বাজেট জনকল্যাণমুখী

33

নতুন (২০১৯-২০) অর্থবছরের জন্য জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেটকে কল্যাণমূলক বাজেট বলে অভিহিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সব উদ্যোগ-কার্যক্রমই জনগণের কল্যাণের জন্য। এই বাজেট জনকল্যাণমূলক বাজেট।
গতকাল শুক্রবার (১৪ জুন) বিকেলে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন-উত্তর পর্বে তিনি এসব কথা বলেন।
প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে সমালোচনাকারীদের জবাব দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কে কী বললো, তা আমাদের দেখার বিষয় নয়। সমালোচনা করার অধিকার সবারই আছে। কেউ ভালো কথা বললে তা আমরা গ্রহণ করবো, আর কেউ ভালো কথা না বললে তা আমরা ধরবো না।
স্বাভাবিক নিয়মে বাজেট পেশ ও বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন অর্থমন্ত্রী। কিন্তু এবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অসুস্থ থাকায় তিনি সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হতে পারেননি। তার পক্ষে সংবাদ সম্মেলনে প্রস্তাবিত বাজেটের খুঁটিনাটি দিক তুলে ধরে বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সংবাদ সম্মেলনে সরকার প্রধান বলেন, এবারই প্রথম প্রস্তাবিত বাজেটে যুবকদের উদ্যোগী করে তুলতে ১০০ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। নির্বাচনি ইশতেহার অনুযায়ী আমরা ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ নামে শহরের সব সুবিধা দিয়ে গ্রাম-উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছি। শেয়ার বাজারে আমরা সুশাসন দেখতে চাই। বিকশিত পুঁজিবাজার দেখতে চাই। এ কারণেই পুঁজিবাজারকে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে।
পুঁজিবাজারে দ্বৈতকর পরিহার করা হবে। তিনি আরও বলেন, গবেষণা উন্নয়নে ৫০ কোটি টাকা অতিরিক্ত বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী জানান, প্রণোদনা বাবদ তৈরি পোশাক রফতানিতে ২ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণে ৬০দিন সাগরে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করায় দেশের ৪ লাখ ১৫ হাজার জেলেকে ৬৫ কেজি চাল দেওয়ার কর্মসূচি চলছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বর্তমানে ২১ হাজার ১৬৭ মেগাওয়াটে পৌঁছেছে।
১০ বছরেও সরকার খেলাপি ঋণের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘মিডিয়া মালিকরা কে কত টাকা ঋণ নিয়ে কত টাকা পরিশোধ করেছেন, তা আগে খুঁজে বের করুন। তার হিসাব দিতে বলুন। তিনি আরও বলেন, খবর নেবেন, পত্রিকার মালিকরা কে কোন ব্যাংক থেকে কত টাকা ঋণ নিয়েছেন। সব ব্যাংক থেকে এই তথ্য বের করুন। যত মিডিয়া আছে, প্রত্যেকে বলবেন, কোন মালিক কোন ব্যাংকের কত টাকা ঋণ নিয়ে কত টাকা শোধ দেননি। খেলাপি হয়ে নিজেরা হিসাব করলে আমাকে আর প্রশ্ন করতে হবে না।
মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের মাসিক ভাতা ১০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১২ হাজার টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের বৃত্তির পরিমাণ বাড়িয়ে প্রাথমিকে ৭৫০ টাকা, মাধ্যমিকে ৮০০ টাকা ও উচ্চশিক্ষায় ৯০০ টাকা করা হয়েছে। তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিনিয়োগ অত্যন্ত জরুরি। সারাদেশে ১০০টি ইপিজেড করা হচ্ছে। সেখানে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। পিপিপিকে (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) উৎসাহ দেওয়া হবে। এসময় কোম্পানি আইন সংশোধন করা হবে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অর্থপাচার ঠেকাতে অপ্রদর্শিত অর্থ হাউজিং ও হাইটেক পার্কে বিনিয়োগের সুযোগ দিয়েছি। আমরা মনে করেছি, এসব অপ্রদর্শিত টাকা কে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন, কে জানে? তাই বলেছি আগে বের করুক। তিনি বলেন, এতে সৎ মানুষের হতাশ হওয়ার কারণ নেই। সৎ মানুষের সাহসই থাকে আলাদা। নতুন অর্থবছরের প্রথম দিন থেকেই ভ্যাট আইন কার্যকর হবে। ভ্যাট নীতিমালাও ঠিক করা হয়েছে। ভ্যাট আইন কার্যকর করতে ইএফডি মেশিন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
দেশে প্রচুর চাল উৎপাদন হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন আমদানির প্রয়োজন নেই। তাই চাল আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতে সব ধরনের ট্যাক্স বাড়ানো হয়েছে। দেশীয় চিনি শিল্পরক্ষায় চিনির টাক্স বাড়ানো হয়েছে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী হেসে বলেন, চিনি খেলে ডায়বেটিস হয়, তাই চিনির দাম বাড়িয়ে দিয়েছি।
সরকার প্রধান বলেন, কাউকে কষ্ট না দিয়ে রাজস্ব জোগাড় করতে চাই। ২০২১ সালের মধ্যে এক কোটি করদাতা তৈরি করতে চাই। আয়-রোজগার ভালো থাকলে মানুষ কর দিতে উৎসাহী হবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, যাদের মানসিকতা অসুস্থ তাদের কিছুই ভালো লাগে না। সবকিছুতেই তারা কিন্তু খোঁজে। তারা কী গবেষণা করেন আমি জানি না। একটা কিছু বলতে হবে। তাই বলেছে। এটা একটা অসুস্থতা।
সিপিডির নাম উল্লেখ না করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাজেট নিয়ে সাধারণ মানুষ খুশি কিনা, তা দেখতে হবে। এটা আমাদের ১১তম বাজেট। যতটুকু আমি বলেছি তার থেকে অনেক বেশি কিছু রয়েছে বাজেটে। ভালো না লাগা পার্টি যারা তাদের কোনও কিছুই ভালো লাগবে না। উনাদের সেটা অসুস্থতা। ভালো সমালোচনা করলে আমরা গ্রহণ করবো আর মন্দ কথা বললে ধর্তব্যে নেবো না।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করা, উন্নত করা, সমৃদ্ধশালী করা এবং স্বাধীনতার সুফল পাওয়ার লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আগে বাইরে গেলে বাংলাদেশকে কেউ চিনতো না। এখন আমাদের সবাই চেনেন। এটাই আমাদের বড় পাওনা।
সংবাদ মাধ্যমের মালিকদের খেলাপি ঋণের খোঁজ নিতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা দয়া করে একটু খবর নেবেন, আপনাদের মিডিয়ার মালিকেরা কে কোন ব্যাংক থেকে কত টাকা ঋণ নিয়েছেন। ঋণগুলো তারা শোধ দিয়েছেন কিনা। মালিকদের ঋণের হিসাব নিলে আমাকে আর এ ব্যাপারে প্রশ্ন করার প্রয়োজন হবে না।
একজন সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন, আপনি দায়িত্ব নেওয়ার সময় খেলাপি ঋণ ২৩ হাজার কোটি টাকার মতো ছিল। সর্বশেষ মার্চ মাসে তা বেড়ে এক লাখ ১০ হাজার কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ কেন বাড়ছে?
