বাবা বাসায় নেই

56

ওরা দুই ভাইবোন। রতন আর তনু। তনু বড় রতন ছোট। রতন পড়ে তৃতীয় শ্রেণিতে আর তনু সপ্তম। দুজনই পড়ালেখায় মনোযোগী। ওদের লেখাপড়া নিয়ে মা-বাবা বেশ সন্তুষ্ট। কারণ ওরা পড়ার সময় পড়া, খেলায় সময় খেলে থাকে। আর স্কুলে যাওয়ার সময় হলে ঝটপট রেডি হয়ে যায়। এ পর্যন্ত একদিনও ওদের বলতে হয়নি স্কুলের সময় হয়েছে। তাড়াতাড়ি রেডি হও।
ওদের একজন প্রিয় মামা আছে। ছোট মামা। উনার নাম নোবেল। একজন বিজ্ঞানীর নামের দ্বিতীয়াংশ দিয়ে ছোট মামার নাম— নোবেল আহমেদ। সেই নোবেল মামাও ওদের পড়ালেখায় বেশ উৎসাহ দেন। বলেন, পড়বে মনোযোগ দিয়ে। মনে রাখবে সবাই পড়ে পেটের জন্যে। কিন্তু তোমরা পড়বে মানুষ হওয়ার জন্যে। আর এজন্যে শুধু স্কুলের বই পড়লে হবে না। পড়তে হবে রকম রকম বই। আর এই রকম রকম বই কোথায় পাওয়া যায় জানো?
লাইব্রেরিতে। তনু বলল।
না। ঠিক হয়নি উত্তর। তোমরা লালদিঘির মেলায় গিয়েছিলে না!
হ্যাঁ।
ওখানে নিশ্চয় দেখছ, হাতপাখা থেকে ঘটিবাটি, মাটির পাতিল থেকে শীতলপাটি, দা খুন্তি থেকে মড়িমুড়কি, তালপাতার বাঁশি থেকে চনামনার ঠ্যাং।
দেখেছি মামা।
ঠিক তেমনি রকম রকম বই পাওয়া যায় বইমেলায়। এই বলে ছোট মামা সেদিন ওদের বইমেলায় নিয়ে যায়। মামা ওদের পছন্দমতো বেশ কিছু বই কিনে দেন। রতনকে মামা একটা বাল্যশিক্ষাও কিনে দেন।
কী মামা! এই বইটা কেন? রতন কি ক্লাস ওয়ানে পড়ে? বাল্যশিক্ষা বইটি দেখিয়ে জানতে চাইল তনু।
মামা ওদের দুজনের পিঠ আলতো করে চাপড়ে দিয়ে বলেন, এই বই তোমরা পড়নি। কারণ এই বই এখন স্কুলে পাঠ্য নেই।
সেদিন ছিল শুক্রবার। প্রতিদিনের মতো সকাল সকাল পড়তে বসে রতন। বাংলা স্যারের পাঠ পড়তে গিয়ে ওর মনে পড়ে বাল্যশিক্ষা বইটির কথা। সে ছোট বইটির এক একটি পাতা উল্টাতে থাকে। একটি পাতায় গিয়ে ওর চোখ থির হয়। পড়তে থাকে রতন, প্রথমে নিরবে, তারপর শব্দ করে—
সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি
সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি
আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে,
আমি যেন সেই কাজ করি ভাল মনে।
……………………………………..
ভাল ছেলেদের সাথে মিশে করি খেলা,
পাঠের সময় যেন নাহি করি হেলা।
সুখি যেন নাহি হই আর কারো দুখে,
মিছে কথা কভু যেন নাহি আসে মুখে।
শেষের লাইনটা বেশ কয়েকবার পড়ল রতন। এ সময় একটা রিং টোন কানে বাজে রতনের। রিং টোনে একটা কানের কলি বাজতে থাকে, ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা’। মোবাইলটা বাবার। বাবা মোবাইলটা রিসিভ করে বলেন, মোবারক সাহেব, আমি এখন বাসায় নেই। আপনি না হয় আর একদিন আসেন।
এই কথা শুনে অবাক হলো রতন। বাবা বাসায় অথচ বললেন বাসায় নেই। এ কেমন কথা! বুকের ভেতর বুদবুদ উঠতে থাকে ওর। কিছুক্ষণ ভেবে রতন ওর স্কুলের পড়ায় মন দেয়। এভাবে কেটে যায় ঘণ্টা খানেক।
আবার বেজে ওঠে বাবার মোবাইল। বাজছে আর বাজছে। কেউ ধরছে না। বাবা বোধ হয় বাথরুমে। মা কিচেনে। বড় আপু যে কোথায় আছে বুঝতে পারল না।
তৃতীয়বার রিং টোন বেজে ওঠে। এবার রতন ভাবল, হয়তো কারও জরুরি ফোন হবে। তাই সে দেরি না করে ফোনটা রিসিভ করল। ওপার থেকে লোকটি নিখিলেশ বলে জানাল। রতন ভাবল, বাবা বাসায় নেই বলাটাই ঠিক হবে। কারণ সকালে তিনি তাইতো বললেন।
রতন তাই করল। বাবা বাথরুম থেকে বের হতে জিজ্ঞেস করল, কার ফোন রে রতন!
নিখিলেশ বাবুর। বলল রতন।
তুম কি বললে?
বললাম বাবা বাসায় নেই।
কী বললে!
আপনি বাসায় নেই।
তুমি এটা বলতে গেলে কেন?
আপনি যে সকালে বললেন। তাই।
আমি সকালে যাকে বলেছি লোকটা আমার কাছে টাকা পাওনা। আর এখন যে লোকটা ফোন করেছে উনার কাছে আমি অনেক টাকা পাওনা আছি।
রতন বলল, কোন ফোনে টাকা আসে তাতো আমি জানি না বাবা!
ওর কানে তখনও অনুরণিত হচ্ছিল মিছে কথা কভু যেন নাহি আসে মুখে।
রতনের বাবা বুঝতে পারলেন মিছে কথা বলার ফল এমনই হয়।