বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ

13

জামাল উদ্দিন


বৈশাখ বাংলা সনের প্রথম মাস। এই মাসের প্রথম দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন। তাই এই দিনকে উৎসবে আনন্দে বরণ করে নেয় বাঙ্গালি। এটি বাঙালির একটি সর্বজনীন লোকউৎসব। অতীতের ভুলত্রæটি ও ব্যর্থতার গøানি ভুলে নতুন করে সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় উদযাপিত হয় নববর্ষ। পহেলা বৈশাখ নিয়ে কবি সাহিত্যিকদের আগ্রহের কমতি নেই।
তাইতো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন,
‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর,
তোর সব জয়ধ্বনি কর
ওই নূতনের কেতন ওড়ে,
কালবৈশাখী ঝড়
তোর সব জয়ধ্বনি কর’।
কবির ডাকে সাড়া দিয়ে দোকানে দোকানে শুরু হয়েছে লাল-সাদা পোশাকের সমাহার। পথে পথে ফেরিওয়ালারা বিক্রি করছেন ডুগডুগি, নলখাগড়ার বাঁশি, বাঁশ-বেতের ঝুড়ি-মোড়া। ওদিকে চারুকলায় তো রীতিমতো সাজ সাজ রব চলছে আরও আগ থেকেই। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যপ্ত সারাবাংলা ভেসে ওঠছে আনন্দের উচ্ছাসে। ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি-পেশা, বয়স নির্বিশেষ সব মানুষ প্রস্তুত হচ্ছে শামিল হতে বৈশাখী উৎসবে। সব ভেদাভেদ ভুলে কায়মনে বাঙালি হওয়ার প্রেরণায় দীপ্ত বাঙালি বরণ করবে ১৪২৩ বঙ্গাব্দকে।
পহেলা বৈশাখ উদযাপন কিংবা বাঙালিদের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বাঙালির সর্বজনীন অনুষ্ঠানের অন্যতম। গ্রামীণ কৃষক সমাজের ঘরে ফসল তোলা আর খাজনা আদায়ের মধ্যে সামঞ্জস্য আনয়নের জন্য এই বঙ্গাব্দের শুরু। পহেলা বৈশাখে কৃষকরা সরকারকে খাজনা দিয়ে মিষ্টিমুখ করে বাড়িতে ফিরতেন। আসুন জেনে নেই পহেলা বৈশাখের আদ্যোপান্ত
বাংলা সনের প্রবর্তন : হিন্দু সৌরপঞ্জিকার আমলে নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখে উৎসব পালন করা হতো। তবে সে উৎসব ছিল ঋতুধর্মীয় উৎসব। মূলত তখনকার কৃষি-ভিত্তিক সমাজেই নিহিত ছিল এই উৎসবের তাৎপর্য। বঙ্গ, নেপাল, ত্রিপুরা, আসাম, উড়িষ্যা, কেরালা, মনিপুর, পাঞ্জাব, তামিলনাড়ুর অধিবাসীরা পালন করত এ উৎসব। পালন করত তাদের নিজস্ব সংস্কৃতির এক অপরিহার্য অংশ হিসেবেই। ভারতবর্ষের মোগল সম্রাটরা কৃষি পণ্যের খাজনা আদায় করতেন হিজরি পঞ্জিকার দিন-তারিখ অনুযায়ী। কিন্তু হিজরি সন নির্ভর করে সম্পূর্ণ চাঁদের উপর। ফলে খাজনা আদায় করা নিয়ে প্রচুর বিপত্তি হতে শুরু করল। তৎকালীন মোগল সম্রাট আকবর সুষ্ঠুভাবে খাজনা আদায়ের লক্ষ্যে এক নতুন পঞ্জিকা প্রবর্তন করেন। এই পঞ্জিকাটির সনই বাংলা সন হিসেবে পরিচিত।
সম্রাট আকবরের আদেশক্রমে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহ উল্লাহ সিরাজী হিন্দু সৌর সন এবং আরবি হিজরি সনের সমন্বয় করে সম্পূর্ণ নতুন এই বাংলা সনের পঞ্জিকা তৈরি করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ (মতান্তরে ১১ মার্চ) থেকেই এই নতুন প্রবর্তিত সন গণনা শুরু হয়। তবে সম্রাট আকবরের সিংহাসন-আরোহণের বা অভিষেকের স্মরণে ধরা হয়, তার অভিষেক থেকেই এই বাংলা সন গণনা শুরু হয়েছে। অর্থাৎ, ৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬ ইংরেজি সন থেকেই। উল্লেখ্য, সর্বপ্রথম এই বাংলা সনের নামকরন করা হয়েছিল ‘ফসলি সন’। পরে কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই ‘ফসলি সন’ই ‘বঙ্গাব্দ’ বা ‘বাংলা সন’ হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করে।
বাংলাদেশের পহেলা বৈশাখ: আমাদের দেশে পহেলা বৈশাখের সবচেয়ে বড় উৎসব হয় ঢাকা শহরে। আর সে উৎসবের প্রাণকেন্দ্র বলা যেতে পারে রমনা বটমূলে আয়োজিত ছায়াানটের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে। ছায়ানটের শিল্পীরা এ দিন খুব ভোরবেলা থেকেই সম্মিলিত কণ্ঠে বৈশাখী আগমনী গানের মাধ্যমে নতুন বছরের সূর্যকে স্বাগত জানান। এই উৎসবটিরও ইতিহাস আছে। পাকিস্তানি শাসনামলে শাসকরা বাঙালি সংস্কৃতিকে দমিয়ে রাখার জন্য অনেক কিছুই করেছিল। একবার তো ওরা রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানের উপরই নিষেধাজ্ঞা জারি করে বসে। এর প্রতিবাদেই ছায়ানট ১৩৭৫ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে রমনা পার্কে পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনের আয়োজন করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ গানের মধ্যে দিয়ে স্বাগত জানানো হয় বৈশাখকে। সেই ধারা আজও অব্যাহত আছে। আর ১৯৭২ সালে এটিকে জাতীয় উৎসব হিসেবেই পালিত হয়ে আসছে।