ওই প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আপনাদের মিডিয়ার মালিকদের বলেন, ঋণ শোধ দিতে, তাহলে আর খেলাপি ঋণ থাকবে না। তিনি বলেন, মিডিয়ার মালিকদের ঋণের হিসাব নেওয়া হবে। তাদের অনুরোধ জানাবো, ঋণের টাকা শোধ দিয়ে তারপর যেন এ ব্যাপারে লেখেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের সুদের হার অত্যন্ত বেশি। এছাড়া চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ হয়। যখন হিসাব করা হয়, তখন চক্রবৃদ্ধি সুদের হারসহ হিসাব করা হয়। যার ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণটা অনেক বড় দেখায়। প্রকৃত ঋণটা যদি ধরা হয়, তাহলে দেখা যাবে অত বড় না।
সিঙ্গেল ডিজিট সুদে ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে ব্যাংকগুলোকে যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তা মেনে চলতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমরা সবসময় চেষ্টা করেছি যাতে সুদটা সিঙ্গেল ডিজিটে থাকে। এ জন্য ব্যাংকগুলোকে সুবিধাও দিয়েছি। কিন্তু অনেক বেসরকারি ব্যাংক সেটা মানেনি। এবার বাজেটে নির্দেশনা দেওয়া আছে, এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে যাওয়া হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ব্যাংকগুলোকে নিয়ম মেনে চলতে হবে। ঋণের সুদ যেন ডাবল ডিজিটে না হয়। তাহলে আমাদের বিনিয়োগ বাড়বে। বেশি আর চক্রবৃদ্ধি আকারে সুদ হতে থাকলে মানুষ আর ব্যবসা করতে পারবে না। এদিকটাতে আমরা বিশেষভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছি। অনেক আইন আমরা সংশোধন করবো; সেই ব্যবস্থা নিচ্ছি।
দেশে কর্মসংস্থান আছে বলেই ধান কাটার লোক পাওয়া যায় না বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, অনেক পত্রিকায় দেখেছি ধান কাটার লোক পাওয়া যাচ্ছে না। তারা অনেক বেশি টাকা চায়। শ্রমের যে মূল্য বেড়ে গেছে, কারণ তাদের ডিমান্ড বেড়ে গেছে। আজকে বেকার লোকের অভাব আছে বলেই তো মূল্য বেড়েছে। সেটাও একটু বিবেচনা করে দেখেন।
২০৩০ সালের মধ্যে আপনি যে ৩ কোটি মানুষকে কর্মসংস্থানের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, সেখানে এখন সরকারি ও বেসরকারিভাবে প্রতি বছর গড়ে ৭-৮ লাখ মানুষ চাকরি পায়। যদি ১১ বছর ধরি সে হিসাবে ৮৮ লাখ মানুষ হয়, এক কোটিও হয় না। তাহলে তিন কোটি মানুষের কর্মসংস্থান কীভাবে সম্ভব, এ প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কর্মসংস্থানের কথা আমরা বলেছি, চাকরি দেওয়ার কথা বলিনি। ১০০ কোটি টাকার থোক বরাদ্দ রেখেছি, শিক্ষার কথা বলেছি, প্রযুক্তি শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, ভোকেশনাল ট্রেনিং। আমরা চাই মানুষ শিক্ষিত হয়ে ট্রেনিং নিক। নিজের কাজ নিজে করার একটা সুযোগ পাক। মূলত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা এখন কিন্তু আছে। আছে বলেই ধান কাটার লোক পাওয়া যাচ্ছে না। লোক পাওয়া যাচ্ছে না কেন? যদি এত বেশি বেকার থাকে তাহলে ধান কাটলে দিনে ৪০০-৫০০ টাকা পাবে। প্লাস তিন বেলা খাবার। দুই বেলা খাবে এক বেলার খাবার বাড়ি নিয়ে যাবে। তারপরও কেন লোক পাওয়া যাচ্ছে না? এটা কি একবারও বিবেচনা করেছেন। যেহেতু কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে তাই ধান কাটার লোকের অভাব।
তিনি আরও বলেন, আমরা কর্মসংস্থানের কথা বললেই সবার ধারণা হয়ে যায় চাকরি দেওয়ার কথা। ১৬ কোটি মানুষকে কি চাকরি দেওয়া যায়? পৃথিবীর কোনও দেশ দেয়? আর কোনও মানুষ কি একটা চাকরি নিয়ে বসে থাকে সারা জীবন। মানুষ যাতে কাজ করতে পারে সেই সুযোগটা সৃষ্টি করাই কর্মসংস্থান। আমার ১০০টি অঞ্চল তৈরি করছি বা প্রতিনিয়িত প্রজেক্টগুলো করছি। একটা প্রজেক্ট সম্পন্ন হলে কত মানুষের কাজ হবে, চাকরি হবে। তারা নিজেরা সেখানে কাজ করতে পারবেন, চাকরি হবে। কাজেই আপনার ওই অঙ্ক তো ভুল। সরকারি চাকরির হিসাব করলে তো কর্মসংস্থান হলো না। আপনাকে নিজের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। যাতে নিজের কাজ নিজে করতে পারেন, পাশাপাশি অন্যের কাজেরও ব্যবস্থা হবে। সেটাই আমরা বলতে চাইছি।
সোনার বাংলা গড়ে তোলার যুদ্ধকে সোনালি যুদ্ধ বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, দেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলার জন্য যে যুদ্ধ, সেটাই সোনালি যুদ্ধ।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্শি, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন, অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার প্রমুখ।