বাঙালি জাতিসত্তা সম্পর্কে সচেতন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু

45

প্রথমভাগে বরণ্য রাজনীতিবিদদের নিয়েই আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা হওয়াকে সৌভাগ্য বলে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম বলেছেন, বঙ্গবন্ধু হাল ধরেই এ দলকে এগিয়ে নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর বড় সাফল্য বাঙালি জাতিসত্তা সম্পর্কে দেশবাসীকে সচেতন করেছিলেন। যা এখনও আমরা ধারণ করছি। এ সত্তা ধারণ করতে গিয়েই বাঙালি জাতি স্বাধীনতা চায়। বহু আন্দোলনের মধ্যে বাঙালি জাতির নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। আমরা পেয়েছি স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে নগরীর শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে ‘তারুণ্যের ভাবনায় আওয়ামী লীগ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সেলের (সিআরআই) সহযোগিতায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রচার উপ-কমিটি এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও রাজনীতি, চট্টগ্রাম এবং সমসাময়িক বাংলাদেশ নিয়ে তিন পর্বের অনুষ্ঠানে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দুই শতাধিক শিক্ষার্থী এতে অংশ নেন।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রচার উপ-কমিটির চেয়ারম্যান এইচটি ইমাম বলেন, জিয়া ও এরশাদ মুদ্রার এপিট-ওপিঠ। এরশাদ কিছু কাজ করেছেন ঠিকই কিন্তু মন ছিল অন্যখানে। পরবর্তীতে শেখ হাসিনা দেশকে সুসংগঠিত করেছেন। দলকে সুসংগঠিত করতেও ভূমিকা রাখেন শেখ হাসিনা। অনেকেই এদিক সেদিক গেছেন। এরপরও তিনি সাফল্যের সাথে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। বড় দলে অন্তর্দ্বন্দ্ব থাকবে। এরপরও সবকিছুর ঊর্ধ্বে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ আওয়ামী লীগের ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, আওয়ামী লীগের ইতিহাস বাংলাদেশের ইতিহাসের চেয়ে দীর্ঘ। বাংলাদেশের আগেই আওয়ামী লীগের জন্ম। আওয়ামী মুসলিম লীগ হিসেবে দলটি আত্মপ্রকাশ করলেও পরে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু ধীরে ধীরে মানুষের মনন তৈরি করেছেন। যখনই মনে করেছেন স্বাধীনতার ডাক দেয়ার সময় হয়েছে, তখনই স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সব সময় গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াই করেছে। অবরুদ্ধ গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে শেখ হাসিনা লড়াই করেছেন। বহুবার তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু বারবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে বাংলাদেশের মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাংলাদেশের ক্যানভাস পরিবর্তন করে আমাদের জাতির পরিচয়ে নতুন মাত্রা এনে দিয়েছেন শেখ হাসিনা ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ।

শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন ও উত্তর :
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান প্রশ্ন করেন, ‘বাংলাদেশের সবকিছুতে প্রধানমন্ত্রীকে কেন হস্তক্ষেপ করতে হয়। আমরা কি তৃণমূল নেতৃবৃন্দ ও তৃণমূল প্রশাসন মিলে কাজ করতে পারি না?
উত্তরে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমান বলেন, ‘সরকারের কার্যপরিধিতে বলা আছে কার কি কাজ। সবকিছু বিকেন্দ্রীকরণ করা আছে। তবুও অনেকে মনে করছেন শেখ হাসিনাই সকল ক্ষমতার উৎস। মন্ত্রীরা নিজেরা কাজ করেন, তার অধীনস্ত বিভাগ কাজ করে। সরকার পরিচালনা নিয়ে মানুষের মধ্যে কিছুটা স্বল্প ধারণা আছে। দেশ পরিচালনায় একের সাথে অপরের সম্পৃক্ততা আছে। কাউকে বাদ দিয়ে কিছু করা যাবে না।’
পোর্ট সিটি বিশ^বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী প্রশ্ন রাখেন, স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে প্রশ্ন আছে। শহরে এসে ইতিহাস জেনেছি। গ্রামে থাকতে জানতাম না। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে এখনও বিভ্রান্তিতে পড়তে হয় কেন?
