বাঙালির বাতিঘর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

68

মুহাম্মদ এনামুল হক মিঠু

আজ ২৮ সেপ্টেম্বর। গণতন্ত্রের মানসকন্যা, মানবতার মা, এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপষহীন, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সফল সভানেত্রী বন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৪ তম জন্মদিন । শেখ হাসিনা ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের মধুমতি নদী বিধৌত টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছার জ্যেষ্ঠ সন্তান এবং বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সভাপতি।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রবক্তা স্বপ্নদর্শী এই নেত্রী ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণের পর থেকে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে দলকে সুসংগঠিত করেন এবং ১৯৯৬ সালে প্রথম, ২০০৮ সালে দ্বিতীয় এবং ২০১৪ সালেতৃতীয় এবং ২০১৮ সালে চতুর্থ বারের মত নির্বাচনে জয়লাভ করে দলকে দেশের নেতৃত্বের আসনে বসাতে সক্ষম হন।
তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। স্থায়ী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, খাদ্যে স্বনির্ভরতা, নারীর ক্ষমতায়ন, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রামীণ অবকাঠামো, যোগাযোগ, জ্বালানী ও বিদ্যুৎ, বাণিজ্য, আইসিটি এবংএসএমই খাতে এসেছে ব্যাপক সাফল্য। এছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার, পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি সম্পাদন, একুশে ফেব্রæয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতিসহ জাতীয় জীবনের বহুক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছেন তিনি।
দাদা শেখ লুৎফর রহমান ও দাদি সাহেরা খাতুনের অতিআদরের নাতনি শেখ হাসিনার শৈশব- কৈশোর কেটেছে মধুমতি নদীর তীরবর্তী গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায়। শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রেহানা এবং শেখ রাসেলসহ তারা পাঁচ ভাই-বোন। বর্তমানে শেখ হাসিনা ও রেহানা ছাড়া কেউই জীবিত নেই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে পিতা বঙ্গবন্ধু এবং মাতা ফজিলাতুন্নেছাসহ সবাই ঘাতকদের নির্মম বুলেটে নিহত হন।
শেখ হাসিনার শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল টুঙ্গিপাড়া। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে পরিবারকে ঢাকায় নিয়ে চলেআসেন। তখন পুরনো ঢাকার রজনী বোস লেনে ভাড়া বাসায় ওঠেন তারা। বঙ্গবন্ধু যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সদস্য হলে সপরিবারে ৩ নম্বর মিন্টু রোডের বাসায় তারা বসবাস শুরু করেন। শেখহাসিনাকে ঢাকা শহরে টিকাটুলির নারী শিক্ষা মন্দিরে ভর্তি করা হয়। এখন এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি শেরেবাংলা গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ নামে খ্যাত। শুরু হয় তার শহর বাসের পালা।
তিনি ১৯৬৫ সালে আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, ১৯৬৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজ (বর্তমান বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা মহাবিদ্যালয়) থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেন। ওই বছরেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েবাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্সে ভর্তি হন এবং ১৯৭৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। শেখ হাসিনা ইন্টারমিডিয়েট গার্লসকলেজে পড়ার সময় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সদস্য এবং রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছাত্রলীগের নেত্রী হিসেবে তিনি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন এবং ৬-দফা আন্দোলনেসক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু উত্থাপিত ৬-দফা দাবিতে পূর্ববাংলায় এক অভূতপূর্ব জাতীয় জাগরণ সৃষ্টি হয়। শাসকগোষ্ঠী ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। শুরু হয় প্রচÐ দমন-নির্যাতন। আটক থাকা অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। তার জীবন ওপরিবারের ওপর নেমে আসে গভীর বিপদাশংকা ও দুঃসহ দুঃখ-যন্ত্রণা। এই ঝড়ো দিনগুলোতেই বঙ্গবন্ধুর আগ্রহে ১৯৬৮সালে পরমাণু বিজ্ঞানী ড.ওয়াজেদ মিয়ার সাথে শেখ হাসিনার বিয়ে হয়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের করাচিতে নিয়ে যাওয়ার পর গোটা পরিবারকে ঢাকায় ভিন্ন এক বাড়িতে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই শেখহাসিনা গৃহবন্দী অবস্থায় তার প্রথম সন্তান ‘জয়’-এর মা হন।১৯৭২ সালের ৯ ডিসেম্বর কন্যা সন্তান পুতুলের জন্ম হয়।
১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হবার আগে ছোট বোনশেখ রেহানাসহ শেখ হাসিনা ইউরোপ যান। সেখানেঅবস্থানকালে তিনি সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নিহত হবার খবরপান। তাৎক্ষণিকভাবে দেশে ফেরার কোনো পরিবেশ না থাকায়তিনি ইউরোপ ছেড়ে স্বামী-সন্তানসহ ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন।
