‘বাজা তোর প্রলয় বিষাণ ধ্বংস নিশান উঠুক নিনাদ প্রাচীর ভেদি’

428

প্রথমে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি বোদ্ধাদের কাছে ‘উঠুক নিনাদ’ কথাটির জন্যে। আসলে মূল কবিতায় আছে ‘উড়–ক প্রাচীর’ শব্দ যুগল। কিন্তু আমার কাছে তার চাইতে ‘উঠুক নিনাদ’ কথাটিতে কিছুটা অধিক শক্তি আর প্রতিবাদ নিহিত রয়েছে বলে মনে হলো, তাই দুঃসাহসটা একটু দেখিয়ে ফেললাম। তাতে করে যদি আমাদের জাতীয় কবির শানে কোন ঔদ্ধত্য প্রকাশ পায় তবে তাঁর কাছেও অধম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আশা করি স্বীয় মহিমায় আমার অনিচ্ছাকৃত ধৃষ্টতাকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। কথায় বলে যত গর্জে তত বর্ষে না বা যত চেতে তত তেজে না কিংবা যত ধমকে তত চমকেনাঅর্থাৎ তর্জনে যতই গর্জন উঠে অর্জনে ততই বর্জন ঘটে। আরো সহজ করে যদি বলি, যত রটে তত ঘটেনা এবং এক কথায় অতিরঞ্জন। অর্থাৎ আমরা সব কিছুকে অতিরঞ্জিত করে ফেলি, একাজে আমরা বড় কাবিল। এখন ভাবছি উঠুক নিনাদ যোগ করে ক্যাপশনকে যেমন প্রতিবাদী আর বিদ্রোহী করে তুলতে চাইলাম বাস্তবে তা হবে কিনা। তথা যত দাম্ভিক তত আঙ্গিক কিনা। হাতি ছুটাব, ঘোড়া দৌড়াব বলে যতই ফাঁকাফাঁকি করি বাস্তবে আসলে ঘুঘুই চরাই। আমরা হলাম লস্কর আমাদের বানায় তস্কর। কে বানায় আল্লাহ্ জানেন, আমি জানি না। ১/১১তেও আমরা কিছু জানতাম না, ওমা পরে দেখি সবাই সবকিছু জানে, হাহা।
অসারের তর্জন-গর্জনই সার, ছাল নাই কুত্তার ফাল বেশী। মনে পড়ছে মেঘনাদের হুঙ্কার; ‘হে পিতৃব্য, তব বাক্যে ইচ্ছা মরিবারে; রাঘবের দাস তুমি? কেমনে ও মুখে আনিলে এ কথা তাত, কহ তা দাসেরে। আমি কি ডরাই সখী ভিখারী রাঘবে? ছাড় দ্বার যাব অস্ত্রাগারে, পাঠাইব রামানুজে শমন ভবনে। ডমরু ধ্বনি শুনি কালফণী কি কভু অলসভাবে নিবাসে বিবরে? পশে যদি কাকোদর গরুড়ের নীড়ে, ফিরি কি সে যায় কভু আপন বিবরে পামর?’ এতসব গর্জন করেও তার রক্ষা হয়নি, শেষে ল²ণের হাতেই তাকে মরতে হল। কি হবে গর্জন করে, হাতে তো অস্ত্র নাই তার, শূন্য হস্তে গর্জন করে লাভ কি? তবে মেঘনাদ প্রকৃত বীর তাকে ছোটকরে দেখার উপায় নাই। কেবল বুঝাতে চেয়েছি বীর হলেও হাতে কিছু থাকতে হয়। আসুন একটু খনাকে দেখি, বড়ই পÐিত মহিলা, বরাহের পুত্র মিহিরের স্ত্রী খনা। বরাহ রাজ-জ্যোতিষী, মিহিরও জ্যোতিষী। তবে পিতা-পুত্র অপেক্ষা খনার গণনা বেশী নির্ভুল হওয়ায় খনা রাজা বিক্রমাদিত্যের দৃষ্টি অধিক আকর্ষণ করলেন।