উত্তরে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর। উনি জীবিত থাকতে কখনও এটা নিয়ে বিতর্ক হয়নি। স্বাধীনতা ঘোষণা ও পাঠ করা এক নয়। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা করলে চট্টগ্রাম থেকে এমএ হান্নান প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। পরে সেনাবাহিনীর একজন অফিসার হিসেবে জিয়াউর রহমানকে দিয়ে আবারও তা পাঠ করানো হয়। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিতর্ক হওয়া উচিত না। মানুষ সত্যি ইতিহাস জেনে গেছে। এরপরও অনেকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করে। হাইকোর্টের আদেশ অমান্য করে। সঠিক ইতিহাস জানাতে ছাত্রলীগকে কাজ করতে হবে।’
চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের ফাল্গুনী নামে এক শিক্ষার্থীর প্রশ্ন ছিল, ‘সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে ছাত্রলীগ ও ছাত্র রাজনীতি নিয়ে বিরূপ ধারণা আছে। এগুলো থেকে উত্তরণে আওয়ামী লীগ কেমন পদক্ষেপ নিবে।’
উত্তরে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন বলেন, ‘আমরা যখন ছাত্ররাজনীতি করি তখন আদর্শের রাজনীতি ছিল। ব্যক্তিস্বার্থের রাজনীতি ছিল না। তখন আমরা চিন্তা করতাম এ দেশ দরিদ্র দেশ। দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই এমন একটি সংগঠনকে বেছে নিয়েছিলাম যেটি ছিল ছাত্রলীগ। আওয়ামী লীগের আগেই ছাত্রলীগের জন্ম। আমরা নীতি আদর্শ ধারণ করে রাজনীতি করতাম। তখন অত্যাচার, নিপীড়ন সয়েছি। ওই রাজনীতির সুফল আজকের রাজনীতি। এখন যারা ছাত্রলীগ করছেন, তারা অনেকেই বলতে পারবেন না ছাত্রলীগের মনন কি? কখন গঠন হয়েছে। আদর্শ কি? উদ্দেশ্য কি? তখনকার সময় এগুলো বিবেচনায় নিয়েই নেতৃত্ব সৃষ্টি হতো। এখন যারা নেতৃত্ব দেন, তারাই বলতে পারেন না তাদের ইউনিটে কতজন ছাত্রলীগ করছেন।’
একই প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপ-প্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘কমিটি হচ্ছে জানলেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিছু কিছু কমিটিতে ৬০০ থেকে এক হাজার জনকে রাখা হয়। সবাই কমিটিতে আসতে চান। আমি যখন চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সদস্য ছিলাম, তখন কমিটি ছিল ৩৭ জনের। আমরা কমিটিতে ছিলাম ২৬ জন। বাকি পদগুলো শূন্য ছিল। তখন অনেকেই থাকলেও অযোগ্যতায় পদ দেয়া হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের ২৭ হাজার নেতাকর্মী জীবন দিয়েছে। ছাত্রলীগ সোনার মানুষ তৈরির পাঠশালা। এখনকার ছাত্রলীগ সোনার পাঠশালার তৈরির চেয়ে নিজের আখের গোছাতে বেশি কাজ করছে। নাম দিলেই কমিটিতে রাখা হচ্ছে। যাচাই করা হয় না তাদের যোগ্যতা। অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলে না ছাত্রলীগের কাছে।’
তিনি প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘একজন শিক্ষককে দেখলে আমরা মাথানত করতাম। আর এখন বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক ভিসি হতে ছাত্রের বাসায় বসে থাকে। তদবির করেন।’