শেখ হাসিনার পরবর্তী ইতিহাস একবিংশ শতকের অভিযাত্রায় তিনি কীভাবে বাঙালি জাতির কাÐারি হয়েছেন তার ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখতেন সেই স্বপ্ন রূপায়নের দায়িত্ব নিয়ে বাঙালি জাতির আলোর দিশারী হওয়ার ইতিহাস। পনেরো আগস্টের শোকাবহ ঘটনা শেখ হাসিনার জীবনে অনেক বড় বেদনাদায়ক ঘটনা, এক গভীরতম ট্রাজেডি। এইশোক তাকে শক্তিশালী দায়িত্বশীল করেছে দেশের জন্য মানুষের জন্য কাজ করে যেতে। তিনি কাজের প্রতি যথেষ্ট আন্তরিক। বিরোধীদলের নেত্রী হিসেবে দেখেছি তার আপষহীনতা, সংগ্রামে-আন্দোলনে দূরদর্শী। ১৯৮১ সালের ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রæয়ারি অনুষ্ঠিত আওয়ামীলীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে তাকে দলের সভাপতি নির্বাচিতকরা হয়। আর ঐ বছরেরই ১৭ মে দীর্ঘ ৬ বছর প্রবাস জীবনেরঅবসান ঘটিয়ে মাতৃভূমি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি তিনটি আসন থেকে নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালের ঐতিহাসিক গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনের পরে তিনি পঞ্চম জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হন।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে সরকার গঠন করে এবং সে বছরের ২৩ জুন দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার পালনকালেও তাকে দেখেছি যথেষ্ট সচেতন থাকতে, ভালো-মন্দ ঘটনা যাই ঘটুক শেখ হাসিনা অবশ্যই জানতে পারেন, জানতে পারলে একটা সুরাহা তিনি নিজেই বেরকরে তার সমাধান না হওয়া পর্যন্তু মনিটরিং করে থাকেন।নিজেই সমাধান করার চেষ্টা করে
থাকেন এখানেই তার একনিষ্ঠতার পরিচয় পাওয়া যায়। তার কাছে দেশ ও দেশেরমানুষ হল প্রধান কথা। এর বাইরে তিনি যেতে চান না, যেতে পারেন না।
২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি সপ্তম জাতীয় সংসদে বিরোধীদলের নেতা নির্বাচিত হন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড নিক্ষেপ করে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়।তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলেও ওই হামলায় ২৪ জন নিহতএবং পাঁচশ’ নেতা-কর্মী আহত হন। এভাবে পর্যাক্রমে তাঁকে ১৯ বার হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তুু নেত্রীকে তাঁর কর্মে গুণে, মানুষের দোয়ায় মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এখনো বাঁচিয়ে রেখেছেন। এ জন্য আল্লাহ কাছে হাজার শুকরিয়া জানাচ্ছি।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন নিয়ে বিশাল বিজয় অর্জনকরে। এই বিজয়ের মধ্যদিয়ে শেখ হাসিনা দ্বিতীয় বারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
পরবর্তীতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি তৃতীয়বার এবং ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে চতুর্থবারের মত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন। অত্যন্ত বিনয়ী এবং শুদ্ধতম বাঙালি হয়ে ওঠার পেছনেও তাদের একটা পারিবারিক মূল্যবোধ আছে সত্য, তারপরও পিতা-মাতার প্রভাব শেখ হাসিনাকে একজন আদর্শ, মমতাময়ী মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছে। তারুণ্যের ছায়ায় দেখা শেখ হাসিনা আজ অভিজ্ঞতায় অনেক সমৃদ্ধ। অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি অনেক শক্তিশালী। বুদ্ধিমত্তা আগের মতই প্রখর, সহনশীলতা ও দৃঢ়তা, ধৈর্য, যেন তার চরিত্রগত ধর্ম। ভালোবাসায় ও সহমর্মীতায় তিনি এখনও বন্ধুদের কাছে প্রিয় এবং সকলের অতি আপনজন। তাই আজ আমাদের কাছে গর্বের বিষয় শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রতীক হিসেবে জনগণের কাছে নন্দিত। বিডিআর বিদ্রোহ দমনকালে তার ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা আমার মনে আছে। তার রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য, জ্ঞান, আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হয়েছে এটা আমাদের কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি। বাঙালি হিসেবে, একজন নারী হয়েও তিনি আমাদের মাথা উঁচু করেছেন যা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয়নি।
শেখ হাসিনা বাঙালি জাতির কাÐারী হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন তার মেধা, সাহস ও সততার কারণে, বর্তমান বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রতীক বলা হয় তাঁকে। আমাদের স্বীকার করতেই হবে শেখ হাসিনার শাসনামলে তার দৃষ্টি তৃণমূল থেকেই ওপরে উঠেছে।
তিনি তরুণদের কাছে প্রযুক্তি ব্যবহারের অবাধ সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করেছেন। শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাসোপযোগী করার উদ্যোগ নিয়েছেন। যেখানে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মসংস্থান ছাড়াও সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের বিরাট সম্ভাবনা থাকবে। পরিশেষে নেত্রীর জন্মদিনে শুভেচ্ছসহ দীর্ঘায়ু কামনা করছি।

লেখক : কলামিস্ট