ক্ষমতাশালীর আঁতে ঘা পড়বে। তারা নানা জায়গায় দৌড়ঝাঁপ করে অভিযান থামিয়ে দিতে চাইবেন। মন্ত্রী মহোদয় অভিযান শুরু করেছেন মাঝখানে সুজা কাঠগড় থেকে। সুজা কাঠগড়ের পূর্বদিকে কালুরঘাট পর্যন্ত নদীর পাড়ে প্রচুর স্থাপনা এবং পশ্চিম দিকে ৩নং জেটি পর্যন্ত সারি সারি স্থাপনা। কর্ণফুলীর দক্ষিণ-পূর্ব পাড়ে যখন যাবেন, আধুনিককালে নির্মিত বড় বড় স্থাপনা পাবেন। সেগুলিতে যখন হাত দেবেন, তখন তাঁকে বাধার পাহাড় ডিঙ্গাতে হবে। তাঁর আত্মীয়স্বজনের গায়েও হাত পড়বে। তখন তিনি কি করেন, মানুষ সেটাই দেখবে। মহিউদ্দিন চৌধুরী তো নদীতে জেটি তৈরি করতে দিয়েছেন।
এখন দেখা যাক, জাভেদ সাহেব ভালয় ভালয় অভিযান শেষ করতে পারেন কি না। প্রভাবশালী, ক্ষমতাশালী, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থের সঙ্গে আপস না করে তিনি যদি নিরবচ্ছিন্ন গতিতে অভিযান চালিয়ে যেতে পারেন, তখনই মানুষ তাঁকে বলবে-‘বাহাদুর মন্ত্রী’।

লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক, বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক