বাতাসে নতুন বিপদের ঝুঁকি বাড়ছেই

110

সাম্প্রতিক সময়ে পত্রপত্রিকার পাতা উল্টালেই দেখা যায় চীন, ভারত, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশের বাতাসে ভারী ধাতু সনাক্ত হওয়ার সংবাদ। চীন, ভারতের অনেক বিদ্যালয় এ কারণে ছুটি ঘোষণা করে। বাংলাদেশে এ ধরনের নজীর না থাকলেও ধূলিকণা ও ভারী ধাতুর অবস্থান কিন্তু কম নয়। সম্প্রতি এক জরিপে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া জানায়, ২০১৭ সালে ভারতে বায়ু দূষণের কারণে ১২ লাখ ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশ্বব্যাপী পরিচিত পরিবেশ বিষয়ক জার্নাল, ‘ল্যানচেট প্ল্যানেটারী হেলথ জার্নাল’ এই জরিপটি প্রকাশ করে। জরিপটি পরিচালনা করেন ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানি ও শিক্ষাবিদরা। জরিপ অনুযায়ী দূষিত বাতাসে মৃত্যুর শিকার মানুষের ৫১ শতাংশের বয়স ৭০ বছরের নিচে। জরিপে আরও বলা হয় বাড়ির বাহিরে বায়ুদূষণের কারণে নয়া দিল্লির মানুষের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে। রাজধানী দিল্লির বাতাসে পিএম-২ নামে দূষিত ধূলিকণার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি বলেও জানানো হয়েছে ঐ জরিপ গবেষণায়। প্রতিবেশি দেশের রাজধানীর এই চিত্র আমাদের রাজধানী ঢাকা বা চট্টগ্রামে চিত্র কি, তা আমাদের জানতে হবে। বায়ুদূষণ ও শব্দ দূষণে ঢাকা এবং চট্টগ্রামের আকাশ-বাতাস ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। বিশাল এ শহরগুলোতে নেই স্বস্তি। বস্তিবাসী থেকে উচ্চবিত্ত কেউ রক্ষা পাচ্ছেন না শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ, রোগী, ছাত্রছাত্রী, পথচারী চাকুরিজীবী, ক্ষুদ্রব্যবসায়ী কারো রক্ষা নেই। সবাই আক্রান্ত, অসুস্থ এবং অস্বস্তিকর যন্ত্রণায় দিন কাটাচ্ছেন।
একটি ঘটনার কথা বলি। আমার পরিচিত এক মহিলা যিনি চট্টগ্রামে বাস করেন। তাঁর বাসায় গেলে দেখা যায় বাড়ির দরজা জানালা ইঞ্চি দু’য়েক খোলা। তিনি প্রায়শ দরজা জানালা বন্ধ করে রাখেন। কৌতুহল বশতঃ জানতে চাইলাম, তিনি জানালেন, দরজা জানালা খোলা রাখলে ঘরের মেঝে, আসবাবত্রে সাদা ধূলির স্তর জমে যায়। সারা শহরে যে পরিমাণ নির্মাণ কার্যাদি হচ্ছে তাতে করে এগুলো খোলা রাখা যাচ্ছে না। সর্বোপরি ধূলিবালির কারণে শ্বাসকষ্ট ও কাশির প্রকোপ বেড়ে যায়। বন্ধ রাখলে শারীরিকভাবে সুস্থ থাকি। আসবাবপত্র ও জামা কাপড় খাবার-দাবার ধূলিকণা থেকে বাঁচে। এ হলো একজন সচেতন মহিলার বর্ণনা। কিন্তু যাদের এ সুযোগ নেই কিংবা কাজে কর্মে দিনের একটা বড় অংশ বাইরে কাটান তাদের অবস্থা কী হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। বর্তমানে ঢাকা চট্টগ্রামের মতো বড় শহর শুধু নয়, দেশের প্রায় সব শহর ও গঞ্জের বাতাসে ধূলিকণা ও ভারী বস্তু ভাসছে। যে কারণে শিশু বৃদ্ধসহ মানুষের সর্দিকাশি ও শ্বাসকষ্টের সমস্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এ শুধু ঢাকা, কলকাতা, দিল্লি, সাংহাই, চট্টগ্রামের চিত্র নয়, বলা যায় দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সামগ্রীক চিত্র। খবরে প্রকাশ থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংকককে তীব্র বায়ু দূষণের ৪৩৭টি স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির কথা বিবেচনায় এনে থাই সরকার এ সিদ্ধান্ত নেয়। বাতাসে দূষণ ২ দশমিক পিএম। ব্যাংককের এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (এ কিউ আই) এখন ১৭০ এর কাছাকাছি। ফলে বাতাস অস্বাস্থ্যকর হয়ে পড়েছে। তারা এ জন্য দায়ী করছে যানজট অবাধ নির্মাণ কাজ, শষ্য ও আবর্জনা পোড়ানো এবং কলকারখানার দূষণকে। কর্তৃপক্ষ কৃত্রিম বৃষ্টিপাত, যানবাহন কমানো, রাস্তাঘাট পানি দিয়ে ভেজানো বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়। কিন্তু বাতাসকে দূষণমুক্ত করার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে বলে কর্তৃপক্ষ।
