বাঙালি জাতিসত্তার অহংকারের অধ্যায়

280

বায়ান্নর একুশে ফেরুয়ারি বাঙালির অপরিমেয় আত্মোৎসর্গে আত্মপরিচয় আবিষ্কারের প্রত্যয়দৃপ্ত একটি দিন। যে রক্তঝরা দিনটি ভাষা আন্দোলনের প্রোজ্জ্বল চেতনার স্মারক। আমাদের প্রাণের দীপ্ত জাগরণে এ দিন এখনো নতুন বোধ সঞ্চার করে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত করেছিল সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ অমর ভাষা শহীদ। ভাষা শহীদদের আত্মবলিদানের অগ্নিস্ফুলিঙ্গে সারা দেশের মানুষ দ্রোহ আর প্রতিরোধে জেগে উঠেছিলেন। ভাষা শহীদদের দেশপ্রেম ও ভাষাপ্রেমের ইতিহাস আজও আমাদের আত্মচেতনাকে জাগ্রত করে ভাষা,সংস্কৃতি,কৃষ্টির উত্তরাধিকার ও ঐতিহ্য রক্ষায় সংকল্পবদ্ধ করে তোলে। একুশের যে চেতনা এ দেশের মানুষের আত্মপরিচয় আবিষ্কারের পথ দেখিয়েছে, সে চেতনায় সমগ্র বাঙালিসত্তা উপলব্ধি করে আমি বাঙালি, বাংলা আমার মাতৃভাষা, আমি মায়ের ভাষায় কথা বলি। বাংলা ও বাঙালির আবহমান সংগ্রামে একুশের মৃন্ময় চেতনা বহমান থাকবে স্রোতস্বিনী নদীর মতো। তাই বাঙালির আবেগে-উচ্ছ্বাসে-ভাবনায় অমর একুশে অনিবার্য ভাবে উচ্চকিত।
বাঙালির কাছে একুশে মানেই সমস্ত সত্তা দিয়ে, অনুভ‚তি দিয়ে মায়ের মুখের মধুর ভাষা স্পর্শ করা। মায়ের ভাষায় কথা বলার জন্য ঢাকা শহরেই হয়েছিল সেই ভাষার লড়াই ফেরুয়ারির আগুন ঝরা রক্ত পিচ্ছিল রাজপথে , শোণিতে লেখা হয়েছিল বর্ণমালার এক অনন্য ইস্তেহার। পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রথম ষড়যন্ত্র রাষ্ট্রভাষা বাংলার বদলে পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা চলেছিল। পকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি চেয়েছিল একমাত্র উর্দু হবে রাষ্ট্রভাষা। বাংলার বদলে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা বানানোর হীন ষড়যন্ত্র বুঝে নিতে সময় লাগেনি আমাদের পূর্ব প্রজন্মের। তাঁরা সে দিন হয়ে উঠেছিলেন প্রতিটি বর্ণমালার যোগ্য পাহারাদার। মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বাঙালি সেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল।
জনসংখ্যার দিক থেকে বাঙালি ছিল পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাই তারা সেদিন এই অন্যায় সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি বরং কঠোর অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদমুখর হয়েছে। সংগ্রাম-আন্দোলন গড়ে তুলেছে, পুলিশের রাইফেল- লাঠির মার খেয়েছে, বুটের আঘাত সহ্য করেছে, টিয়ার গ্যাসের যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়েছে এবং জেল-জুলুমের শিকার হয়েছে। দুশো বছরের ইংরেজ শাসনের পদাংক অনুসরন করে পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা ধর্মের দোহাই দিয়ে এবং অস্ত্রের দম্ভ দেখিয়ে বাঙালিকে শাসন শোষণে নিয়ন্ত্রণ করতে প্রয়াস চালিয়েছে। বাঙালির জাতিসত্ত্বাকে মুছে দিতে চেয়েছে। বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধংস করে তাদের চিরতরে পদানত রাখতে চেয়েছে। কিন্তু বাংলার বীর সন্তানেরা সেটা করতে দেয়নি। বুকের রক্তে মায়ের ভাষার অধিকার প্রতিষ্টা করেছেন।
