বাবা নেই

288

জীবনের সব রঙ, সুখ-শান্তি, হাসি-আনন্দ কেড়ে নিতে পারে একটি মৃত্যু, বাবার মৃত্যু। চারদিকে শুধু শূন্যতা, হাহাকার, কষ্ট আর অনিঃশেষ যন্ত্রণা। বাবার রেখে যাওয়া স্মৃতিগুলো আকাশের অগণিত তারকারাজির মতোই প্রতিরাতে জ্বলছে। স্মৃতির শতসহ¯্র পাতা থেকে কয়েকটি কথা কাগজের পাতায় এনে সারাক্ষণ স্মরণে থাকা বাবার কথা কিছু সময়ের জন্য ভুলে থাকার চেষ্টা করছি। জানি, পাথরচাপা ভারী বুকটা হালকা হবে না; তবুও একটু সান্ত¦না, একটু মানসিক স্বস্তি। ইচ্ছায় ও অনিচ্ছায় বাবার সাথে কত কথা, কত খেয়ালিপনা, আবার কখনো কত অভিমান; সেই মুহূর্তগুলোই শুধু স্মৃতিপটে ভাসছে। ২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে আমি মানসিকভাবে অসুস্থ ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অধীনে আমার চিকিৎসা চলছিল। সে সময় একবার আমি আর বাবা শহর থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। তখনো আমি পুরোপুরি সুস্থ হইনি। বাসের সিটে চেপে বসলাম। বললাম, আমড়াগোটা খাবো। বাবা কিনে দিলো। কেটে বিট লবণ দেওয়া ওই আমড়ার শুধু এক ফালি খেয়ে বাকিটা ফেলে দিলাম। বাবা চেয়ে রইলো, কিছু বললো না। আবার বললাম, বাদাম খাবো। দশ টাকার বাদাম কিনে দিলো। কয়েকটা বাদাম খেয়ে বাকিগুলো বাবাকে দিয়ে দিলাম। বাবা সেগুলো থলেতে রেখে দিলো। গাড়ি ছেড়ে দিবেÑ ঠিক সেই মুহূর্তে বললাম, পপকর্ন খাবো। তা-ও কিনে দিলো। তারপর কোনো কথা নেই, চুপচাপ। গাড়িতে বাবার পরিচিত এক লোক আমার কথা জিজ্ঞেস করলেন। বাবা বলল, আমার ছেলেটা মানসিকভাবে একটু অসুস্থ, দোয়া করবেন। শুনেই লোকটা দীর্ঘক্ষণ আমার দিকে চেয়ে রইলেন। ‘পায়ে সুন্দর জুতো, পরনে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি, মুখে কুঁচকে দাড়ি; এত পরিপাটি একটা ছেলে মানসিক রোগী’! লোকটা চিন্তা করলেন, ভাবলেন। বাবার ইচ্ছা, আমি যেন লোকটাকে সালাম দিই এবং তাঁর সাথে কথা বলি। আমি ওই লোকটার সাথে কথা বলিনি। এতে বাবার মনে যে একটু কষ্ট লেগেছিল তা আমি ঠিকই বুঝতে পেরেছি। কোনো সময় বাবা আমাকে নাম ধরে ডাকতো না। ডাকতো ‘আব্বু’ বলে। ফোনে কথা হলে বলতো ‘আব্বু’, তুমি কেমন আছ? ‘আব্বু’ ডাকটা যেনো শুধু আমার জন্যই নির্দিষ্ট। এজন্যে ছোট ভাইবোনরা আমাকে হিংসে করতো।
পরিবার, প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনের অনেক কথা মা আমাকে বলতো না। মা প্রায় সময় বাবাকে বলতো ‘এ কথা সে কথা’ বলে ছেলেটাকে শুধুশুধু টেনশন দেওয়ার দরকার নেই। পরে কোনো রাখঢাক না রেখেই বাবা আমাকে সব বলে দিত। জীবনপাতার নানা পাঁচমিশালী খবর বাবার কাছ থেকে জেনে নিতাম। বাবা নেই বলে সে খবরগুলো এখন আর আসে না।
পিতা-পুত্রের সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতোই। পরম বন্ধু, বিশ্বস্ত বন্ধু। যখন যা খেয়ালে আসতো, সবই শেয়ার করতাম। পারিবারিক ও সামাজিক বিষয়াদির পাশাপাশি সমসাময়িক ঘটনাসহ নানা প্রসঙ্গে কথা হতো বাবার সাথে। বেশি পড়ালেখা না থাকলেও চলমান বিশ্ব ও বাংলাদেশ সম্পর্কে বাবা ছিল সচেতন। প্রতিদিন দৈনিক খবরের কাগজে চোখ রাখতো। ‘পূর্বদেশ’ ছিল বাবার প্রিয় দৈনিক। প্রতিদিন বাজারে গিয়ে হকারের অপেক্ষায় থাকতো এবং ‘পূর্বদেশ’ পত্রিকা কিনে আনতো। এতে মা বিরক্ত হয়ে বলতো যে, এ কাগজগুলো না কিনলে হয় না! বাবা ছিল ফুটবলপ্রিয় এবং ব্রাজিলের সমর্থক। খেলাধুলা, বিশেষ করে ফুটবলের নানা খবর আমি বাবাকে বলতাম। ফ্যানদের সাথে আড্ডায়, বিতর্কে এগিয়ে থাকতে টেস্ট ও ওয়ানডে ক্রিকেটে শচিন টেন্ডুলকারসহ লিজেন্ড ক্রিকেটারদের নানা তথ্যও বাবাকে জানিয়ে মুখস্থ রাখতাম। যদিও ক্রিকেট সম্পর্কে বাবা তেমন কিছু বুঝতো না।
আমার দাদু আমার বাবার নাম রেখেছিল ‘আবদুল হাফেজ’ । ‘আবদুল হাফেজ’ নাম রাখারও একটা কারণ আছে। দাদুর ইচ্ছা ছিল, বড় হলে বাবাকে ‘কোরানে হাফেজ’ বানাবে। দাদুর সেই ইচ্ছা পূরণ হয়নি। পড়ালেখায় কোনো সনদ না থাকায় বাবা নির্দিষ্ট কোনো কাজের গÐিতে আবদ্ধ থাকতে পারেনি। কৃষিকাজ, চাকুরী, লবণের ব্যবসাসহ নানা বিচিত্র পেশায় কেটেছে বাবার কর্মজীবন।
আজ আমার বাবা নেই। ‘বটবৃক্ষ’ নেই। মাথার উপর কোনো ছায়া নেই। বাবা তো ওপারে, না ফেরার দেশে। সবই আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছা। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি। ‘আল্লাহ, তুমি আমার বাবাকে মাফ করে দাও। আমাদেরও ক্ষমা করে দাও। যে বাবা নিজে না খেয়ে আমাদেরকে খাইয়েছে, নিজে না পরে আমাদের পরিয়েছে; আল্লাহ, তুমি বাবাকে খাওয়াও, পরাও’। সন্তানের প্রতি ¯েœহ-মমতা আর ভালোবাসায় জীবনোৎসর্গ করে বাবা আমাদের দয়া করেছে; ‘আল্লাহ, তুমিও বাবাকে দয়া করো’। ফরিয়াদ শুধু এতটুকু, বাবা যেন সুখে থাকে ওপারে, জান্নাতে।
লেখক : সহকারী সম্পাদক, মাসিক জীবনবাতি