বাজেট এবং কিছু কথা

65


এক জন উত্তম সমালোচক একজন উত্তম বন্ধু ও বটে। তবে ঐ সমালোচনা হতে হবে গঠনমূলক এবং যুক্তিতে পরিপূর্ণ। যে নারী শ্বশুরালয়ে সবার চক্ষুশুলের হেতু তার চলনই নাকি বাঁকা এমন কথা ও প্রচলন আছে। তারপরও বলবো নিন্দুকের বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো, যুগ জনমের বন্ধু আমার আঁধার ঘরের আলো। সমালোচনাকে উৎসাহিত করা গণতান্ত্রিক নৈতিক মূল্যবোধের উদার মনের পরিচয়। তরুণ সাহসী যুবক দন্ডায়মান হয়ে আমিরুল মোমেনিন হযরত ওমর বিন খাত্তাব (রা.) কে প্রশ্নবিন্ধ করলো। বন্ধ করুণ আপনার খোতবা আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। বায়তুলমাল হতে সবার জন্য একখন্ড করে কাপড় বরাদ্দ হয়েছে আপনার পরণে দু’টো নতুন কাপড় শোভা পাচ্ছে এর হেতু কি ? আমিরুল মোমেনিন দুই হাত উত্তোলন করে শোকরগুজার করে বললেন ‘ধন্যবাদ হে প্রতিবাদী তরুণ’ হে আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাকো আমার রাজ্যে আমার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মতো এমন সাহসী তরুণ ও বিদ্যমান। এবার ২ খন্ড কাপড় প্রাপ্তির ব্যাখ্যা প্রদান করে বললেন। আমি ও আমার ছেলের জন্য ২ খন্ড কাপড় বরাদ্দ হয়েছে। আমার শরীর ঢাকার জন্য ২ খন্ড কাপড় আবশ্যক। একখন্ড দিয়ে উপরের অংশের জন্য ব্যবহার করেছি। নিচের অংশের কাপড় তৈরির ব্যাপারে আমার আর্থিক সচ্ছলতা নেই তাই আমার পুত্র তার প্রাপ্ত কাপড় আমাকে দান করেছেন। তাইতো আমার পরণে নতুন ২টি কাপড় দৃশ্যমান। সাম্প্রতিকালে বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট পেশ করা হয়েছে। বাজেট হচ্ছে আয়-ব্যায়ের একটা দর্পণ। এ বাজেট নিয়ে আলোচনা ও সমালোচনার কমতি নেই। পক্ষে-বিপক্ষে মিছিল মিটিং এর আয়োজন। বাজেট নিয়ে বিরোধী পক্ষের বক্তব্য হচ্ছে এ বাজেট গরিব মারা বাজেট, সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের দালালদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বাজেট। কারো মতে ঘোষিত বাজেট পূর্বের ন্যায় শ্রমিক-কৃষক ও জনগণের স্বার্থবিরোধী কেউ বলেন এ বাজেট ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য আরো ব্যাপকহারে বৃদ্ধি করবে। কেই মন্তব্য করেন এ বাজেটের মাধ্যমে শিল্প কৃষি কর ও ভ্যাটের আওতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কেউ কেউ বলেন বাজেট বিনিয়োগ ও নতুন কর্মসংস্থান সুযোগ থেকে জাতিকে বঞ্চিত করা হয়েছে। কারো মতে জিডিপির ৯৫% খায় ৫% মানুষের ভূরিতে। গণফোরাম প্রস্তাবিত বাজেটকে প্রত্যাখ্যান করে এ বাজেটকে চটকদার বাজেট নামে আখ্যায়িত করেছেন। বিএনপির খসরু সাহেবের মতে এ বাজেট থেকে জনগণ কিছুই পাবেনা। বাজেট পেশের পূর্বে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন তিনি এবার খুব মজার বাজেট পেশ করবেন। বাজেটটা কত মজার বা কত তেতো এব্যাপারে মন্তব্য আসার আগখানে বলবো দেশে ৪৮তম বাজেটের মধ্যে এ বাজেট সর্ববৃহৎ বাজেট। যার সম্ভাব্য আকার ৫ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। স্মরণতব্য স্বাধীনতার পর এতো বড়ো আকৃতির বাজেট আর যা পূর্বতন বাজেটের চাইতে ১২.৬১% বেশি এবং সংশোধিত বাজেটের ১৮.২২% বেশি। গত বাজেটের আকার ছিলো ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। এবারের বাজেট ৫৮,৬১৭ কোটি টাকা বেশি। প্রাস্তাবিত বাজেটে জাতীয় রাজস্বা বোর্ড (ঘইজ) নিয়ন্ত্রিত কর ৩ লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা + এনবিআর বর্হিভূত কর ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা + কর ব্যতীত প্রাপ্তি ৩৭ হাজার ৭১০ কোটি টাকা অর্থাৎ সর্বমোট ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের সম্ভাব্য লক্ষমাত্রা ধরা হয়। বাজেটের আকার ৫,২৩,১৯০ কোটি টাকার হলে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা স্থির হয় ৩,৭৭,৮১০ কোটি টাকা। সুতরাং ১,৪৫,৩৮০ কোটি টাকার ঘাটতি বিদ্যমান রেখে সৃজন করা হয়েছে প্রস্তাবিত বাজেট তা আমাদের জন্য নিশ্চয় মজার কোন বিষয় নয়। গত অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিলো ৪,৬৪,৫৭৩ কোটি টাকা কিন্তু আশানুপাতে রাজস্বা প্রাপ্তি না হওয়াতে পরিকল্পনানুযায়ী অর্থব্যয় সম্ভব না হওয়ায় সংশোধিত বাজেট গিয়ে দাঁড়ায় ৪,৪২,৫৪১ কোটি টাকায়। এবারের বাজেটে ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ গ্রহণের চিন্তা আছে ৪৭,৩৬৩ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর খেলাপী ঋণগ্রহিতাদের কারণে তারল্য কতটুকু বাস্তাবায়িত হবে তা অজ্ঞাত। বৈদেশিক ইস্পিত অনুদান ধরা হয় ৪,১৬৮ কোটি টাকা। এ অংকটা একটা আন্দাজে ধরা হয় ৪,১৬৮ কোটি টাকা। এ অংকটা একটা আন্দাজে ধর্তব্য বিষয়।
এ বাজেটে ভ্যাটের স্তর বাড়িয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর ওপর ৫% হারে ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে এলপি গ্যাস, গুড়ামসলা, টমেটো চাটনি, ফলের জুস, মোবাইলে কথা বলা, প্লাস্টিক সামগ্রী অ্যালমুনিয়ামের হাঁড়ি পাতিল, চিনি, গুরোদুধসহ আরো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি সহজভাষায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেলে মূল্য স্ফীতি বাড়ে।
তৈরি পোশাকের ওপর ২.৫% ভ্যাট বৃদ্ধি প্রস্তাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী জামা-কাপড় তৈরির ওপর ১০% হারে ভ্যাট ধার্য গার্মেন্টস শিল্পে বিপর্যয়ে কারণ ঘটানো নিঘাত ভাবে। সরকার গত বছর গার্মেন্টসে সর্বনিম্ন ৪ হাজার টাকার স্থলে ৮ হাজার টাকা নির্ধারণ করেছে, এ সিদ্ধান্ত, আত্মঘাতিমূলক। গত ৪ বছরে ১২০০টি গার্মেন্টস শিল্প বন্ধ ঘোষিত হয়। ঈড়ংঃ গরহরসরুরহম এর অজুহাতে শ্রমিক কর্মচারী ছাঠাই হচ্ছে। নতুন নিয়োগ বন্ধ। রপ্তানী বাণিজ্যে কঠিন প্রতিযোগিতায় যদি হেরে যায় তবে শ্রমবান্ধব এ খাতটা আর ঠিকে থাকবে কিনা সন্দেহ। তৈরী পোশাক রপ্তানীতে ২৮২৫ কোটি টাকা প্রনোদনা বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে এটা একটা ভালো দিক তবে প্রনোদনা অংকটা আরো বড়ো হলে ভালো হতো।