একুশ বাঙালিকে দিয়েছে শেকড়ের সন্ধান আর অমেয় সাহস। যে সাহসে বাহান্নোকে স্পর্শ করে স্পর্ধিত ভাষার সৌকর্যে রচিত হয়েছিল বাঙালির জাতিসত্তার অহংকারের ইতিহাস অধ্যায় একাত্তর। বাঙালির ইতিহাসে একুশ শুধু একটি সংখ্যা নয়, একটি তারিখ নয়। একুশের মধ্যে প্রোথিত হয়েছিল স্বপ্ন চেতনার বীজ। ১৯৫২-তে বাঙালির সম্মিলিত প্রতিরোধ ও আত্মবলিদানের মধ্য দিয়ে যে বীজটি রোপিত হয়েছিল বাংলাদেশের মাটিতে তারই ক্রমপরিণতিতে আমাদের স্বাধিকারের সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধ। বায়ান্নর ২১ ফেরুয়ারির আত্মত্যাগ ১৯৫৪, ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬ ও ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে এক নতুন প্রত্যয় ও প্রতীতী দান করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর নেতৃত্বে ৩০ লক্ষ শহীদ আর ২ লক্ষ মা-বোনের আত্মত্যাগে ১৯৭১ এ অর্জিত হয়েছিল আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা। কবির ভাষায়- একুশ আমার রক্তে বাজায় অস্থিরতার সুর/ বিপব জানি মহামহীরুহ একুশ তো অংকুর। আমরা পলবিত একুশের অঙ্কুরে। আমাদের যা কিছু অর্জন, যা কিছু গৌরব তা একুশের আদর্শে অর্জিত। একুশ কেবল বাংলা ভাষার লড়াই ছিল না, একুশ ছিল বাঙালির সার্বিক মুক্তির সংগ্রাম। বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির অস্তিত্ব রক্ষার সেই লড়াইয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল শিক্ষা, সমাজ ও অর্থনীতির লড়াইও। একুশের মধ্যে উপ্ত ছিল বাঙালির এগিয়ে যাওয়ার সংগ্রাম,এদেশের মানুষের সব রকম শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আকাক্সক্ষা। যখনই বাঙালি নির্মম আক্রমণের শিকার হয়েছে , একুশে হয়ে উঠেছে তখন প্রতিরোধের অগ্নিবীণা। কারণ প্রতিপক্ষ জানে, বাঙালির শেকড়ের নাম তার ভাষা আর ভাষার লড়াই, সেখান থেকেই বাঙালি দৃঢ় পায়ে এগিয়ে যায় ভাষা,সংস্কৃতির অজেয় শক্তিতে। পাকিস্তানিরা মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে গুঁড়িয়ে দিয়েছে শহিদ মিনার। কিন্তু শহিদ মিনার শুধু আমাদের কাছে ইঁট সিমেন্টের অবয়ব নয়। আমাদের প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে আছে এক একটি শহিদ মিনার। সেই মিনার কখনও ভেঙে ফেলা যায় না। তার বিনাশ নেই। অমর একুশ চিরকাল থাকবে বাঙালির হৃদয়ে। একুশের মধ্যে যে জাতীয় চেতনা ও আবেগ আছে, তা প্রচন্ড শক্তি হিসেবে এখনো রয়েছে। আমাদের অস্থিমজ্জায় ভাষায় ও সংস্কৃতিতে এবং ইতিহাসে যে চেতনা গাঢ় হয়ে মিশে আছে, তাকে ধ্বংস করা অত সহজ নয়। একুশের মিছিল, একুশের স্লোগান, একুশের গান সেই অপশক্তিকে বারবার রুখছে, এখনো রুখবে। আমাদের সামগ্রিক চেতনায় ভাষা আন্দোলনের প্রভাব কেবল সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই পড়েনি, একুশের মহিমা বাংলা সাহিত্যেও বারবার উচ্চকিত হয়ে আসছে। একুশের চেতনা আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে ও এক গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের মতোই সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় প্রেক্ষাপট হিসেবে ভাষা আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। কবিতার কাব্যিক ব্যঞ্জনায়, গল্পের শাব্দিক ভাঁজে, গবেষণার আগ্রহী বিষয় হিসেবে, নাটকের সংলাপে বায়ান্নর একুশ এখনও প্রাণময়, চেতনাদীপ্ত। সেই দিনই রচিত হয়েছিল মাহবুব-উল-আলম চৌধূরীর দীর্ঘ কবিতা কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি। এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে/রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচ‚ড়ার নিচে/যেখানে আগুনের ফুলকীর মতো/এখানে-ওখানে জ্বলছে রক্তের আত্মনা, /সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি।