বাংলা গানে কাজী নজরুল ইসলাম

1080

কাজী নজরুল ইসলাম,বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যিনি বিদ্রোহী কবি এবং বাংলা গানের জগতে বুলবুল খ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ও সংগীতস্রষ্টা। নজরুল বাংলা গানে নিজ স্বাতন্ত্র্যে ও সম্পদে প্রতিষ্ঠিত। তিনি জীবনের শুরুতে জীবিকার তাগিদে যোগ দিয়েছিলেন গ্রাম্য লেটো গানের দলে, লেটো গানের মধ্যে পাচালি, পালা, ও লোক-জীবনের সঙ্গে অঙ্গীকৃত মানবিক ভাবনার মহৎ প্রকাশ ঘটেছে। কাজী নজরুল কবিতা, গান, রচনার কৌশল ও লেটো বা কবি-গানের দলেই রপ্ত করেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি বাংলা গানে ইসলামী ঐতিহ্য ও হিন্দু পুরাণের সার্থক রূপায়ণ ঘটান। যখন নজরুলের বয়স ১২/১৩ বছর সেই সময়ে বাংলাদেশের প্রাণের যে সুরধারা প্রতিষ্ঠা পেল তা সারাটা জীবন তাকে তাড়িয়ে নিয়েছে নব-নব সৃজনে।
নজরুল ইসলামের নানা ধরনের গানের মধ্যে তিন ধরনের গান বিশেষ উল্লেখযোগ্য-রাগপ্রধান, গজল, ও কাব্যগীতি। তাঁর রাগপ্রধান গানকে সত্যিকার বাংলা গান না-বলে ভাঙা হিন্দুস্থানী গান বলাই শ্রেয়। নজরুল ভাঙা রাগপ্রধান গান লিখে নতুনত্ব প্রবর্তন করলেও, বাংলা গানের ইতিহাসে নজরুল ইসলামের সবচেয়ে বড়-অবদান হলো গজল গানের। গজল উত্তর ভারতে খুব জনপ্রিয়। নজরুল সেনাবাহিনীর থেকে ফিরে এসে বন্ধুদের আসরে গজল গাইতে শুরু করেন। তারপর এক সময়ে বাংলাতেই গজল লিখে। নজরুল কেবল গজল গানের পথিকৃৎ নন, তিনি বাংলায় সর্বশ্রেষ্ঠ গজল গানের রচয়িতা। তাঁর গজল গান এক সময়ে অসাধারণ জনপ্রিয়তাও লাভ করেছিলো। বলা হয় যে, এক সময় বাংলার শহরে তো বটেই গ্রামে-গঞ্জেও তাঁর গজল গান ছড়িয়ে পড়েছিল।
বিশ শতকে এসে আমরা একজন লোককে লক্ষ্য করি, যিনি একই সঙ্গে গান লিখেছেন, সুর দিয়েছেন, এবং নিজে গেয়েছেন তাঁর নাম নজরুল ইসলাম। যদি আমরা তার গানের সংখ্যা বিবেচনা করি, তা হলে তিনি বাংলা গানের সবচেয়ে বড়ো রচয়িতা। তিনি প্রায় চার হাজার গান লিখেছেন। আবার অনেকে বলেন তাঁর গানের সংখ্যা তিন হাজারেরও কম। নজরুল বাংলা গানের এক বিরাট এবং শেষ উল্লেখযোগ্য মাইল-ফলক। তার পর থেকে একাধারে গীতিকার এবং সুরকার হওয়ার ধারা এক রকম বন্ধ হয়ে গেছে বলে মনে করা হয়। নজরুলের সময় থেকে গান বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত হয়।
১৯২৫ সালে নজরুল ইসলামের গানের প্রথম রেকর্ড বের হয় ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ (এইচ.এম.ভি) কোম্পানি থেকে। এরপর এই ধারাবাহিকতায় অসংখ্য জনপ্রিয় শিল্পীর কন্ঠে অজস্র রেকর্ড প্রকাশিত হয়েছে। যার ধারা বর্তমান পর্যন্ত অব্যাহত আছে। উল্লেখ্য যে, নজরুল ইসলাম ছিলেন বাংলা গজল গানের স্রষ্টা। নজরুলের গণসঙ্গীত ও গজলে যৌবনের দুটি বিশিষ্ট দিক-সংগ্রাম ও প্রেমের পরিচর্যা-ই ছিল মূখ্য। তার অধিকাংশ গজলের বাণীই একই সঙ্গে উৎকৃষ্ট কবিতা এবং বাংলা গানের ইতিহাসে তুলনাহীন।