চলতি সপ্তাহে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বাংলাদেশের জন্য ২০১৯ সালের ১০টি স্বাস্থ্য ঝুঁকি চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে প্রথম ঝুঁকি হলো বায়ু দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন। গত বছর সংস্থাটির হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা হলো তৃতীয় নম্বরের। তবে ঢাকার দূষণে এবার আর এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। তা হলো অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ কাজ, তীব্র যানজট, মেয়াদোত্তীর্ণ মোটর যান ও শিল্পকারখানা থেকে নিগর্ত বিষাক্ত ভারী ধাতু ধুলার সঙ্গে বাতাসে যোগ হচ্ছে। ঘরের বাইরে তো বটেই, বাড়িঘর, অফিস আদালত, শিল্প প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষ ও খেলার মাঠে ভর করছে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা। ফলে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে নগরবাসী, বিশেষ করে শিশুরা। শ্বাসকষ্ট থেকে শুরুর শরীরে বাসা বাঁধছে ক্যান্সারসহ নানা রোগ বালাই। ঢাকার সড়ক ও ঘরের ভেতর বায়ু দূষণ বিষয়ে দু’টি গবেষণা প্রতিবেদনে এ ঝুঁকির তথ্য উঠে আসে। গবেষণা দু’টি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সামকিী সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভারমেন্ট এবং এনভায়রমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড পলুশন রিচার্জ। সরকারি সংস্থা পরমাণু শক্তিকেন্দ্র ও যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণা দু’টি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ।
উক্ত গবেষণায় ঢাকার রাস্তায় ধূলায় সর্বোচ্চ মাত্রায় সিসা, ক্যাডমিয়ান, দস্তা, ক্রোমিয়ান, নিকেল, আসেনিক, ম্যাঙ্গানিজ ও কপারের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মাটিতে যে মাত্রায় ক্যাডমিয়ান থাকার কথা, ধূলায় তার চেয়ে ২০০ গুণ বেশি পাওয়া গেছে। আর নিকেল ও সিসার মাত্রা দ্বিগুণের বেশি। দেশের বিভিন্ন স্থানে মাটি ও পানিতে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকের ঝুঁকি আগে থেকেই ছিল। এবার ঢাকার রাস্তার ধূলার মধ্যে নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিক শনাক্ত করেছে গবেষক দল। এসব ভারি ধাতু কণার আকার এতটাই সুক্ষ যে, তা মানুষের চলের চেয়েও ২৫ থেকে ১০০ গুনের বেশি ছোট আকারের। যার কারণে খুব সহজেই এই সব সূক্ষ ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা ত্বকের সংস্পর্শে আসে। ফলে শ্বাস প্রশ্বাস, খাদ্য ও পানীয়ের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে।
দীর্ঘ সময় ধরে গবেষণায় নিযুক্ত গবেষকরা বলছেন, ভারি ধাতু মিশ্রিত অতি সুক্ষ ধূলিকণা আগের তুলনায় বাতাসে অনেক বেড়েছে। ঢাকায় ভারি ধাতুর (মেটাল) উপস্থিতি উন্নত দেশের শহরগুলোর চেয়ে অনেক গুণ বেশি। তবে দিল্লি, লাহোর তুলনয় তা এখনো কিছুটা কম আছে। সব চেয়ে বড় বিপদের দিক হলো এগুলো স্বাভাবিক ধূলা নয়। শীত মওসুমে বৃষ্টি না হওয়ায় এসব সূক্ষ বস্তুকণা বাতাসে ভাসতে থাকে, যা অক্ষত অবস্থায় মানবদেহে শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমেও প্রবেশ করে বড় ধরনের ক্ষতি করে থাকে।