…/যারা আমার অসংখ্য ভাই বোনকে হত্যা করেছে, /যারা আমার হাজার বছরের ঐতিহ্যময় ভাষায় অভ্যস্ত/মাতৃ সম্বোধনকে কেড়ে নিতে গিয়ে/আমার এইসব ভাই বোনদের হত্যা করেছে/আমি তাদের ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি…। কবিতার এই বজ্রশাব্দিক উচ্চারণে কবি কবিতার মাধ্যমেই সমগ্র বাঙালি জাতির ক্ষোভকে প্রকাশ করেছিল সাহসিক চিত্রকল্প ও ভাষাশৈলীর বিন্যাসে। এ কবিতা সাড়া জাগিয়েছিল একুশের সেরা প্রতিবাদী কবিতা হিসেবে। আবদুল গাফফার চৌধুরী ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লিখেছিলেন আমার ভাইয়ের রক্তের রাঙানো একুশে ফেরুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি কবিতাটি। যা প্রথমে আবদুল লতিফ, পরবর্তীতে আলতাফ মাহমুদের সুরে গান হয়ে ওঠে। প্রতিটি একুশে ফেরুয়ারিতে এই গানটি অনুরণিত হয় বারবার। যে গানের কথা ও সুর আমাদের বিহবল করে এবং একুশের শহিদদের বাংলা ভাষাপ্রীতির কথা ও ত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মাতৃভাষা, মাতৃভ‚মির অস্তিত্ব চেতনা বাঙালির সংগ্রামী ইতিহাসের প্রথম পাঠ। বাংলা ভাষা তথা বাংলা বর্ণমালা বাঙালির সত্তায় সগৌরবে বিরাজমান। কবি শামসুর রাহমান বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা কবিতায় আবেগ উত্থিত শব্দমালায় লিখেছেন- নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে পতাকা উড়িয়ে আছো আমার সত্তায়।/মমতা নামের পূত প্রদেশের শ্যামলিমা তোমাকে নিবিড় ঘিরে রয় সর্বদাই। আটচলিশ থেকে ঊনসত্তর বাংলা ভাষা ও বর্ণমালার বিরুদ্ধে অনেক ষড়যন্ত্র, অনেক চক্রান্ত হয়েছে। কবি বেদনার্ত হয়ে লিখেছিলেন- তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার? /উনিশ শো বায়ান্নোর দারুণ রক্তিম পু®পাঞ্জলি বুকে নিয়ে আছো সগৌরবে মহিয়সী।/সে ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হলে আমার সত্তার দিকে/কতো নোংরা হাতের হিংস তা ধেয়ে আসে।/এখন তোমাকে নিয়ে খেঙরার নোংরামি।/এখন তোমাকে ঘিরে খিস্তি-খেউরের পৌষ মাস! /তোমার মুখের দিকে আজ আর যায় না তাকানো/ বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা!!
কবি আবু জাফর ওবায়দুলাহ মাগো ওরা বলে কবিতায় এক দুখিনী মায়ের চিত্রকল্প এঁকেছেন।-চিঠিটা তার পকেটে ছিলো/ ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা/ মাগো, ওরা বলে/ সবার কথা কেড়ে নেবে/ তাই কি হয়?/ তাইতো আমার দেরি হচ্ছে।/ তোমার জন্য কথার ঝুড়ি নিয়ে/ তবেই না বাড়ি ফিরবো। মায়ের আদরের সেই খোকাটির আর বাড়ি ফেরা হয় না। অথচ ঘরে প্রতীক্ষারত মা ছেলের জন্য সখের উড়কি ধানের মুড়কি ভাজে, নারকেলের চিড়ে কোটে। একসময় কুমড়ো ফুল শুকিয়ে যায়, ঝরে পড়ে কিন্তু খোকা ছুটি পায় না। কবি আবু জাফর ওবায়দুলাহ এই কবিতায় অত্যন্ত কোমল হাতে, ঝাপসা চোখে ভাষা আন্দোলনে শহীদ ছেলের জন্য মায়ের প্রতীক্ষা যে কত তীব্র, কত কষ্টের তা বিবৃত করেছেন। মাগো ওরা বলে কবিতাটিকে নির্দ্বিধায় ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত অন্যতম সেরা কবিতা হিসেবে বলা