খেলাপী ঋণ উদ্ধারে কোন দিক নির্দেশনা বাজেটে উল্লেখ নেই। ঋণ খেলাপীদের মধ্যে সার্বজনীন বিষয় এড়িয়ে শুধু মিডিয়া মালিকরা কে কত টাকার জন্য ঋণ খেলাপী তা খুঁজে বের করার উক্তি দুঃখজনক। শিক্ষার্থীদের বৃত্তির পরিমাণ প্রাথমিকে ৭৫০ টাকা মাধ্যমিকে ৮০০ টাকা উচ্চ মাধ্যমিকে ৯০০টাকা। অর্থের এ অংক অত্যন্ত ছোট।
সারাদেশে ১০০টি ইপিজেড করার উদ্যোগ গ্রহণ করা এতে বিনিয়োগের তড়িৎ উদ্যোগ গ্রহণ সম্ভব নয়। বিনিয়োগক্ষেত্র সম্প্রসারিত না হলে ১ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান শুধু আশ্বাসই থেকে যাবে। চিনির খেলে ডায়বেটিস হয় তাই সরকার চিনির দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এটা একটা টুনকো যুক্তি। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য বিবেচনা করে চিনি মূল্য বৃদ্ধি এড়িয়ে যাওয়াটা সঙ্গত ছিলো।
২০২১ সালের মধ্যে ১ কোটি করদাতা সৃষ্টি করার পরিকল্পনা আছে সরকারের। মানুষ আয় বাড়ার সাথে সাথে যদি ভোগ ব্যায় বাড়ে বা সেবাখাতে ব্যয় বৃদ্ধি পায় এবং সঞ্চয় প্রবণতা হ্রাস পায় তবে মানুষ কর দিবে কিভাবে উৎসাহী হবে ? মানুষের আবাসন ব্যয় বেড়েছে। শিক্ষাখাতে চিকিৎসা খাতে ব্যায় বেড়েছে, পরিবহন খাতে ব্যয় বেড়েছে, ভ্যাটস্তর বৃদ্ধি জনিত কারণে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। ( পরোক্ষ উপরে) গ্যাসের দাম বাড়তি, বিদ্যুতের দাম বাড়তি, পানির দাম বৃদ্ধ, পৌরকর বৃদ্ধি, ভূমি উন্নয়ন কর বৃদ্ধি এরপর যুক্ত আছে সারচার্জ। সরকার যদি বলেন ‘কাউকে কষ্ট না দিয়ে রাজস্ব জোগাড় করতে চাই’। তাই যদি হয় তা হলে সরকার জনবান্ধব সরকার এমন্তব্য করতে কোন দ্বিধাদ্ব›দ্ব থাকার কথা নয়। ঋণকে ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব করতে হলে সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিট করার ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী কিন্তু ব্যাংকগুলো বিশেষ করে বেসরকারি ব্যাংকগুলো তা আমলে না নিয়ে ডাবল জিডিট সুদের হার অব্যাহত রেখেছে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী কটোর অবস্থানে যাওয়ার কথা পূর্ণব্যক্ত করেছেন। ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের পর ধার্যকৃত সুধ মূল টাকার সঙ্গে যুক্ত হয়ে তার ওপর সুধ ধার্য্য হয়। চক্রবৃদ্ধিজনিত সুদের ভীতিকর কারণে ব্যবসা ও বিনিয়োগে স্থবির অবস্থা বিদ্যমান। তাই খেলাপী ঋণের অংক বড় হতে ঋণ পরিশোধের অক্ষমতা বাড়ছে। ব্যাংকগুলো শুধু সুদের ব্যবসাতে যতটাকা আয় করছে ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগ করে ততটাকা মুনাফা অর্জন করতে পারছেন না। অথচ বিনিয়োগকারীরা দেশের বিরাট অংশ মানুষের কর্মসংস্থান করে জাতিকে বৃহত্তর সাপোর্ট প্রদান করে আসছে। বাজেট পেশের পূর্বে অর্থমন্ত্রী সাহেব চক্রবৃদ্ধি নয় সরল সুদে ঋণ প্রথার অঙ্গিকার ব্যাক্ত করেছেন তা যদি হয় ব্যবসা ও বিনিয়োগে গতিশীলতা আসবে।
১ বছর ব্যবধানে খেলাপি ঋণ ২২০০০ কোটি টাকা বেড়েছে। চলতি বছর মার্চ শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা। সবগুলো ব্যাংকের মোট ঋণের পরিমাণ ৯ লক্ষ ৩৩ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা । শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত ৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে শুধু খেলাপি ঋণ ৫৩ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা। এতে বড়ো অংকের টাকা উদ্ধারের দিকনির্দেশনা বাজেটে নেই। বাজেটের সবচেয়ে দৃষ্টিকটু দিক হচ্ছে ভ্যাট আতঙ্কজাল। প্রস্তাবিত বাজেটে ৫,৭,১০,১৫ শতাংশ ভ্যাট স্তরের সৃজন করা হয়েছে। ১৫ শতাংকের নিচে বাকী ৩ স্তরের ভ্যাটপ্রদান কারীরা ভ্যাট পরিশোধ বাবত কোন কর রেয়াতের সুবিধা পাবেনা। এভাবে দৈত কর জালে আবদ্ধ হবেন ৫,৭,১০ স্তরের ভ্যাট দাতাগণ। বাজেটে শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর নতুন করে ভ্যাট জাল বসানো হয়। ৮৬ টি পণ্যের ওপর ট্যারিফ মূল্যের পরিবর্তে ৫% ভ্যাট আরোপ করা হয়। এবার মোটা সুতা ৫% ভ্যাট আরোপ করায় টেক্সটাইল মিলসগুলোর অবস্থা খুব খারাপের দিকে যাবে।
বাজেরে মজাদিক হচ্ছে ঘটকালিতে ভ্যাট আরোপিত হতে যাচ্ছে। প্রকারান্তে এ ব্যায় কন্যা ও পুত্র দায়গ্রস্ত পিতা-মাতার ঘাড়ে গিয়ে পড়বে। নির্মাণ সামগ্রীর মধ্যে উৎপাদন ও বিপননে টন প্রতি ৯০০ টাকার স্থলে ২০০০ টাকা ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে।
করমুক্ত আয়সীমা পূর্বের মত বহাল থাকছে। সঞ্চয়পত্রের উপর ও কুনজর পড়েছে। মধ্যবিত্তের হিসেবের ওপর ও ভাগ বসাবে করের মাধ্যমে। সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রী বলেন, ব্যাট বহুস্তরের করা ভালো হয়নি।
হুন্ডি ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করতে রেমিন্ট্যান্স প্রদান কারীদেরকে ২% হারে উৎসাহ প্রনোদনা প্রশংসনীয় উদ্যোগ। মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ১০,০০০ টাকা থেকে ১২,০০০ টাকা বৃদ্ধি ভালো প্রস্তাবনা। ৬০ বৎসর বয়স্কদের জন্য বয়স্কভাতা বাস, ট্রেনে অর্ধেক ভাড়া ব্যবস্থা চালু করলে বয়স্কদের আর্শিবাদ বর্ষিত হতো। বাজেটের মাধ্যমে যতটুকু মজা প্রাপ্তি প্রত্যাশা করেছিলাম ততটুকু মজা পেলাম না।

লেখক : কলামিস্ট