খনার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে রাজা খনাকে রাজসভায় দশম রতœ আখ্যা দিলেন। ফলশ্রæতিতে রাজদৃষ্টিতে নিজাধিপত্য হীন প্রতিপন্ন হওয়ার আশঙ্কায় বরাহ খনার প্রতি প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে উঠেন। অবশেষে বরাহ মিহিরকে নির্দেশ দিলেন খনা’র জিহŸা কেটে নিতে, মিহির পিতার নির্দেশ পালন করলেন। এর কিছুকাল পর খনা মৃত্যুবরণ করলেনÑ বড়ই হৃদয়বিদারক ঘটনা। তবে মর‌্যাল অব দ্যা স্টোরি হল আগে আগে বকবক করা ঠিক না। জানলেও চুপ থাকা, দেখলেও মূক থাকা। কারণবোবার শত্রু নাই বাচালের মিত্র নাই, না জানায় দোষ নাই। দোষ সব জানার মধ্যে, ভুল সব দেখার মধ্যে। আমি এক জায়গায় কিছুবেশী বক্তৃতা করায়, এখন কেউ ডাকে না, হাহাহা।
‘অবুঝে বুঝাব কত বুঝ নাহি মানে, ঢেঁকিরে বুঝাব কত নিত্য ধান ভানে। অবোধারে মারে বোধায়, বোধারে মারে খোদায়।’ একটি প্রবচন বললাম, খনার কথা যখন তুললাম ‘খনার বচন’ একটি বললাম আরকি। অর্থাৎ অবুঝকে আর কত বুঝাব, বুঝ সে মানেনা ফলে অবুঝকে মারে চতুরে আর চতুরকে মারে খোদা। এখন আমাদের ইমরান এইচ সরকারকে মারলটা কে? নাম- গ্রাম সুদ্ধ নাই, আল্লারে আল্লাহ্ কি দাপট যেন এক মন্ত্রী। তখন বাংলাদেশে ছিল দুই সরকার, আমি না নিন্দুকে কহিত; বাংলাদেশ সরকার আর ইমরান এইচ সরকার। তার কথায় জাতীয় পতাকা উড়ে, তার কথায় জাতীয় সংগীত বাজে, তার কথায় প্রদীপ জ্বলে তার কথায় নিভে। তার কথায় সংসদে আইন পাশ হয়, নীরবতা পালন হয়, মাশাল্লাহ্! আহা আজ কোথায় সে আর কোথায় তার ক্ষমতা? মধু শেষ সে স্ম্যাশ। কোথায় হারিয়ে গেল আজ তার সেই সোনা রঙের দিনগুলো? ‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না, রইল না—— সেই যে আমার নানান রঙের দিনগুলি।’ আর কি যে বলি নিন্দুকদের কথা, তাদের মনে হয় খেয়েদেয়ে কাজ নাই। খালি আজে-বাজে কথা রটনা করে, আমেরিকায় তাকে নিয়ে আর জুতাকে নিয়ে নাকি কি সব কাÐ ঘটেছে। আমি নয় দুষ্টুগণ কহে। এজন্যই বলে নিজ বুদ্ধিতে ভাত পর বুদ্ধিতে হাভাত। অতি বাড় বেড়ো না ঝড়ে পড়ে যাবে, অতি খাটো হইও না ছাগল মোড়ে খাবে। অতএব নিজের থাকা ভাঙ্গা খাট উত্তম, অন্যের দেওয়া সোনার খাটও অধম কারণ যে কোন সময় কেড়ে নিতে পারে। নিজের পায়ে জোর না থাকলে পরের কাঁধে ভর দিয়ে কি হাঁটা যায়?