গবেষণায় বলা হয়, ঢাকাসহ দেশের শহরাঞ্চলের উল্লেখযোগ্য পরিমাণের ব্যাটারি চালিত যানবাহন চলাচল করে থাকে। এসব যানবাহনে নিকেল ও ক্যাডমিয়ানের ব্যাটারি ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া শহরগুলোর বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে কারখানা। এসব কারখানায় সংকর ধাতু ও ধাতব প্লেট তৈরি এবং এনামেল, প্লাস্টিক ও গ্লাস রঙের কাজে ক্যাডমিয়ান ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আবার পাঁচটি আবাসিক এলোকায় যে গবেষণা হয়, তার ভবনগুলো ছিল এক থেকে ২৪ বছর পুরানো। একতলা থেকে ছয়তলার এসব ভবনের ভেতরের বায়ুতে ক্ষতিকর সূক্ষ বস্তকণার (পিএম ১, পিএম-২, পিএম-৫ ও পিএম-১০) ঘনত্ব বিশ্ব স্বাস্থ্য নির্ধারিত নিরাপদ মাত্রার চেয়ে বেশি ছিল। এতে দেখা গেছে, ক্ষতিকর বস্তুকণা শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে ঘরের বাসিন্দাদের শরীরে ঢুকে পড়েছে। যা ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে। যাকে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি হিসাবে গবেষণায় চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়া এসব ভবনের সব তলায় দূষণের উৎস হিসাবে বলা হয়, বাইরের দূর্ষিত বায়তুর ৪২ শতাংশ ঘরে চলে আসে। একই সঙ্গে ঘরের মধ্যে ময়লা আবর্জনা, ডিটারজেন্ট, রান্না ও টয়লেট থেকে নির্গত দূষিত পদার্থ বাতাসে মিশে যাচ্ছে। গবেষণায় বাসা বাড়িতে সবচেয়ে বেশি সূক্ষ বস্তুকণা পাওয়া গেছে।
চিকিৎসা গবেষকগণ জানান যে, বাতাসে ভারি ধাতু ও সূক্ষ বস্তুকণা বেড়ে গেলে ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, স্নায়ুজনিত সমস্যা বেড়ে যায়, বুদ্ধমত্তা কমে যায়। পাঁচ বছর ধরে এ ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ৫০ শতাংশ বেড়েছে। এটা উদ্বেগজনক।
এসব দূষণে ব্যক্তিগত, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি জড়িত।
দেশ এখন উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে। চারিদেিক ভবন ও সড়ক নির্মাণকাজ চলছে। মেট্রো রেল, উড়াল সড়ক ইত্যাদিও নির্মিত হচ্ছে দেদারছে। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ নগর এলাকায় পরিচ্ছন্নতা ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা:দেশের পরিবেশগত বিশ্লেষণ-২০১৮ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে দূষণে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। ২০১৫ সালেই নগর এলাকায় ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয় দূষণের কারণে হয়েছে। বিশ্বে ১৬ শতাংশ মানুষেল মৃত্যু হয়েছে দূষণে। বাংলাদেশে তা ২৮ শতাংশ বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, ঢাকার বায়ুদূষণের ৫৮ শতাংশ উৎস এখনো ইটভাটা, রাস্তা ও মাটির ধূলা এবং মোটর গাড়ির দূষণ মিলে ২৬ শতাংশ। তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের হিসাবে পাঁচ বছর আগেও বায়ুদূষণণ ওই তিন খাতের অংশ ছিল মাত্র ১৫ শতাংশ।
কোন দেশে দ্রুত উন্নয়ন হতে থাকলে প্রচুর নির্মাণকাজ ও শিল্পায়ন হয়। বাংলাদেশের প্রভাব পরিবেশে পড়া খুবই স্বাভাবিক। তবে দেশের উন্নয়নের সাথে সাথে পরিবেশ সুরক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সর্বোপরী পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বেশি। জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা করা যেমন সরকারের দায়িত্ব তেমনি উন্নয়ন ও অপরিহার্য। তাই দূষণ নিয়ন্ত্রণ করে উন্নয়ন পরিকল্পনা করা উচিত।

লেখক : কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব.)