১৯২৪ থেকে ১৯২৬ সালের মধ্যে নজরুল বেশ কিছু উদ্দীপনামূলক গান রচনা করেন, কালানুক্রমিকভাবে যেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ‘ঘোররে ঘোর আমার সাধের চরকা ঘোর’ ‘শিকল পরা ছল মোদের ঐ শিকল পরা ছল’ ‘কারার ঐ লৌহ কপাট ভেঙে ফেল কররে লোপাট’ ‘ওঠরে চাষি জগদ্বাসী ধর কষে লাঙল’ ‘ধ্বংস পথের যাত্রীদল ধর হাতুড়ি’ ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ ‘আমরা শক্তি আমরা বল’ ‘জাগো অনশন বন্দী ওঠরে যত’প্রভৃতি। এ থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, নজরুলের সঙ্গীত-প্রতিভার প্রথম স্ফূরণ ঘটে উদ্দীপনামূলক গানে। গানগুলিতে তিনি মূলত স্বদেশী সুর ও ঢং ব্যবহার করলেও তাতে দৃঢ বলিষ্ঠতা সংযোজন করেন।
১৯২৬ সালের শেষ দিকে তিনি গজল রচনা শুরু করেন এবং ১৯৩০ সাল পর্যন্ত প্রায় একটানা বহু উৎকৃষ্ট গজল গান রচনা করেন। নজরুলের গজলের বিষয়বস্তু প্রেম, তবে প্রকৃতি মিশ্রিত। সেগুলির বাণী প্রায়শ উৎকৃষ্ট কবিতা, সুর অধিকাংশ ক্ষেত্রে রাগাশ্রিত এবং আঙ্গিকের দিক থেকে প্রায় উর্দু গজলের মতোই। তাতে আগাগোড়া তালের প্রয়োগ নেই, কিছু অংশ তাল ছাড়া মুক্তছন্দ ও আলাপের রীতিতে রচিত এবং বাকি অংশ তালের কাঠামোতে গ্রথিত।
১৯৩০-৩১ সাল থেকে নজরুল নতুন এক ধারার সঙ্গীতরচনায় মনোনিবেশ করেন। এ সময়ে তিনি হিন্দু ভক্তিমূলক এবং ইসলামি গজল গান রচনা শুরু করেন। হিন্দু ভক্তিগীতির মধ্যে তিনি প্রথম রচনা করেন ‘জাগো জাগো শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী’ ‘তিমির বিদারী অলখ বিহারী’ ‘জাগো হে রুদ্র জাগো রুদ্রাণী’ ইত্যাদি। ইসলামি গজল গানের মধ্যে ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’ ‘মোহররমের চাঁদ এল ঐ’ ‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে’ ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’ প্রভৃতি। নজরুল প্রায় এক হাজার ধর্মীয় সঙ্গীত রচনা করেন,যার মধ্যে হিন্দু ঐতিহ্যের শ্যামাসঙ্গীত,ভজন, কীর্তন এবং ইসলামি ঐতিহ্যের হামদ্, নাত, নামায, রোজা, হজ্জ, যাকাত, ঈদ, মর্সিয়া প্রভৃতি বিচিত্র বিষয়ের গান রয়েছে। এসব গানের রচনা ত্রিশের দশকের শেষ অবধি অব্যাহত ছিল।
১৯৩২-৩৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ত্রিশের দশকের শেষ অবধি তিনি যেসব আধুনিক গান রচনা করেন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: ‘মোর আহত পাখীর সম’ ‘বিদায়-সন্ধ্যা আসিল ঐ’ ‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জ-পথে’ ‘পাষাণের ভাঙালে ঘুম’ ‘পথ চলিতে যদি চকিতে’ ‘শুক্নো পাতার নূপুর পায়ে’ ‘ধীরে যায় ফিরে ফিরে চায়’ ‘আধো আধো বোল’ ‘দূর দ্বীপ-বাসিনী’ ‘মোমের পুতুল মমির দেশের মেয়ে’ ‘যবে সন্ধ্যা বেলায় প্রিয় তুলসী তলায়’ ইত্যাদি। এসব গানের মাধ্যমে নজরুল আধুনিক বাংলা গানের ভিত্তিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন।
১৯৫০-এর দশকে রেকর্ড গানের আনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজানো হতো। কিন্তু ষাটের দশকে সরকার সক্রিয়ভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিরোধিতা শুরু করে,তার পাশাপাশি পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করে নজরুলগীতির।