এবার আমার ভাবগুরু ইশপের কাছে না গেলে নয়। এক কাক অনেক কষ্ট করে এক টুকরা মাংস জোগাড় করল, উড়ে সে একটি বড় গাছের ডালে গিয়ে বসল মাংসটি আরাম করে খাবে বলে। মাংস তার ঠোঁটে ধরা ঠিক সে সময় গাছের নীচ দিয়ে এক শিয়াল যাচ্ছে, সে কাকের ঠোঁটে মাংসখÐটি দেখল। সাথে সাথে গাছের তলে বসে কাকের প্রশংসা শুরু করে দিল শিয়াল। ‘ঈশ পাখিটা কি সুন্দর, আমি এতসুন্দর পাখি জীবনে কখনো দেখিনি! আহা যে পাখি এত সুন্দর না জানি তার গানের গলা কত মিষ্টি হয়। একবার যদি তার মধুর কণ্ঠের সুরেলা গান আমি শুনতে পেতাম জীবন আমার তাহলে ধন্য হয়ে যেত।’ কিন্তু কাক কিছু বলে না, চুপ করে আছে। শিয়াল তখন দুঃখ করে বলছে, ‘মনে হয় পাখিটি বোবা কথা বলতে পারেনা। হায় এমন এক সুন্দর পাখিকে আল্লাহ্ কেন যে বোবা করে পৃথিবীতে পাঠালেন, বড় দুঃখ হয় মনে।’শিয়ালের টোপ কাক গিলে ফেলল, গান শুনাতে তাকে কা করে উঠল। আর মাংসটা টপ করে নিচে পড়ে গেল, শিয়ালের স্বার্থ সিদ্ধি হল তৎক্ষণাৎ সে মাংসটা মুখে নিয়ে হাঁটা দিল, কাকবেটা ধরা খেল হাহা। কাক তখন বলছে, ‘দুষ্ট লোকের মিষ্ট কথায় ভুলিতে নাই।’ চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে, ঠিক আছেকাকের কথা মানলাম, কিন্তু গল্পটি থেকে আমরা আরেকটি শিক্ষা পাই। সেটি হল যতক্ষণ আশা ততক্ষণ প্রশংসা, আশা নাশা শুরু জিঘাংসা। মাশাল্লাহ্ চিন্তা ছাড়া ভরসা নাই, দুঃখ ছাড়া গতি নাই।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা কতগুলো অভিযান দেখলাম। সন্ত্রাস বিরোধী অভিযান, মাদক, জুয়া, দুর্নীতি, ক্যাসিনো, ইত্যাদি বিরোধী অভিযান। কদিন বেশ এলাহি কাÐ, রাম-সাম-যদু-মধু, তারপর যেই লাউ সেই কদু। ধরল কাদের, মারল কাদের, বধল যাদের সব পিপীলিকার দল, রয়ে গেল সব গুড়ের ভাÐ। সবাই খালি পিঁপড়া মারে লেকিন গুড় সরায় না। এখন গুড়ের কল কোথায়, কলের বল কোথায় সব আমাদের জানা কিন্তু বলতে মানা। এই যে পিঁপড়ার দল মারা পড়ছে তারা কারা? সব কিশোর আর তরুণ ছেলেপেলেরা। এদের এসব বানিয়েছে যারা তারাই আবার তাদের সরিয়েছে, প্রয়োজন ফুরিয়েছে আয়োজন গুটিয়েছে। বুয়েট, বাংলাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তার ছাত্ররা হচ্ছে দেশের সেরা ছাত্র। তোদের কেন বড় ভাইয়ের দরকার? আরে কদিন পর তোরা নিজেরাই তো বড়ভাই হবি, দেশের শ্রেষ্ঠসন্তান। কিন্তু কি করলি? এক আবরারকে খুন করলি ২৫ আবরার শেষ হলি, জীবন বরবাদ ফাঁসির আবাদ।
