বাবু ভাই : দেশ ও জাতির গর্বিত সন্তান

189

আল্লাহতা’য়ালা মানবজাতির আবাসস্থল পৃথিবী সৃষ্টি করে যুগে যুগে অগুনন মানুষ পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। তাদের মধ্যে নবী-রাসূল, অলি-আউলিয়া, মহামানব, অতি মানব ও সাধারণ মানুষ আছে। কেউ আল্লাহর প্রিয় বান্দা, কেউ বা আল্লাহর প্রিয় হতে পারেনি। পৃথিবীতে আছে ভাল-মন্দ, আলো-আঁধার, দিবা-রাত্রী, অমাবস্যা-পূর্ণিমা, আছে স্বার্থপরতা, আছে মানবতাবাদী। সব মিলিয়ে প্রকৃত ভাল মানুষের জন্য এই পৃথিবী একটি পরীক্ষা কেন্দ্র। ভাল ফল-আখেরাতের মুক্তির জন্য মুমিন মানুষগুলো প্রানান্ত প্রয়াসে লিপ্ত। চট্টগ্রাম আমার কর্মস্থল, আমার আবাসস্থল ও স্থায়ী ঠিকানা। এই চট্টগ্রামেই হয়ত আল্লাহর হুকুমে একদিন চিরস্থায়ী ঠিকানায় চলে যেতে হবে। সেইদিন হয়ত কেউ খোঁজ খবর রাখবে না। আমার প্রিয় স্থান চট্টগ্রাম। এখানে চাকুরী, রাজনীতি ও সমাজনীতি সহ নানা কারণে প্রিয় চট্টগ্রামে অসংখ্য মানব-মহামানব এর সাথে সম্পর্ক, সুসম্পর্ক, ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের বন্ধন হয়েছে। তাদের নাম এখানে উল্লেখ করতে গেলে হয়ত কারো নাম আগ পিছ হলে সম্মানে ব্যাঘাত হতে পারে তাই আজকের বিষয় নিয়েই দুই একটি লাইন লিখছি তিনি শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু। পৃথিবীর ক্ষেত্রে কিছু অপূর্ণতা কখনও পূরণ হবার নয়, কিছু শূন্যতা সারাটি জীবন বয়ে চলতে হয়। গত প্রায় ৭ বছর ধরে আমরা অনুভব করছি বাবু ভাই এর শূন্যতা। ভালোবাসা, বিচক্ষণতা, পরিবার-পরিজন, দলীয়-নেতা কর্মী সকলকে আগলে রাখার মতো কাউকে আর তেমনভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। তার কাছ থেকে পাওয়া ¯েœহ-মমতা-ভালবাসা ভুলে যাওয়ার নয়। তিনি শিখিয়েছেন বিপদে-আপদে হাল ধরতে হয়।


আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু’র জন্ম মে ১৯৪৫ খ্রি. তার চিরবিদায় ৪ নভেম্বর ২০১২ খ্রি.। তিনি চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, তিনি সাবেক সংসদ সদস্য, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। তিনি গণজাগরণের অগ্রদূত, প্রথিতযশা শিল্পপতি ও দেশবরেণ্য সমাজ রূপকার ও দানবীর। তিনি অগুনন মানুষের কর্মের সংস্থান ও জীবন-জীবিকার অগ্রদূত। বর্ষীয়ান রাজনীতিক এই মহামানব চট্টগ্রাম জেলার আনোয়ারা উপজেলার হাইলধর গ্রামে তার জন্ম। বাবু ১৯৫৮ সালে পটিয়া হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পাস করেন। মেধাবী এই মানুষ ছাত্রজীবনের বহু বছর বিদেশে ছিলেন। পৃথিবী সেরা আমেরিকার ঊষড়হ টহরাবৎংরঃু থেকে তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবসায়িক বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে ১৯৬৫ সালে তার স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফিরেই বাবু মরহুম জননেতা এম এ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরীর সাথে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে ১৯৬৬ সন থেকে ৬ দফার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর ¯েœহধন্য হয় ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে আনোয়ারা পশ্চিম পটিয়ার আসন থেকে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালিন সময়ে এবং ১৯৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধকালিন সময়ে বাবু সাহেবের পাথরঘাটাস্থ জুপিটার হাউজ ছিল নিরাপদ ঠিকানা। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা করার পর তাঁর ঘোষণা সাইক্লোস্টাইল করে বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করা হয়। বাবু সাহেবের সেই জুপিটার হাউজ থেকে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তোলার লক্ষে ইউরোপ ও আমেরিকা সফর করেন। দেশ শত্রæমুক্ত হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলায় এসে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নেয়ার পর দেশে সংবিধান রচনা করেন। দেশে প্রণীত প্রথম সংবিধানে বাবু সাহেবের স্বাক্ষর রয়েছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতার নির্মম হত্যাকাÐ ও জাতীয় চারনেতা জেলখানায় বন্দি অবস্থায় জীবন হারানোর পর বাংলাদেশে নেমে আসে নিষ্ঠুর-নির্মম নির্যাতন। আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর অনুসারী মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিনাশী খড়গ যখন তীব্র থেকে তীব্রভাবে আঘাত হানা শুরু হয় সেই দুঃসময় ও দুর্দিনে বাবু মোস্তাক ও জিয়ার নির্যাতনকে বাজি রেখে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আওয়ামী লীগকে পুনঃগঠনে সাহসী ও বলিস্ট ভূমিকা পালন করেন। লোভ-প্রলোভন, রাষ্ট্র ক্ষমতায় আরোহন সহ নানামুক্তি স্বার্থসংশ্লিষ্ট অফার পদ-দলিত করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সততা ও নিষ্ঠার সাথে ধারণ করে একজন নির্ভীক যোদ্ধার মত দল সংগঠিত করেন। তিনি নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে ছিলেন অটুট। নীতিতে চুল পরিমাণ ছাড় জীবনে কাউকে দেননি। ১৯৭৭ এ আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তার কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আবু ছালেহ (তিনি আজো জীবিত আছেন)। ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে আনোয়ারা পশ্চিম পটিয়া সংসদীয় আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি তার জীবনে এই আসন থেকে ৫ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এছাড়া বাবু তার হাইলধর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৮০ ও ১৯৯০ দশকে স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলনের বলিষ্ঠ নেতা বাবু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নির্বাসিত দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পাশে ছিলেন। তাদের প্রবাস জীবন, কারা জীবন ও দল সুসংগঠিত করার পেছনে আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ছিলেন অনুপ্রেরণার বাতিঘর। বাবু জেল-জুলুম, হুলিয়া, নির্যাতন, ভয়-ভীতি সবকিছু জয় করে জুলুম-নির্যাতনকে হাসিমুখে বরণ করে সামনে যাওয়া ছাড়া পেছনে যাওয়ার লোক তিনি ছিলেন না। রাজপথ, পিচঢালা উত্তপ্ত রাস্তায় বসে প্রশাসনের নির্যাতনের প্রতিবাদী এ নেতা জীবনের প্রতিক্ষেত্রে ছিলেন সফল মানুষ। ষড়যন্ত্র ও নিন্দুকের প্রতিহিংসাতে তিনি থাকতেন অচল-অবিচল ও সুদৃঢ়। ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও তিনি সফল ব্যবসায়ী। রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসাতে তার সফলতা অনুকরণ ও অনুসরণীয়। বাবু বেসরকারি ব্যাংকিং সেক্টরের অন্যতম পথিকৃৎ।
জনাব আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ১৯৮৯ সালে ৭৭ জাতি চেম্বার অব কমার্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে বাংলাদেশের জন্য বিরল সম্মান বয়ে আনেন। বিরল প্রতিভার এই সফল মানুষটি পৃথিবীর বহুদেশ ভ্রমণ করেছেন। বহু দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন। তাঁর হৃদয় ছিল উদার, তিনি ছিলেন গরিব ও কর্মীবান্ধব এক মহৎ হৃদয়ের মানুষ। আমার জীবনের নানা প্রতিকূলকতার মাঝে মাত্র কয়েকবার তার সান্নিধ্য পেয়েছি। সভা-সমাবেশ-হরতাল-ধর্মঘটে তাঁর সাথে কথাবলা সভায় বক্তব্য দেয়ার অনেক স্মৃতি আমার, আমার পারিবারিক সামাজিক জীবনেও বাবু সাহেবের মহানুভবতা ছিল। সেই সব স্মৃতিগুলো এ নিবন্ধে লেখার সম্ভব হচ্ছে না। মানবদরদী অকৃত্রিম ভালোবাসার এই মানুষটি আজীবন, চট্টগ্রামের উন্নয়ন, বঙ্গবন্ধু ও তাঁর আদর্শ এবং জননেত্রী শেখ হাসিনার মঙ্গল কামনায় সময় পার করে গেছেন। তিনি দল, মত, ধর্ম, বর্ণ সম্প্রদায় নির্বিশেষে একজন চট্টল দরদি। তিনি দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শের দুর্জয় সৈনিক। জননেত্রী শেখ হাসিনার একজন অতি বিশ্বস্থ সহযোগী হিসেবে আসুন বর্তমান আগামী প্রজন্ম উজ্জ্বল লক্ষত্র এই মানুষটিকে আমাদের হৃদয়ের গহীনে চির জাগরুক রাখি।
লেখক : সাধারণ সম্পাদক
বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতা স্মৃতি পরিষদ