দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ‘৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলা পড়তে পারে না’ বলে ইউনেস্কো যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। একইসঙ্গে মন্ত্রণালয়ের দাবি, দেশে এখন ৬৫ শতাংশেরও বেশি শিক্ষার্থী বাংলা পড়তে পারে। ২০২০ সালে শতভাগ শিক্ষার্থী বাংলা পড়তে পারবে বলেও মন্ত্রণালয় দাবি করে। তবে, শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকারের পদক্ষেপ যে ধীর গতিতে এগুচ্ছে, তাতে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) যে টার্গেট, তা অর্জনে ঝুঁকি রয়েছে। আর মুজিববর্ষেও এই হার শতভাগ অর্জন করা বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের উদ্যোগকে বেগবান করারও পরামর্শ দেন শিক্ষাবিদরা।
উল্লেখ্য, ইউনেস্কোর জরিপে বলা হয়েছিল ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলা পারে না। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর থেকে ২০১৫ সালে প্রকাশিত ‘ন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট’ (এনএসএ)-এ বলা হয়েছে- তৃতীয় শ্রেণির ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থী শ্রেণি মান অনুযায়ী বাংলা পড়তে পারে না।
এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আকরাম-আল-হোসেন বলেন, ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলা পড়তে পারে না- এই চিত্র বাংলাদেশের কোথাও আর নেই। চিত্র পুরো পাল্টে গেছে। আর মুজিববর্ষ অর্থাৎ ২০২০ সাল শতভাগ শিক্ষার্থী বাংলা পড়তে পারবে, এটা আমাদের চ্যালেঞ্জ’। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালে প্রকাশিত ন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট (এনএসএ)-এর পর বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৬৫ শতাংশ শিশু বাংলা পড়তে পারে না। বাংলা ‘পঠন-পাঠনে’ প্রাথমিকে শতভাগ সক্ষমতা অর্জনের পথে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচর্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য প্রথমে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন করতে হবে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ভালো শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। আর ‘মুজিববর্ষে’ যদি শতভাগ শিক্ষার্থীকে টার্গেটে আনতে হয়, তাহলে দ্রæত প্রাথমিক শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। শিক্ষক হিসেবে তাদের মানোন্নয়ন করতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার প্রতি আকৃষ্ট করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবীদের নিয়োগ দিতে হবে’।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযান (ক্যাম্পি)-র উপ-পরিচালক কে এম এনামুল হক বলেন, ‘২০১১, ২০১৩ ও ২০১৫ সালের ন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্টে আমরা দেখেছি, বাংলা ও গণিতে পারফরমেন্স গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে কম। এসডিজি অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে এই সরকারের বর্তমান উদ্যোগকে আরও বেগবান করতে হবে। বাংলাদেশকে চিন্তা করতে হবে লার্জ স্কেল অ্যাসেসেমেন্টের মূল্যায়নে অংশ নেবে। ভালো ফল করবে। এ ধরনের কার্যক্রমে অংশ নিতে ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে, যদি আমরা এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চাই’।
এদিকে, সারাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে রাজধানীর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান অপেক্ষাকৃত দুর্বল। কারণ, সরকারি প্রাথমিকে উন্নত পরিবারের সন্তানরা লেখাপাড়া করে না। হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া সরকারি প্রাথমিকে সন্তানকে দিতেই চান না অধিকাংশ অভিভাবক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজধানীর হাজারীবাগ বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যায়ের প্রধান শিক্ষক এস এম ছায়িদ উল্লাহ বলেন, ‘রাজধানীতে এখন আর আগের অবস্থা নেই। আমার বিদ্যালয়েই মাত্র ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলা ভালোভাবে পড়তে পারে না। এর মধ্যে ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী শিক্ষকদের সহায়তায় পড়তে পারে’।
বিশেষজ্ঞরা জানান, সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে এই পরিস্থিতি উত্তোরণে। তবে শিক্ষা ও সহকারী শিক্ষা অফিসারদের প্রশাসনিক কাজের পাশাপাশি একাডেমিক সুপারভিশনে মনোযোগী হতে হবে। প্রতি শ্রেণিতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সংযোগ ঘণ্টা বাড়াতে হবে। শিক্ষার্থীরা যেন স্কুলেই পাঠ সম্পন্ন করতে পারে, সে লক্ষ্যে শিখন-শেখানো কার্যক্রম ঢেলে সাজাতে হবে।
শিক্ষাবিদ ও শিক্ষকরা জানান, একটানা ক্লাসে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা ‘শিখন-শেখানো’ কার্যক্রমে মনোযোগ হারিয়ে ফেলেন। এ প্রসঙ্গে সচিব আকরাম-আল-হোসেন বলেন, ‘টানা ক্লাস নেওয়া কোনো শিক্ষকের পক্ষেই সম্ভব নয়। এজন্য প্রতিটি ক্লাস শেষে ১৫ মিনিট করে বিরতি দেওয়ার কথা আমরা ভাবছি। এ পদ্ধতি ফিনল্যান্ডের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় মেনে চলা হয়’। দেশে পরীক্ষামূলকভাবে চারটি বিদ্যালয়ে এ পদ্ধতি চালু করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।