চট্টগ্রামে দুর্ভোগ, দুর্দশা :
চট্টগ্রাম নিয়ে ভাবনা শীর্ষক পর্বে নগরীর বিভিন্ন দুর্ভোগ, দুদর্শার চিত্র তুলে ধরে প্রশ্ন করেন শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, সেবা সংস্থার সমন্বয়হীনতা, যানজট, জলাবদ্ধতার উত্তর খোঁজেন।
শিক্ষার্থী তানভীর অনিন্দ, লিজা দাশ, ডা. জামিলুর রহমান আকাশ, ইয়াসিন আরাফাত বাপ্পী, তানভীর কামালের করা এসব একত্রিত প্রশ্নের উত্তর দেন সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন।
তিনি বলেন, ‘উন্নয়নের প্রসব বেদনা বেশি। নগরীতে ৩২টি সেবাসংস্থা আছে। সবগুলো সরকারের অংশ ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে। চট্টগ্রামের প্রত্যাশিত ও কাক্সিক্ষত উন্নয়ন অনেক আগে করা উচিত ছিল। ১৯৭৫ সাল পরবর্তী কেউ চট্টগ্রামের দিকে তাকায়নি। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। যে কারণে দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে। এক সময় পানির জন্য হাহাকার ছিল। এখন ওয়াসা সুপেয় ও নিরাপদ পানি দিতে পাঁচটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। সুপেয় পানি পাচ্ছে, নিরাপদ পানি পায়নি। নিরাপদ পানি দিতেই খোঁড়াখুঁড়ি হচ্ছে। সবগুলো সংস্থার মধ্যে চসিকেই আমি একমাত্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। যে কারণে সবকিছু আমাকেই দেখতে হয়। কোন সংস্থা প্রকল্প আনলে বিরোধিতা করতে পারি না। সহযোগিতা করতে হয়। এজন্য প্রকল্প গ্রহণের আগে সমন্বয় করতে হবে। এতে ভোগান্তি কমবে।’
যানজট প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, ‘যানজটের অনেকগুলো কারণ আছে। পোর্ট ট্রাফিক ও সিটি ট্রাফিক আলাদা নাই। একই রাস্তা ব্যবহার করে পোর্ট ও সিটি ট্রাফিক। আলাদা করা গেলেই যানজট কমবে। বে টার্মিনাল হচ্ছে। ২০২১ সালে চালু হবে। এটি চালু হলে এবং বন্দরের আশপাশ থেকে অফডক সরানো গেলে যানজট কমে যাবে।’
জলাবদ্ধতা নিয়ে চসিক মেয়র বলেন, ‘চট্টগ্রাম ও দেশের অন্যান্য স্থানের জলাবদ্ধতার মধ্যে পার্থক্য আছে। এটি জোয়ার-ভাটার শহর। নি¤œাঞ্চলের সাথে নদীর ব্যবধান তিন মিটার। জলাধার জলাশয়ের প্রয়োজন হলেও তা হারিয়ে গেছে। ৫৬টি খালের মধ্যে ৩৬টি আছে। খালগুলো দখল ও নাব্যতা কমেছে। মানবসৃষ্ট কারণেই বেশি সমস্যা হচ্ছে। নগরবাসীকে এগিয়ে আসতে হবে।’
চট্টগ্রামের উন্নয়ন নিয়ে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘চট্টগ্রামে কিছুটা সমন্বয়হীনতা আছে। মন্ত্রী পরিষদে ওয়াসা, মেয়র, সিডিএ নিয়ে আগামীকাল (আজ বুধবার) দুপুরে সমন্বয় সভা আছে। সেখানে এসব বিষয় নিয়ে ফলপ্রসু আলোচনা হবে। যে সংস্থা খোঁড়াখুঁড়ি করে তাদের দায়িত্ব, তা দ্রুত আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দেয়া।’
প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার শাহ আলী ফরহাদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন সংসদ সদস্য সাইমুম সরোয়ার কমল, ওয়াসিকা আয়েশা খান, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান প্রমুখ।