কে একজন বলল উপরের নির্দেশ মানতে হয় অর্থাৎ উপরের নির্দেশে খুন করেছে। এখন উপরটা কে এবং কত উপর? আল্লাহই জানেন আমরা জানি না। তবে একটি গল্প মনে পড়ে গেল: ‘এক অফিসে একদিন একটি টেলিফোন কল এল। কল গ্রহীতা; হ্যালো আপনি কে?কল দাতা; আমি উপর থেকেবলছি তোমাদের বসকে ফোন দাও। গ্রহীতা; আপনি কি ডিসি? দাতা; না আমি তার উপরে। আপনি কি সচিব? না আমি তারও উপরে। আপনি কি তাহলে মন্ত্রী? না আমি তারও উপরে। আপনি কি প্রধানমন্ত্রী? না আমি তারও উপরে। আপনি কি তাহলে রাষ্ট্রপতি? না আমি তারও উপরে। আপনি কি কোন ডোনাল্ড ট্রাম্প?না আমি তারও উপরে। তাহলে কি আপনি ঈশ্বর? না আমি তারও উপরে। কিন্তু ঈশ্বরের উপর তো কেউ না! হেহে আমি সেই কেউ না।’ হাহা,গল্পের উপরের সাথে দেখবেন আমাদের উপরের পুরা মিল। এখন গিয়ে খুঁজে দেখুন সেই নির্দেশদাতাকে কোথাও পাবেননা, কারণ সে কেউ না তাই সে সবার উপরে। উপর থেকে খালি নির্দেশ আসে, খুঁজলে কাউকে পায় না,মনে হয় অত উঁচুতে উঠতে পারেনা। অবশ্য ঈশ্বরের উপরে হলে উঠবেও বা কেমন করে? হাহাহা।
অতএব তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে চুনোপুঁটি এনকাউন্টারে মরে। হায়রে তরুণের দল তোরা হবি সমাজ সংস্কারক, গড়বি নতুন সমাজ দিবি আলোর দিশা, তাড়াবি অন্ধকার। তোদের কণ্ঠে ধ্বনিত হবে, ‘ওরে ও তরুণ ঈশাণ বাজা তোর প্রলয় বিষাণ, ধ্বংস নিশান উঠুক নিনাদ প্রাচীর ভেদি।’কিন্তু হায়রে দুঃখ তার বদলে তোরা এখন গাচ্ছিস, ‘এখাঁচা ভাংবো আমি কেমন করে? দিকে দিকে বাচ্ছে যখন শিকল ভাঙ্গার গান। আমি তখন চোরের মত হুজুর হুজুর করায় রত। চাচা আপন বাঁচা বলে বাঁচিয়েছি প্রাণ। আসলে ভাই একা একা বাঁচার নামে আছি মরে। এখাঁচা ভাংবো আমি কেমন করে?’ ছাত্রসমাজ, তরুণসমাজ তোমরা অপব্যবহার হচ্ছো, বলির পাঁঠা বানানো হচ্ছে তোমাদের। পাটা-পুতার ঘষাঘষি মাঝে পড়ে মরিচের খারাবি। ছাত্র-তরুণ তোমাদের বেরিয়ে আসতে হবে এই পঁচে যাওয়া রাজনীতির নোংরা ভাগাড় হতে। ভেঙ্গে ফেলো অপরাজনীতির কুৎসিত লৌহবেষ্টনী। বেরিয়ে আসো কুসুম পল্লবিত মুক্ত ভুবনে, গুঁড়িয়ে দাও অপরাজনীতির সব বেড়াজাল। ঘুচিয়ে ফেলো রাজা-প্রজার কুৎসিত সব নিয়ম-নীতি, সততা ও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হও। কয়দিন বাঁচবে পৃথিবীতে, তাহলে এত সম্পদ কি দরকার? একথা বুকে ধারণ করে নবচেতনায় জেগে উঠ। সব অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতি, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বাজাও তোমাদের প্রলয় বিষাণ, ধ্বংস নিশান, উঠুক নিনাদ প্রাচীর ভেদি।
লেখক : কলামিস্ট