বাজার, মার্কেট, হাসপাতাল ও বস্তিগুলো ঝুঁকিপূর্ণ

125

আগুন শুধু সম্পদহানি করে না, মূল্যবান প্রাণও কেড়ে নেয়। অগ্নিকান্ড একটি দুর্যোগের নামও। সেই আগুনের অতিঝুঁকিতে রয়েছে পুরো চট্টগ্রাম নগরী।
নগরীর বাজার, মার্কেট, হাসপাতাল থেকে শুরু করে বস্তিগুলো রয়েছে আগুনের অতিঝুঁকিপূর্ণের তালিকায়। সচেতনতার পাশাপাশি, ফায়ার হাইড্রেন্ট, ফায়ার এক্সটিংগুইসার সংযোজনের তাগিদ দিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।
চাক্তাইয়ের ভেড়া মার্কেট বস্তিতে অগ্নিকান্ডে ৮ জনের প্রাণহানির পর মাত্র চার দিনের ব্যবধানে রাজধানী ঢাকার চকবাজার চুড়াহাট্টায় আরেক মর্মস্পর্শী অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ৬৭ জনের প্রাণহানি ঘটনা পুরো দেশের মানুষকে নাড়া দিয়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়নের পাশাপাশি অসচেতনতা, প্রশাসনিক জটিলতা, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে প্রতিনিয়ত এসব দুর্ঘটনায় অসংখ্য প্রাণ ঝরে পড়ছে। এরপরও ইতিবাচক কোন পদক্ষেপ নেওয়া হওয়া না কোথাও।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের এলাকাগুলোতে অগ্নি দুর্ঘটনার ঝুঁকিপূর্ণ ও অতিঝুঁকিসহ বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করে জরিপ চালিয়েছে চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম শহরের মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের আগ্রাবাদ হেড কোয়ার্টার এলাকার আওতায় ঝাউতলা বস্তি, আমবাগান বস্তি, সেগুনবাগান বস্তি, কদমতলী রেলওয়ে বস্তি, সিঙ্গাংপুর সমবায় সমিতি মার্কেট, কর্ণফুলী মার্কেট, কালুরঘাট ফায়ার সার্ভিস এলাকায় বহদ্দারহাট হক মার্কেট, স্বজন সুপার মার্কেট, বকতেয়ার মার্কেট, নজু মিয়া হাট মার্কেট, বলির হাট মার্কেট, চাক্তাই ফায়ার স্টেশনের আওতায় ভেড়া মার্কেট, চাল পট্টি, শুটকি পট্টি, খাতুনগঞ্জ, আসাদগঞ্জ, মিয়া খান নগর, পুরাতন ঝুট মার্কেট, ওমর আলী মার্কেট, বন্দর এলাকার মধ্যে পোর্ট মার্কেট, বড়পুল বাজার, ইশান মিস্ত্রি বাজার মার্কেট, ফকির হাট মার্কেট, নয়া বাজার মার্কেট, ফইল্যাতলী বাজার, ইপিজেড ফায়ার স্টেশনের আওতায় চৌধুরী মার্কেট, রেলওয়ে বস্তি, কলসী দিঘীর পাড় এলাকার কলোনি, আকমল আলী রোড এলাকাধীন কলোনি, চন্দনপুরা ফায়ার সার্ভিসের চকভিউ সুপার মার্কেট, কেয়ারি শপিং মল, গুলজার মার্কেট, নন্দকানন ফায়ার সার্ভিসের আওতায় রিয়াজ উদ্দিন বাজার, জহুর হকার্স মার্কেট, টেরি বাজার, তামাকুমন্ডি লেন, বায়েজিদ ফায়ার স্টেশনের আওতায় ২নং গেইট রেলওয়ে বস্তি, ড্রাইভার কলোনি, অক্সিজেন রাস্তা সংলগ্ন বস্তি, বার্মা কলোনি, রৌফাবাদ কলোনি, শেরশাহ কলোনিকে ‘অতি-ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, অতিঝুঁকিপূর্ণ এসব এলাকায় পানির প্রাকৃতিক উৎস একেবারে কম, আগুন নেভানোর আধুনিক যন্ত্রপাতির সংযোজনও নগণ্য। বিশেষ করে মার্কেটগুলোতে পর্যাপ্ত ফায়ার এক্সটিংগুইসার নেই। সবচেয়ে জনবহুল রিয়াজ উদ্দিন বাজার, তামাকুমন্ডি লেন, জহুর হকার্স মার্কেটে অবস্থা একেবারে নাজুক। সুই সুতা থেকে প্লাস্টিক, মনোহারী, কেমিক্যাল, গার্মেন্টস পণ্যের বিশাল মজুদ থাকে মার্কেটগুলোতে। এখানে গিঞ্জি পরিবেশে চলে কেনাবেচা। মার্কেটগুলোর সরু গলি গুলোতে প্রতিনিয়ত মানুষের ভিড় লেগে থাকে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় শত বছরের অধিক পুরোনো রিয়াজ উদ্দিন বাজারে ছোটবড় শতাধিক মার্কেট রয়েছে। দোকান রয়েছে প্রায় ১০ হাজারের কাছাকাছি। তামাকুমন্ডি লেনেও অর্ধ শত মার্কেটের পাশাপাশি প্রায় ৫ হাজারের মতো দোকান রয়েছে। জহুর হকার্স মার্কেটটি গড়ে উঠেছে একেবারে টিনশেড বস্তির মতোই।