যায়। একুশের প্রেক্ষাপট নিয়ে রচিত কবিতায় কখনও ফুটে উঠেছে সন্তানহারা মায়ের নির্মম প্রতীক্ষা, কখনও কবিতায় স্থান পেয়েছে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণার অক্ষরে প্রতিবাদ। একুশের কবিতাগুলো দেশের ঐতিহ্যগত চেতনারই ফসল। এসব কবিতার প্রতিটি লাইন, প্রতিটি শব্দ পৃথিবীবাসীকে জানিয়ে দেয় বাঙালিরা তাদের মায়ের ভাষাকে প্রাণের চেয়ে ও বেশি ভালবাসে। কবিতার মতো বিপুল না হলেও বাংলাদেশের উপন্যাসেও ভাষা-আন্দোলনের বহুমাত্রিক প্রতিফলন ঘটেছে। ভাষা-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে লেখা উপন্যাসসমূহে মূলত শিল্পিত হয়েছে সংঘবদ্ধ বাঙালির প্রতিবাদী চেতনা। একুশকে নিয়ে প্রথম পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস রচিয়তা জহির রায়হান। তাঁর ‘আরেক ফালগুন’ উপন্যাস সম্পর্কে বলেন-এদেশের মানুষের মুখের ভাষাকে কেড়ে নেবার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে যাঁরা সংগ্রাম করেছেন, যাঁরা পুলিশের লাঠি, গুলি আর বেয়োনেটকে উপেক্ষা করে মিছিলে এগিয়ে এসেছেন… যাঁরা স্বৈরাচারের বিষাক্ত ছোবলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জনতার আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন….. তাঁদের উদ্দেশ্যে উপন্যাসটি উৎসর্গীত হয়েছে।’ সাহিত্য-সংস্কৃতিতে একুশের সৃজনশীল কবি, সাহিত্যিক, ঔপন্যাসিকদের লেখার ভেতর একুশের চেতনা কাজ করেছে প্রগাঢ়ভাবে। পরবর্তীকালে এ চেতনা সমস্ত বাঙালির জীবনকে করেছে উচ্চকিত, আন্দোলিত।
স্বাধীনতা লাভের পরও একুশ বিভিন্ন সংকট-সন্ধিক্ষণে, দুঃসময়ের কালে জাতিকে জাগ্রত করতে চেতনাদায়ী হিসেবে কাজ করেছে। একুশের বইমেলা সে ধরনের একটি উপলক্ষ, যা বাঙালি জাতিকে এক অনবদ্য ঐক্যে সৃজনশীল সাংস্কৃতিক আবহে উদ্বুদ্ধ করে। আমাদের ভাষা-প্রেমের প্রাণের মেলা অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বাঙালির আত্মপরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দু এই প্রাণের মেলা। বইমেলা বাঙালির চেতনা ও আবেগের সঙ্গে মিশে আছে। এ মেলার জন্য বইপ্রেমিকরা সারা বছর উন্মুখ থাকেন। লেখক-প্রকাশক পাঠকদের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিকে আরো দৃঢ় করে এ বইমেলা। অমর একুশে গ্রন্থমেলায় দেশের সব শ্রেণীর লেখক-পাঠকের মিলনমেলা বসে। পরস্পরের মধ্যে মেলবন্ধন তৈরি করে। একে অন্যের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জেগে ওঠে। ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভাষাসংস্কৃতির প্রতি আবেগ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ হয়ে একুশে বইমেলা বাঙালির সার্বজনীন উৎসবে রূপ নিয়েছে।
সময়ের বিবর্তনে একুশের দীপ্তিময় দ্যুতি দেশের সীমানা অতিক্রম করে আজ দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এর স্বীকৃতি পেয়েছে। একুশের শহিদেরা হয়ে উঠেছেন বিশ্বের প্রতিটি বর্ণমালার অতন্দ্র প্রহরী এবং বাংলাদেশ পেয়েছে এক অনন্য স্বীকৃতি। সে কারণেই আমাদের লড়াইয়ের মাধ্যমে মোকাবেলা করতে হবে সব অপশক্তির ঘৃণ্য কুটচাল। আর সেই লড়াইয়ে একুশ আছে, থাকবে আমাদের শেকড় আর সাহস হয়েই।