ঢাকার পহেলা বৈশাখের জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের আরেক আকর্ষণ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজিত হয় ১৯৮৯ সালে। এখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযয়ের চারুকলা অনুষদ তখন ছিল চারুকলা ইনস্টিটিউট। সেই চারুকলা ইসস্টিটিউটের উদ্যোগে ও আয়োজনেই পহেলা বৈশাখের সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়। তারপর শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে আবার তা ফিরে আসে চারুকলায়। আর সে শোভাযাত্রায় রং-বেরঙের মুখোশে আর বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিমূর্তি দিয়ে একেক বছর তুলে ধরা হয় আবহমান বাংলার সংস্কৃতি। একেক বছর এই শোভাযাত্রার জন্য একেক থিম বেছে নেওয়া হয়। কোনো বছর থিম রাখা হয় হাতি, কোনো বছর কুমির, কোনো বছর বাঘ। আবার কখনও এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে প্রতিবাদও জানানো হয়।
হালখাতা থেকে পহেলা বৈশাখ : সম্রাট আকবরের সময় থেকে ‘পহেলা বৈশাখ’ উদযাপন শুরু হয়। কিন্তু তখনকার পহেলা বৈশাখ উদযাপন এখনকার মতো ছিল না। তখনকার পহেলা বৈশাখ পালনে ভিন্নতা ছিল। যেমন, বছর শুরুর আগের দিনে, অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যেই সকলকে সকল প্রকার খাজনা-মাশুল-শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। আর পরের দিন, অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা, অর্থাৎ জমিদাররা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। খাজনা পরিশোধ করা উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবেরও আয়োজন করা হতো। আগে পহেলা বৈশাখের এই দিনে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ‘হালখাতা’ খোলা হতো। সে দিন প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় দেনা-পাওনার হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করা হতো। অর্থাৎ আগের বছরের হিসাবের পাট চুকিয়ে নতুন হিসাব শুরু করা হতো। নতুন হিসাবের খাতা খুলে এই হিসাব হালনাগাদ করাকেই বলা হতো হালখাতা। হালখাতার দিনে দোকানিরা ক্রেতাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকেন। এত বছর পরে আজও কিন্তু এই প্রথাটি অনেকাংশে প্রচলিত রয়েছে। বিশেষ করে গ্রামের দোকানদাররা ক্রেতাদের এখনও পহেলা বৈশাখে মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করেন। ১৯১৭ সালের উৎসবটি একটু বিশেষভাবেই উদযাপন করা হয়েছিল। সে বারে অবশ্য একটা আলাদা উদ্দেশ্যও ছিল প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটিশদের বিজয় কামনায়। তবে পরবর্তী সময়ে সে উদ্দীপনা আর ছিল না। পরে ১৯৬৭ সালে আবার জাঁকজমকের সঙ্গে পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়।
অন্যান্য দেশে পহেলা বৈশাখ : বাংলাদেশ এবং ভারত ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, সুইডেনসহ বিশ্বের আরো নানান দেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হয়ে থাকে।
অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে যেমন: সিডনি, মেলবোর্ন, ক্যানবেরাতে বৈশাখী মেলার মাধ্যমে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয়। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নাচ-গান-ফ্যাশন শো-খাবারের মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতির এ ধারাকে আনন্দময় করে তোলে। অস্ট্রেলিায়র সিডনিতে সর্ববৃহৎ বৈশাখী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। আগে বার্নউড বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হলেও ২০০৬ সাল থেকে সিডনি অলিম্পিক পার্কে মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মেলায় বিপুল পরিমাণ লোকের সমাগম ঘটে এবং প্রবাসী বাঙালিদের জন্য এটি একটি আনন্দঘন দিন। ইংল্যান্ডে অবস্থানকারী প্রবাসী বাঙালিরা স্ট্রিট ফেস্টিভ্যাল (পথ উৎসব) পালন করে। এই উৎসবটি লন্ডনে করা হয়। ইউরোপে অনুষ্ঠিত সর্ববৃহৎ এশীয় উৎসব এটি এবং বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া সর্ববৃহৎ বাঙালি উৎসব।
লেখক : ইতিহাস গবেষক