আধুনিক গানের জনপ্রিয়তার মুখে রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নজরুলগীতি উভয় খানিকটা ¤øান হয়ে গিয়েছিল। সে সময় পশ্চিমবঙ্গে নজরুলগীতি প্রায় অপ্রচলিত হয়ে পড়েছিলো। এমনকি কলকাতা বেতারে তখন নজরুলে শ্যামাসঙ্গীত এবং ভক্তিমূলক গান বাজানোর সময় নজরুলে নাম ও উল্লেখ করা হতোনা। ভাবতে অবাক লাগে যে তার মাত্র এক দশক আগে যে নজরুলগীতি-ই বাংলা গানের আসর দখল করেছিলো, সে গান-ই হঠাৎ জন প্রিয়তা হারিয়ে ফেলে। অপর পক্ষে, পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম দিকে নজরুল কল্কেনা-থাকলে ও ঢাকা বেতার থেকে প্রচুর নজরুলগীতি প্রচার করা হতো। ঢাকা থেকে প্রচুর নজরুলগীতি প্রচারিত হওয়ায় কলকাতা বেতারও একেবারে নিশ্চুপ থাকতে পারলোনা। তাই কলকাতা বেতার থেকেও যৎকিঞ্চিত নজরুলগীতি প্রচার করা হতো।
১৯৬৪ সালে সন্তোষ সেনগুপ্তের উদ্যোগে নজরুলগীতির একটি লংপ্লে রেকর্ড প্রকাশ করে এইচএমভি। বাণিজ্যিকভাবে এই রেকর্ড খুব সফল হয়। এর পর নজরুলগীতি হঠাৎ আবার জনপ্রিয় হতে আরম্ভ করে। এ বিষয়ে মানবন্দ্রে মুখোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীরও ভূমিকা ছিল। প্রচুর প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও আধুনিক গানের প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে পারেননি বলে তিনি নজরুলগীতিকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরেন। এভাবে প্রায় হারিয়ে যাওয়া নজরুলগীতিই আবার আসরে ফিরে আসে।
১৯৭০ এর দশকে বাংলা গান আরও একবার নতুন বাঁক নেয়। এর জন্য দায়ী ছিলো বিশেষ করে প্রযুক্তির উন্নতি। এ সময়ে ক্যাসেট রেকর্ডার চালু হওয়ার পর ঘরে ঘরে গানের চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং সেই চাহিদার জোগান দেওয়ার চেষ্টায় অসংখ্য গায়ক-গায়িকা, সুরকার, গীতিকার, এগিয়ে আসেন। কিন্তু এঁরা কতোটা অন্তরের প্রেরণায় গান রচনা করেছিলেন ,বলা শক্ত। বরং বলা যায় যে এরা পেশাদার শিল্পী। অনেক গানকে জীবিকা অর্জনের একটা উপায় হিসেবেই বেছে নিয়েছিলেন। তা ছাড়া এরা কেউই রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল ও নজরুল ইসলামের মতো প্রতিভাবান শিল্পী ছিলেন না, ছিলেন নিতান্ত মাঝারি মেধার কারিগর।
নজরুল আধুনিক বাংলা গানকে শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন, তাই হাজার বছরের বাংলা গানের ইতিহাসে নজরুল এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। তাঁর গান একদিকে যেমন মধ্যযুগীয় বাংলার কীর্তন ও শ্যামাসঙ্গীত বা ঐতিহ্যবাহী লোকসঙ্গীতকে বিষয় ও সুরের দিক থেকে অবলম্বন করেছে, অপরদিকে তেমনি উত্তর ভারতীয় রাগসঙ্গীত ধ্রæপদ, খেয়াল, ঠুম্রি, টপ্পা ও গজলকে আঙ্গিক ও সুরের ভিত্তি করেছে। সর্বোপরি প্রেম ও প্রকৃতিকে অবলম্বন করে নজরুলসঙ্গীত হয়ে উঠেছে আধুনিক বাংলা গানের এক অমূল্য সম্পদ।