কথা হলে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি চট্টগ্রাম জেলা সভাপতি সালেহ আহমদ সুলেমান পূর্বদেশকে জানান, চট্টগ্রামের অনেক বড় বড় মার্কেট ও বাজার রয়েছে। ব্যবসায়ীরা কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। কিন্তু মার্কেটগুলোতে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। বিশেষ করে মার্কেট ও দোকানগুলোতে পর্যাপ্ত ফায়ার এক্সটিংগুইসার নেই। যেগুলো রয়েছে, সেগুলোও নিয়মিত ব্যবহার উপযোগী করে রাখা হয় না। সেজন্য আমরা নগরীসহ জেলাজুড়ে মার্কেটের ব্যবসায়ীদের সাথে বৈঠক করার পদক্ষেপ নিয়েছি। সচেতনতার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় অগ্নি নির্বাপন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে অগ্নিকান্ডে ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব হবে।
চট্টগ্রাম চেম্বারের প্রেসিডেন্ট মাহবুব আলম পূর্বদেশকে বলেন, আগুনে এ ধরণের প্রাণহানি কখনো কাম্য নয়। দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, কিন্তু দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি কমাতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আগুনের ঝুঁকি কমাতে মডার্ন সিটি মডার্ন কনসেপ্ট নিয়ে আসতে হবে।
চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এর উপ-সহকারি পরিচালক পূর্ণচন্দ্র মুৎসুদ্দী পূর্বদেশকে বলেন, চট্টগ্রাম শহর সুদূর অতীত বৃটিশ আমল থেকেই অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। বর্তমানে এমন একটি পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে আর পেছনে যাওয়ার কোন রাস্তাই নেই। যেকোন মুহূর্তে ঢাকার চকবাজারের মতো মর্মস্পর্শী ঘটনা চট্টগ্রামেও ঘটতে পারে। আমাদের একটা প্রস্তুতি রয়েছে। কি কি সমস্যা হতে পারে? কি করা প্রয়োজন? তা আমরা নোটিশের মাধ্যমে সকলকে জানিয়েছি।
তিনি বলেন, পুরো চট্টগ্রাম নগরীর প্রায় প্রত্যেক মার্কেট, বাজার, বস্তিগুলোকে আমাদের পরিদর্শনের আওতায় এনেছি। নগরীর একটি মার্কেটও বাদ রাখিনি। সবগুলো আমাদের সার্ভের আওতায় এসেছে। আমরা ‘অতিঝুঁকিপূর্ণ’ ও ‘ঝুঁকিপূর্ণ’সহ নানান শ্রেণিতে ভাগ করে সার্ভে করেছি।
ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রাম শহরটাকে পর্যায়ক্রমে সাজানো দরকার। পানির একটা বিশাল সংকট রয়েছে। পানির মূল উৎস জলাশয়গুলো ভরাট করে ফেলা হয়েছে, অপরিকল্পিতভাবে জলাশয়গুলো ভরাট করে ফেলার কারণে কোন কারণে অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটলে পানির সংকট তৈরি হয়। দূরবর্তী কোন এলাকা থেকে পানি আনতে গিয়ে এবং রাস্তায় যানজট থাকার ফলে অগ্নি নির্বাপন বিলম্বিত হয়ে। এতে ক্ষয়ক্ষতি বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। রাস্তায় যানজট তৈরি হলে তখন ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলোও চলাচল করতে পারে না। বিরতি দিয়ে পানি ছিটিয়ে আগুন নেভানো সম্ভব নয়। আগুন নেভাতে ধারাবাহিকভাবে পানি ছিটাতে হয়। কারণ আগুন যে তাপ তৈরি করে তা ধারাবাহিকভাবে পানি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। যদি বিরতি পড়ে তাহলে আগুন আবারো বেড়ে যায়।
অগ্নিঝুঁকি কমানোর উদ্যোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এখনও একটা সুযোগ রয়েছে। কারণ ওয়াসার আধুনিকায়ন প্রজেক্টটি এখনো শেষ হয়নি। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে ‘ফায়ার হাইড্রেন্ট’ বসানো উচিত। ওয়াসার মিটিংগুলোতে আমরা বিষয়টি উপস্থাপন করেছি। ইতোমধ্যে আমাদের আগ্রাবাদ স্টেশনে একটি হাইড্রেন্ট বসানো হয়েছে। কিন্তু ওয়াসার বক্তব্য হচ্ছে, সব জায়গায় হাইড্রেন্ট দেওয়া হলে পানির অপব্যয় হবে, পানি চুরি বেড়ে যাবে। চোরের জন্যতো জীবন বলি দিতে পারি না। ফায়ার হাইড্রেন্ট বসিয়ে এগুলোতে অন্যভাবে হলেও ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে। অতিগুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে অন্তত একটি করে হলেও হাইড্রেন্ট দেওয়া হলে অগ্নিদুর্ঘটনায় এসব হাইড্রেন্ট খুবই উপকারে আসবে। এতে ঝুঁকি কিছুটা কমে আসার সম্ভাবনা থাকবে।
সচেতনতার বিষয়ে তিনি বলেন, বেশ কয়েকবার ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর সাথে আমরা বৈঠক করেছি। আমাদের প্রাথমিক পদক্ষেপ হচ্ছে, শিল্প কারখানাগুলোকে অগ্নি নিরোধক ব্যবস্থার মধ্যে আনা। তাছাড়া বাজার-মার্কেটগুলোকে সচেতনতার মধ্যে এনে আগুনে ক্ষয়ক্ষতি কমানোর উদ্যোগ নিয়েছি।