প্রতি বছর কুড়ি ফেরুয়ারির মধ্য রাত থেকে শুরু হয় আমাদের পথ চলা শহিদ মিনারের পাদদেশে, যেখানে ঘুমিয়ে আছেন বীর শহিদ রফিক, জব্বার, বরকত, সালাম-সহ আরও অনেকে। এক অমোঘ এবং স্বতঃস্ফ‚র্ত মিছিল পায়ে পায়ে শহিদ মিনারের দিকে ফালগুনের রোদ উপেক্ষা করে মানুষ হেঁটে চলে অবিরাম। লাখ লাখ মানুষ সে দিনও মিছিল করে হেঁটে এসেছিলেন, জনসমুদ্রে লেগেছিল জোয়ার, সকলের গতিপথ একই দিকে। এখনো একের পর এক মানুষের ঢেউ এসে ভাসিয়ে দেয় রাজপথ, বসন্তের চড়া রোদ হার মানছে মানুষগুলোর হৃদয়ের উষ্ণতার কাছে। ভাষা শহিদ স্মারক সৌধে অগুনতি মানুষ শ্রদ্ধায় অবনত হচ্ছে উত্তরপুরুষের কাছে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ এবং রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বৈষম্য ভুলে মানুষ আজ ও এক সঙ্গে পায়ে পায়ে হেঁটে চলেছেন জাতিসত্তার আলোকস্তম্ভ শহিদ মিনারের দিকে।
রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মাতৃভাষা বাংলার স্বীকৃতি এবং এর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে যে আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছিল, তার মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের বাঙালির মধ্যে এক নতুন চেতনা ও মূল্যবোধ জাগ্রত হয়। বায়ান্নর একুশে ফেরুয়ারিতে যে প্রত্যয় অর্জিত হয়েছিল , জাতি হিসেবে এ দেশ ও সমাজের সার্বিক সংস্কৃতি , কৃষ্টি, ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখতে প্রয়োজন সর্বস্তরে প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষার ব্যবহার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা। প্রত্যেক জাতির ভাষা-কৃষ্টির মধ্যে নিহিত রয়েছে জাতিসত্তার ভিত্তিমূল। আমাদের এ প্রাণপ্রিয় মাতৃভাষাকে ক্ষত বিক্ষত করার উন্মত্ত নেশায় যখন পাকিস্তানিরা আক্রমণ চালিয়েছে, ঠিক তখনই বাংলার দামাল ছাত্র যুবা রুখে দাঁড়িয়েছে। সেই থেকে বাঙালি স্বপ্ন দেখেছে এক সমৃদ্ধ স্বাধীন দেশের। স্বপ্ন দেখেছে মাতৃভাষায় আত্মপ্রকাশের অমল বাসনার। কিন্তু এখনও সে স্বপ্ন পূরণ হয়নি। ভাষা আন্দোলনের পর কেটে গেছে বহুকাল। কিন্তু আজও বাঙালি তার প্রিয় মাতৃভাষার সর্বস্তরে ব্যবহারের সফল বাস্তবায়ন দেখেনি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার সর্বস্তরে মাতৃভাষার ব্যবহার নেই। এক শ্রেণির উচ্চবিত্তর মধ্যে মাতৃভাষার প্রতি একধরনের অবজ্ঞা পরিলক্ষিত হয়। নিজেদের সন্তান তারা পড়তে পাঠান বিদেশে। দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি তাদের বিন্দুমাত্র আস্থা নেই। মাতৃভাষার প্রতি পরিপূর্ণ চর্চার ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য সরকারি উদ্যোগ নেয়া উচিত। নইলে ভাষার বিকাশও হবে বাধাগ্রস্ত। আমাদের সংস্কৃতিও মুখ থুবরে পড়বে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এখনই সচেতন হওয়া প্রয়োজন। তাই বাংলা ভাষাকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ এবং ব্যবহারের অন্য কোনো বিকল্প আজ আর আমাদের সম্মুখে নেই। বাংলা ভাষা প্রচলন এখন আর কোনো একপক্ষীয় দাবি বা কর্মসূচি নয়, বাংলা ভাষা এবং এর সাহিত্য ও সংস্কৃতির
সমৃদ্ধকরণ সবার সম্মিলিত প্রয়াস-প্রচেষ্টার প্রতিফলনও। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা এবং বাংলা ভাষা চর্চার মাধ্যমে উন্নত জাতি হিসাবে নিজেদের দাঁড় করাতে হবে। তাহলে শহীদদের প্রতি যথার্থ সম্মান জানানো হবে। ভাষা শহীদদের অমর অক্ষয় কীর্তিতে ভাষা আন্দোলন বাঙালির জীবন্ত ইতিহাস হয়ে মিশে থাকুক যাপিত জীবনে।